ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঝুলন্ত তার ছিঁড়ে মানুষ মরলেও জঞ্জাল সরানোর উদ্যোগ নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ঝুলন্ত তার ছিঁড়ে মানুষ মরলেও জঞ্জাল সরানোর উদ্যোগ নেই

শর্মী চক্রবর্তী ॥ মোহাম্মদপুরে একটি চলন্ত লেগুনার ওপর বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে তার ছিঁড়ে পড়ে এক মহিলা যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। মারাত্মক দগ্ধ হয়েছেন ১৪। দগ্ধ সবাই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। অন্যদিকে মৎস্য ভবনের সামনে বিদ্যুতায়িত হয়ে আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে। দুটি ঘটনাই শুক্রবারের। এভাবে প্রতিদিন বৈদ্যুতিক তারে স্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকে। তারপরও ওই তারের জঞ্জাল অপসারণের কোন উদ্যোগ নেই। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে তাকালেই দেখা যায় চারদিক ভরে গেছে ইন্টারনেট ও ডিশ লাইনের তারের গোছায়। যেসব খুঁটি এসব গোছার ভার বইছে সেসব কুঁজো বুড়ির মতো হয়ে গেছে। যে কোন সময় পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া আরও কিছু ক্ষেত্রে এসব গোছার ঝুলন্ত তার চরম ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিও সৃষ্টি করে। দেখলে মনে হয় অযতেœ জটা লাগা চুল। কিন্তু চুল নয়। সবই তারের জঞ্জাল। ইন্টারনেট, ডিশ, টেলিফোন, বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনগুলো জড়িয়ে আছে একসঙ্গে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাথার ওপর তাকালে এমন দলা পাকানো অবৈধ তারের জঞ্জাল চোখে পড়ে। সরকারী সিদ্ধান্ত অমান্য করে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও কেবল টিভি অপারেটররা দিনের পর দিন মাথার ওপর দিয়ে তার টানছে। চানখারপুল, লালবাগ, নবাবপুর, তাঁতিবাজার, ইংলিশ রোড, চকবাজার, আরমানিটোলা, আজিমপুর, বংশালসহ বেশকিছু এলাকায় তারের জঞ্জালের অবস্থা ভয়াবহ। খুঁটিতে বৈদ্যুতিক তার থাকলেও তার পাশাপাশি টেলিফোন, ডিশ এবং ইন্টারনেটের তার মিলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারে তারে ধাক্কা খেয়ে তার থেকে মাঝেমধ্যে আগুনের ফুলকিও বের হয়। তখনই লোকজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। এছাড়া ট্রান্সফরমারগুলোও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা তারের জটের কারণে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ হতে পারে। আর তা হলে বাঁচার উপায় থাকবে না। এ ব্যাপারেও লক্ষণীয় কোন উদ্যোগ নেই বিদ্যুত বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। মতিঝিল, পল্টন, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, কাওরানবাজার, ফার্মগেট, ধানম-ি, মিরপুর, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় সর্বত্রই জট পাকানো তার ঝুলছে। বিদ্যুতের পিলার ব্যবহার করে এসব তার ছড়িয়ে পড়েছে অলি-গলিতে। বনানী, মহাখালী থেকে গুলশান যাওয়ার পথে, কারওয়ানবাজার এবং মিরপুরের বিভিন্ন সড়কে মাথার ওপরে তারের জঞ্জাল। অনেক জায়গায় এসব অবৈধ তার বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে পেঁচিয়ে গেছে। বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের খুঁটিগুলোতেও লাগানো হয়েছে এসব তার। এসব তারে ট্রান্সফরমারের জড়িয়ে যাওয়ায় যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এসব তার অপসারণের জন্য গঠিত সরকারী কমিটি বলছে, তারা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তার কেটে আসছে। কিন্তু তা শুধু প-শ্রমই হচ্ছে। কারণ, তার কেটে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন করে তার টানছেন ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা। জানা যায়, অনেক হিসাব-নিকাশ ও বিশ্লেষণের পর ২০১০ সালে রাজধানীর কয়েকটি প্রধান সড়ক থেকে তারের জঞ্জাল নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। ইন্টারনেট ও ডিশ ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে তৎকালীন বিদ্যুত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত তার কাটা কমিটি এই কাজ করেছিল। কিন্তু বর্তমান চিত্র বলে কোন কালে এসব তার অপসারণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, একটি টিম এই তার অপসারণে কাজ করছে। তবে তা পুরোটাই বৃথা হয়ে যাচ্ছে। কারণ তার কেটে আসার পর আবার সেই আগের মতো অবস্থা হয়ে যায়। তবে এই কাজ একা বিটিআরসির পক্ষে সম্ভব নয়। বিটিআরসির তৎপরতায় ঢাকায় অবৈধ ঝুলন্ত তার আগের চেয়ে অনেকাংশে কমেছে। ঝুলন্ত তার অপসারণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। অবৈধ তার অপসারণ করতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়াতে হবে। তাহলেই তার অপসারণ করা সম্ভব। এছাড়া ন্যাশনাল ওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্সপ্রাপ্তদের অসহযোগিতার কারণে ঝুলন্ত তার নামছে না। সূত্র জানায়, রাস্তার পাশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঝুলন্ত তার ভূগর্ভস্থ বিতরণ লাইন ব্যবস্থার আওতায় নেয়ার ব্যাপারে ২০১০ সালের মার্চে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে উত্তরা থেকে শাহবাগ পর্যন্ত এবং ৩১ অক্টোবরের মধ্যে উত্তরা-মতিঝিল-গুলশান ও শাহবাগ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এলাকার ঝুলন্ত তার নামিয়ে আনার কথা ছিল। পরে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছিল। ভিআইপি এলাকাগুলোর অবস্থা একেবারে লেজেগোবরে। বিভিন্ন প্রধান সড়কের সঙ্গে আশপাশের ছোট সড়কগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। অনেক স্থানে কু-লী পাকানো ঝুলন্ত তারের গোছা পায়ে হাঁটা মানুষের মাথায় বাড়ি খায়। রিক্সার হুডে বা মাইক্রোবাসের ছাদে আটকে রাস্তায় তারের জঞ্জাল ছিঁড়ে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এক কর্মকর্তা জানান, ন্যাশনাল ওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা এখনও, বিশেষ করে মতিঝিল এলাকায় মাটির নিচে ভূগর্ভস্থ বিতরণ লাইন তৈরি এবং ইন্টারনেট ও ডিশ ব্যবসায়ীদের উপযুক্ত কারিগরি সমাধান দিতে পারেননি। ফলে এসব ব্যবসায়ী গ্রাহক ধরে রাখতে আবারও রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক ও টেলিফোনের খুঁটির সঙ্গে তার ঝুলিয়েছে। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) এক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, কারও কোন ব্যবসায় জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হোক তা কোনভাবেই কাম্য নয়। যারা প্রধান ও অলিগলির সড়কে তার ঝুলিয়ে সাধারণ মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলে ব্যবসা করছে তালিকা করে তাদের তার কেটে ফেলা উচিত। সরকার উন্নত বিশ্বের মতো ভূগর্ভস্থ কমন নেটওয়ার্ক অর্থাৎ নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) তৈরি করেছে, যাতে মাথার ওপরে ঝুলে থাকা তার বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে নামিয়ে ভূগর্ভস্থ ব্যবস্থাপনায় সংযুক্ত করা হয়। ইন্টারনেট সচল রেখে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার নামিয়ে ভূগর্ভস্থ করা সম্ভব। তবে এনটিটিএন পুরো ঢাকায় এখনও এ সুবিধা দিতে পারছে না। এদিকে গত ২৯ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নগর ভবনে কর্পোরেশন, ঢাকা ওয়াসা ও বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় খুব দ্রুত ঝুলন্ত তার মাটির নিচে নেয়া হবে। বৈঠকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট স্থপতি ড. আবু সাঈদ এম. আহমেদ, ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী আবুল কাশেমসহ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তবে এই বৈঠকের পর এখন পর্যন্ত কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি কারও মধ্যে।
×