ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে তৈরি যুদ্ধজাহাজ ভবিষ্যতে বিদেশেও রফতানি হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

দেশে তৈরি যুদ্ধজাহাজ ভবিষ্যতে বিদেশেও রফতানি হবে

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য খুলনা শিপইয়ার্ডকে নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছিলাম। নৌবাহিনী আমার আস্থার প্রতিদান দিয়েছে। দক্ষ ব্যবস্থাপনায় খুলনা শিপইয়ার্ড লাভজনক শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সফলতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ ও যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করছে। এটা দেশের জন্য গৌরবের। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নির্মিত জাহাজ ও যুদ্ধজাহাজ বিদেশে রফতানি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার সূচনালগ্নেই নদী ও সমুদ্রের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। নৌ-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নে তাঁর ছিল ঐকান্তিক আগ্রহ ও গভীর মনোযোগ। জাতির পিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৯৯ সালে ধ্বংস প্রায় খুলনা শিপইয়ার্ডকে নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছিলাম। নৌবাহিনী আমার আস্থার প্রতিদান দিতে সক্ষম হয়েছে। নৌবাহিনীর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় রুগ্ন শিপইয়ার্ড আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। লাভজনক শিল্পে পরিণত হয়েছে। এটা আমাদের গর্ব ও কর্মোদ্দীপনার প্রতীক হয়েছে। ৫টি যুদ্ধজাহাজ সফলতার সঙ্গে নির্মাণের পর পুনরায় ২টি লার্জ পেট্রোল ক্রাফট (বড় যুদ্ধজাহাজ) তৈরি করতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের নৌবাহিনীকে একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে পরিণত করার অংশ হিসেবে বিদেশ থেকে যুদ্ধজাহাজ আমদানির পাশপাশি দেশে অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ তৈরিতে খুলনা শিপইয়ার্ড অনন্য অবদান রেখে চলেছে। এ জন্য তিনি শিপইয়ার্ডের সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এক সময় শিল্পাঞ্চল খ্যাত দক্ষিণাঞ্চলের বহু শিল্প কারখানা দূরদর্শিতার অভাব, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও দুঃশাসনের কবলে পড়ে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রুগ্ন ও বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অকারণে আর একটি কল-কারখানাও বন্ধ হতে দেয়া হবে না। রুগ্ন ও বন্ধ কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি খাতে দেয়া হবে না। এগুলো বিক্রি না করে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে চালু করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা অচিরেই খুলনাকে আবারও একটি কর্মচঞ্চল শিল্প শহর হিসেবে দেখতে পারব বলে আশা করছি। খুলনা শিপইয়ার্ড শ্রমবাজার বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছে তা এ অঞ্চলের অন্যান্য রুগ্ন শিল্প-কারখানাকে সঠিকপথে পরিচালিত করতে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতু আজ আর কোন স্বপ্ন নয়। ইতোমধ্যে সেতু নির্মাণের ২৩ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণ কাজ শেষ হলে এই পদ্মা সেতুই হবে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নতির প্রবেশদ্বার। তিনি বলেন, আমরা মংলা বন্দরের উন্নয়নে কাজ করছি, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ চলছে। এ অঞ্চলের রেলপথ, নৌপথ, আকাশ পথ ও সড়ক পথের উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকার দেশের জন্য নিরন্তর কাজ করছে। বৈদেশিক ঋণের স্থিতি জিডিপির ২৭.৬ শতাংশ হতে ১৪.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন একটি রোল মডেল। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বের পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।’ তিনি বলেন, মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির পিতার স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার দুপুরে খুলনা শিপইয়ার্ডে নৌবাহিনীর জন্য দু’টি লার্জ পেট্রোল ক্রাফট (বড় যুদ্ধজাহাজ) নির্মাণ কাজের ও নির্মিত ২টি কন্টেনার ভেসেলের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন। ভাষণের পূর্বে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মিতব্য যুদ্ধজাহাজ ও নবনির্মিত কন্টেনার ভ্যাসেল উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, কূটনীতিক, তিন বাহিনী প্রধান, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, খুলনা শিপইয়ার্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সুধীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেনÑ খুলনা শিপইয়ার্ডের বোর্ড অব ডিরেক্টরের চেয়ারম্যান ও নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এ্যাডমিরাল এম ফরিদ হাবিব। স্বাগত বক্তব্য রাখেন খুলনা শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমোডর এম খুরশীদ মালিক। খুলনা শিপইয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, দেশের মাটিতে সর্বপ্রথম খুলনা শিপইয়ার্ড নৌবাহিনীর জন্য বড় যে দু’টি যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করতে যাচ্ছে তার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৬৪ দশমিক ২০ মিটার এবং প্রস্থ ৯ মিটার। এর গভীরতা হবে ৪ মিটার। সমুদ্রপথে ঘণ্টায় ২৫ নটিক্যাল মাইল বেগে চলবে। জাহাজে ৭০ জন একসঙ্গে থাকতে পারবেন। এছাড়া খুলনা শিপইয়ার্ডে নৌ-কল্যাণ ফাউন্ডেশনের জন্য নির্মিত আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কন্টেনার ভেসেল ৭৫ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৩.৫০ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট, যা প্রায় ১৪০টি পণ্যবাহী কন্টেনার পরিবহনে সক্ষম। খুলনা শিপইয়ার্ডের অনুষ্ঠানে যোগদানের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মংলায় নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজের কমিশনিং ও দুটি এলসিটি নৌবাহিনীতে সংযুক্তকরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। নৌবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, মংলায় যে তিনটি জাহাজের কমিশনিং করা হয়েছে তার একটি দেশে নির্মিত প্রথম তেলবাহী ফ্লিট ট্যাঙ্কার খান জাহান আলী, যার দৈর্ঘ্য ৭৯.৮ এবং প্রস্থ ১২.৫ মিটার। ২৭০০ টন জ্বালানি তেল, ২৩৩ টন খাবার পানি এবং ১৬১ টন এভিয়েশান ফুয়েল ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজটি ঘণ্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার বেগে চলতে সক্ষম। এ জাহাজটি আনন্দ শিপইয়ার্ডে নির্মিত হয়। খুলনা শিপইয়ার্ডে নির্মিত ল্যান্ডিং ক্রাফট ইউটিলিটি (এলসিইউ) বানৌজা সন্দ্বীপ ও হাতিয়া প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৪২ মিটার এবং প্রস্থ ১০ মিটার, যা ৪০ টন তেল এবং ৬০ টন খাবার পানিসহ ২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম। এলসিটি ১০৩ ও ১০৫ জাহাজ দু’টি ২৫.৬ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫.৪ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট, যা ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম। এ জাহাজগুলো নৌবহরে সংযোজনের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে যুদ্ধজাহাজে তেল ও রসদ সরবরাহের পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী, খাবার পানি সরবরাহ ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করা সম্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুলনায় আগমন উপলক্ষে নগরীর খালিশপুরের বানৌজা তিতুমীর এলাকা থেকে খুলনা শিপইয়ার্ড পর্যন্ত বিভিন্ন সড়কে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটি ও নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে অসংখ্য তোরণ নির্মাণ করা হয়। লাগানো হয় রঙ-বেরঙের প্যানা, বিলবোর্ড ও ব্যানার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারযোগে খালিশপুরের বানৌজা তিতুমীর হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। সেখান থেকে সড়কপথে খুলনা শিপইয়ার্ডে পৌঁছান। শিপইয়ার্ডে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। উল্লেখ্য, খুলনায় প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সফর ছিল ২০১৩ সালে। ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
×