ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ছাড়ি গঙ্গা’র আত্মধ্বংসী বিজ্ঞানী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫

‘ছাড়ি গঙ্গা’র আত্মধ্বংসী বিজ্ঞানী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

গৌতম পাণ্ডে ॥ ‘খুকী, খুকী এলি? এত দেরি করছিস কেন?’ এ সংলাপটি দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘ছাড়ি গঙ্গা’ নাটকে তার চরিত্রকে উপস্থাপন করেন তখন কিছু প্রশ্ন, কিছু সৃষ্টির বিস্ময়ে যেন এক আত্মমগ্ন বিজ্ঞানীকে ডুবে থাকতে দেখা যায়। আত্মভোলা, কার্যত এক আত্মধ্বংসী বিজ্ঞানী, তার কন্যা ও এক বিশ্বস্ত পরিচালক এই তিনজনকে ঘিরেই নাটকের কাহিনী। তিনটি চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর বিস্তৃতি ব্যাপক। এ বিজ্ঞানী আসলে ‘এ্যালকেমিস্ট’। দর্শন ও রসায়নের বিচিত্র গলি খুঁজতেই তার যাতায়াত। এ্যালকেমি কি শুধুই যে কোন ধাতুকে সুবর্ণে পরিণত করার বিদ্যা? আসলে তা নয়। তার মধ্যে আছে আরও অনেক প্রশ্ন। সেই সব প্রশ্নই পীড়িত করে বিজ্ঞানী জ্ঞানেন্দ্র সিংহ রায়কে। তিনি পৌঁছতে চান সৃষ্টির গভীরে। পৌঁছতে চান নিজস্ব অতীতে। কারণ, তার বর্তমান বলতে প্রায় কিছুই নেই। আছে এক মজে-যাওয়া বিল। এক সময় নাকি গঙ্গার সঙ্গে যোগ ছিল, জোয়ারভাটা খেলত জলে। তারপর, সেই সুতোটা ছিঁড়ে গেল। বিল একা হয়ে পড়ল। নাম হলো ‘ছাড়ি গঙ্গা’। সেই ছাড়ি গঙ্গার ধারে নিজের পুরনো ভিটেয় বসবাস শুরু করলেন সেই বিজ্ঞানী। একসময়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। বিজ্ঞানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতও ছিলেন। মহাজাগতিক রহস্যের কুয়াশা ছিন্ন করতে গিয়ে তিনি বিজ্ঞান থেকে ক্রমশ পরবিজ্ঞান চর্চায় মগ্ন হতে থাকেন। আদি সৃষ্টি ও তার স্বরূপ বোঝার জন্য বিচিত্র উদ্ভট পরীক্ষা-নিরীক্ষায় লিপ্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার কাজও চলে গেল। থেকে গেল গবেষণা। কী পেলেন জীবনভর সেই অনুসন্ধান থেকে? সম্পর্কের দাহ? সত্যের স্বরূপ? পুরনো ভিটেয় বানালেন নিজের ল্যাবরেটরি। ছাড়ি গঙ্গার মতো তিনিও একা। শেষ পর্যন্ত প্রিয় স্বীয় শরীরে মন পরিবর্তনকারী ওষুধের পরীক্ষায় নেমে আসে চরম বিপর্যয়। রাতের অন্ধকারে ভাঙাচোরা পুড়ে যাওয়া বাড়িতে যখন ঘুরে বেড়ান, তখন তার ছেড়ে যাওয়া মেয়ে মেঘমালা মাঝে মাঝে এসে অভিযোগ জানায়, মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী তার বাবা। যে আসে সত্যিই কি সে তার মেয়ে? তার বিশ্বস্ত পরিচারক গোপেস্বরইবা কে? সবাই কি তার মতো এই বাড়িতে লুকিয়ে থাকছে? এত সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে জ্ঞানেন্দ্র সেসব সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যায়। রসায়নাগারে বিচিত্র পরীক্ষা চলছিল। পরিণামে তার জীবনে ঘনিয়ে আসে সর্বনাশ। সে একা হয়ে পড়ে। একেবারে একা। তখনই তার মনে এই প্রশ্নটা আসে। ঈশ্বরের নিঃসঙ্গতা ধরতে গিয়ে যদি মানবিক বোধগুলো হারিয়ে যায়। যদি খুলে যায় জীবনের, সম্পর্কের সংরাগের নানা রকম টান! ঠিক যেন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা। ঝাঁপ দিলেই মহাশূন্য। এ সবকিছুর মুখোমুখি হওয়ার কাহিনী নাটক ‘ছাড়ি গঙ্গা’। গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাতে হয় এ কারণে যে তারা এমনই এ জীবনধর্মী নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেছেন এ উৎসবে। শিল্পকলা একাডেমির প্রধান মিলনায়তন শুক্রবার উৎসব উদ্বোধনী সন্ধ্যায় ভারতের সংস্তবের প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। নাটক যৌথভাবে লিখেছেন অমিতরঞ্জন বিশ্বাস ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নির্দেশনা দিয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এতে বিজ্ঞানী জ্ঞানেন্দ্র সিংহরায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মঞ্চে একটানা থেকে পুরো নাটকটিতে অসাধারণ অভিনয়শৈলীতে সবাইকে মুগ্ধ করেছেন তিনি। নাটকে বিজ্ঞানীর মেয়ে মেঘমালার চরিত্রে অভিনয় করেন পৌলমী বসু এবং বিশ্বস্ত পরিচালক গোপেস্বরের ভূমিকায় অভিনয় করেন দ্বিজেন বন্দোপাধ্যায়। জানা যায়, সৌমিত্রের জন্মভিটে ভারতের কৃষ্ণনগরে সত্যিই ‘ছাড়ি গঙ্গা’ নামে একটা বিল আছে। মঞ্চের উপরে নিজের অতীতের দিকে তাকিয়ে আছেন প্রবীণ অভিনেতা। কিংবদন্তি, অথচ গভীরে একটা অসহায়তা কাজ করে। স্মৃতি মাঝে মাঝে ছোবল দেয় ধূসর বিষের মতো। বিচ্ছিন্নতার কোন বোধও কী খেলা করে রক্তে? এই নাটকও কি এক অর্থে ‘নাম জীবন’ নয়? এই নাটকের শিরোনাম যাই থাক, আসলে তা জীবন, তৃতীয় অঙ্ক। আশি বছরের বহমানতায় বুঝি সৃষ্টি রহস্যের দিকে ফিরে তাকানোর সময় হলো? ঈশ্বরের মন বুঝতে গিয়ে যদি শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিই নিজস্ব আত্মা? এই নাটকে বিজ্ঞানী জ্ঞানেন্দ্র সিংহরায় তো সেই নৈতিক সঙ্কটের কথা বলেই ফেলে।
×