ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের কোন ছাড় নয় ॥ সৈয়দ আশরাফ

জন্মাষ্টমীর বর্ণাঢ্য মিছিলে লাখো পুণ্যার্থীর ঢল

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫

জন্মাষ্টমীর বর্ণাঢ্য মিছিলে লাখো পুণ্যার্থীর ঢল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে শনিবার সারাদেশে পালিত হয়েছে মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি, শুভ জন্মাষ্টমী। ঢাকাসহ সারাদেশেই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় হিন্দু সম্প্রদায় বের করে বর্ণাঢ্য ও মনোলোভা ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল। শান্তি, কল্যাণ ও মানবতাবোধের শক্তিতে প্রাণিত হয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, অসত্য ও অন্যায়ের অবসান সম্ভব; এই পূর্ণতিথিতে সেই শুভ কামনাই ছিল দিবসটির মূলকথা। রাজধানী ঢাকায় ৪০৬ বছরে ঐতিহ্যবাহী জাতীয় ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে বর্ণাঢ্য ও মনোলোভা সুবিশাল জন্মাষ্টমীর মিছিলপূর্ব সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, দেশের কিছু কিছু জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে, এটা কোনভাবেই চলতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, যারা এ কাজে জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেয়া চলবে না। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকারী ও জমি দখলকারীরা ‘কাপুরুষ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বাংলাদেশ মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষের। ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করে যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও জমি দখল করে তারা কাপুরুষ। এসব কাপুরুষের জায়গা বাংলাদেশের মাটিতে হতে পারে না। জড়িতদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। সৈয়দ আশরাফ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সারাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ। এখানে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিয়ে বাস করবে এবং যথাযথ মর্যাদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে কোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। শুভ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে দিনের শুরুতেই ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় শ্রীশ্রী গীতাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সংগঠন দিনব্যাপী মঙ্গলাচরণ, নামকীর্তন, শ্রীমদ্ভগবদগীতা পাঠ, কৃষ্ণপুজো, পদাবলী কীর্তন, দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা সভা, আলোচনা সভা ও ধর্মীয় সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। শুভ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে শনিবার ছিল সরকারী ছুটির দিন। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হিন্দু সম্প্রদায়ের কল্যাণ কামনা করে পৃথক বাণী দিয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ নিবন্ধ। বেতার-টেলিভিশন ও বিভিন্ন সরকারী চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। তবে দিবসটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল বর্ণিল ঐতিহ্যবাহী জন্মাষ্টমী মিছিল। এবারের জন্মাষ্টমী মিছিলে নেমেছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী লাখো মানুষের ঢল। নির্বিঘেœ ও প্রাণখুলে হাজার হাজার পুণ্যার্থী মনোলোভা ও জৌলুসপূর্ণ মিছিলে অংশ নিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জয়গান করেছেন। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা শুক্রবার থেকে স্বামীবাগ আশ্রমে শুরু হয়েছে। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির শুভেচ্ছা বিনিময় ॥ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের গণমান্য ব্যক্তিবর্গের সম্মানে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সকালে বঙ্গভবনে এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন। এ সময় রাষ্ট্রপতি সব ধর্মের বন্ধুত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করে জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনে কাজে লাগাতে সকল ধর্মানুসারীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আবহমানকাল থেকে এ দেশের সকল ধর্মের অনুসারী পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বন্ধুত্ব বজায় রেখে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছে। সমাজে বিদ্যমান ভাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব আরও সুদৃঢ় করে তা জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি অর্জনে কাজে লাগানোর জন্য আমি দেশের সকল নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। সনাতম ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, মানব প্রেমের প্রতীক শ্রীকৃষ্ণের ভাবধারা ও আদর্শ ছিল সমাজ থেকে হানাহানি দূরে করে মানুষে মানুষে অকৃত্রিম ভালবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলা। শ্রীকৃষ্ণ আজীবন মানবতার মুক্তির পথ খুঁজেছেন। সৃষ্টিকর্তার বন্দনা ও আরাধনার মাধ্যমে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির আবহ সৃজনে তার আদর্শ সমভাবে প্রযোজ্য। মানব কল্যাণ ও মানবতার সেবাই ধর্মের মূল লক্ষ্য ও আদর্শ। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর স্ত্রী রাশিদা খানম ঘুরে ঘুরে আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে কুশল ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং তাদের সুখী ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত কামনা করেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা, মৎস্য প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, ভারতীয় হাইকমিশনার পংকজ শরণ, নেপালের রাষ্ট্রদূত হরি কুমার শ্রেষ্ঠা, রামকৃষ্ণ মঠের অধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডাঃ প্রাণ গোপাল দত্তসহ সনাতন ধর্মাবলম্বী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিনিয়র রাজনীতিক, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিল্পী, আইনজীবী, চিকিৎসক, বিচারকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন। রাজধানীতে মনোলোভা জন্মাষ্টমী মিছিল ॥ ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল উপলক্ষে শনিবার দুপুর দুটার পর থেকেই পুণ্যার্থীদের ঢল নামে ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে পলাশীর মোড় পর্যন্ত। জন্মাষ্টমী মিছিল বিকেল চারটায় শুরু হওয়ার আগেই হাজার হাজার পুণ্যার্থীর স্রোতে পুরো এলাকা লোকারণ্য হয়ে পড়ে। জন্মাষ্টমীর মিছিলকে সামনে রেখে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। দুপুর থেকেই শত শত পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেন পুরো এলাকা। বিকেল চারটায় বাংলাদেশ পুজো উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সর্বজনীন পুজো উদযাপন কমিটির যৌথ উদ্যোগে রাজধানীর পলাশীর মোড় থেকে জমকালো এই জন্মাষ্টমীর মিছিল বের হয়। সর্বাগ্রে অশ্বারোহীর হাতে রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা এবং পেছনে হাতি, ঘোড়া, গরুরগাড়ি, রথ, টমটম, বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার ও অসংখ্য ট্রাকের মিছিল নিয়ে শুরু হয় এই বর্ণাঢ্য ও মনোলোভা ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে পুণ্যার্থীরা যেন প্রাণখুলে ডাকলেন মহাবতার শ্রীকৃষ্ণকে। অনেকটা প্রাণখুলেই হাজারো নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা অংশ নেন জন্মাষ্টমীর মিছিলে। শুধু দেশেরই নয়, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত কৃষ্ণভক্তরাও নেচে-গেয়ে, সুদীর্ঘ পথ হেঁটেই অংশ নেন জন্মাষ্টমীর মিছিলে। মিছিলটি এতই দীর্ঘ ছিল যে, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে যখন মিছিলের শেষভাগ তখন অগ্রভাগ পৌঁছে গেছে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দূরবর্তী পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে। সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভার পর মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে মিছিলের উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। মহানগর সর্বজনীন পুজো কমিটির সভাপতি জে এল ভৌমিকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ সাহা মনির পরিচালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম, এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, কাজল দেবনাথ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা অসীম কুমার উকিল, জয়ন্ত কুমার দেব, দীপেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জী ও স্থানীয় কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক। এ সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্য, সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক, এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, জয়ন্ত সেন দীপু, সাবেক এমপি অধ্যাপিকা অপু উকিল, এ্যাডভোকেট তাপস পাল, নির্মল চ্যাটার্জীসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ জন্মাষ্টমীর মিছিলে অংশ নেন। বিকেল চারটায় ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’ ধ্বনীতে ঢাক, খোল, করতাল, শঙ্খ, উলুধনীতে চারদিক মুখরিত করে তুলে ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল শুরু হয়। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যান্ডপার্টি, ঢোল, ঢাক ও লাউড স্পীকারের গান-বাজনার তালে তালে হাজার হাজার পুণ্যার্থী নেচে-গেয়ে মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের করুণা চেয়ে তাঁর আবাহন সঙ্গীতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন। দীর্ঘ শোভাযাত্রায় অসংখ্য ট্রাকে, টমটমে, রথ, ঘোড়া ও গরুরগাড়িতে ধর্মাবতার শ্রীকৃষ্ণের প্রতিকৃতি বহন করা হয়। দীর্ঘপথ হেঁটে চলা ভক্তের হৃদয়ের অকৃত্রিম শ্রদ্ধার ধ্বনি ছিল- ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’। বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বর্ণাঢ্য কয়েকটি মিছিলে মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মের মুহূর্তটি স্মরণ করিয়ে দিতে ছোট ছোট শিশুকে কৃষ্ণের অবয়বে সাজিয়ে মাথায় নিয়ে মিছিলে অংশ নেন ভক্তরা। জন্মাষ্টমীর জমকালো শোভাযাত্রাটি ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে পলাশীর মোড় হয়ে জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট মোড়, প্রেসক্লাব, পল্টন, জিপিও, বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ, গুলিস্তান, নবাবপুর রোড হয়ে পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হয়। দীর্ঘ এই মিছিলের কারণে ঢাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। এই দীর্ঘ পথে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করেন দৃষ্টিনন্দন জন্মাষ্টমীর মিছিল। তবে কোথাও কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এদিকে, বিকেলে স্বামীবাগ ইসকন মন্দিরে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথসহ মন্দিরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
×