ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে কাঁচা চামড়ার দাম কমাতে তৎপর শক্তিশালী সিন্ডিকেট

ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে চামড়া শিল্প

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে  চামড়া শিল্প

এম শাহজাহান ॥ ট্যানারি মালিকদের কাছে পুরোপুরি জিম্মি হয়ে পড়ছে দেশের চামড়া শিল্প। কোরবানি ঈদ সামনে রেখে শুরু হয়েছে নতুন কারসাজি। কাঁচা চামড়ার দাম কমাতে তৎপর হয়ে উঠেছে এ শিল্পের শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র। একচেটিয়া ব্যবসার আড়ালে বর্তমান চামড়া শিল্প নিয়ন্ত্রণ করছে ১৫৫টি কারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানের আবার ৯০ ভাগ হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প এলাকায় অবস্থিত। আড়ত মালিক, পাইকার ও ফড়িয়াসহ সবাই জিম্মি ট্যানারি মালিকদের কাছে। কারণ চামড়া শেষ অবধি এদের কাছেই বিক্রির জন্য আনতে হবে। একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ নিয়ে দাম নির্ধারণ হয় বলে কখনই চামড়ার ন্যায্য মূল্য পায় না ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। মাঠ পর্যায়ের চাষীরাও বঞ্চিত হয় ন্যায্য দাম থেকে। উদ্যোক্তাদের উদাসীনতায় পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্প এখনও দেশে গড়ে উঠেনি। তবে এবার চামড়ার মূল্য নিয়ে নয়ছয় বন্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। আগামী সপ্তাহে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে নিয়মনীতির মধ্য থেকে চামড়া কেনাবেচার কঠোর বার্তা পৌঁছে দেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে কাঁচা চামড়ার দাম কমাতে ইতোমধ্যে তৎপরতা শুরু করেছে এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। বিশ্ব বাজারে দাম কমার অজুহাত দাঁড় করানোর পাশাপাশি ট্যানারি মালিকরা বলছেন, তাদের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এই মজুদের পরিমাণও প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ। তাই কোরবানির সময় চামড়ার দাম পড়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিনিসড লেদার, লেদার গুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার এ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) উপদেষ্টা হাজী বেলাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এবার কাঁচা চামড়ার দাম অনেক কমে যাবে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম। তাছাড়া ট্যানারিগুলোতে গত ঈদের ৪০ ভাগের বেশি চামড়া এখনো মজুদ রয়েছে। এগুলো বিক্রি করা যাচ্ছে না। নতুন চামড়া দিয়ে কি করবো? তিনি বলেন, যেসব দেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য পাঠাই, সেখানে এখন শতকরা ২০ শতাংশ কম দামে এ সব পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এর প্রভাব আমাদের বাজারেও পড়বে। এদিকে, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান মতে, দেশে চামড়া শিল্প শক্ত অবস্থানে রয়েছে। প্রতিবছর বাড়ছে রফতানি প্রবৃদ্ধি। ক্রাস্ট চামড়া রফতানির পাশাপাশি প্রতিবছর চামড়াজাত পণ্য জুতো, স্যান্ডেল, বেল্ট, ব্যাগ প্রভৃতি জিনিসের রফতানি বেড়ে যাচ্ছে। তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৮ কোটি ডলারের চামড়ার পাদুকা রফতানি করা হয়েেেছ। এই আয় তার আগেরবারের চেয়ে ২৭ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি। শুধু তাই নয়, চলতি বছরের প্রথম সাত (জানুয়ারি-জুলাই) মাসে ৪ কোটি ১২ লাখ ৭৪ হাজার মার্কিন ডলারের পাদুকা রফতানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্স অফিস অব টেক্সটাইল এ্যান্ড এ্যাপারেল (অটেক্সা) সম্প্রতি এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। জানা গেছে, বিশ্ববাজারে বর্তমানে প্রতি বর্গফুট চামড়া ১ ডলার ৮০ সেন্ট থেকে ২ ডলার ২০ সেন্ট পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। জাত ও মানভেদে বাংলাদেশের চামড়ার খ্যাতি রয়েছে সারা বিশ্বে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মসৃণ চামড়ার উর্বরভূমি হচ্ছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, ধর্মীয় অনুশাসনের কারণেও দেশে সবচেয়ে ভাল উন্নতজাতের গবাদিপশু কোরবানি করা হচ্ছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের চামড়ার দাম কমার কোন আশঙ্কা নেই। দেশের ২৭০টি ট্যানারি এখন চামড়া কেনার জন্য প্রস্তুত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, কোরবানির সময় চামড়ার একটি বড় অংশ সংগৃহীত হয় বলে এ সময়টাতে চামড়ার দাম নিয়ে কথাবার্তা হয়ে থাকে। ব্যবসায়ীরা তাদের মতো বলছেন। তবে আমরা বিষয়টি নজরে নিয়েছি। চামড়া নিয়ে যাতে কোন সিন্ডিকেশন না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, চামড়া নিয়ে আসলে কোরবানিতে কি হচ্ছে তা নিয়ে আগামী সপ্তাহে আমরা একটি বৈঠক করতে যাচ্ছি। সেখানে এ শিল্পের উদ্যোক্তারাও থাকবেন। সবার বক্তব্য শুনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে ওই বৈঠকে। বাণিজ্য সচিব বলেন, কোনভাবেই যাতে চামড়া নিয়ে কোন ধরনের অস্থিরতা তৈরি না হয় সে বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হবে। শুধু তাই নয়, খুচরা ও প্রান্তিক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যাতে চামড়ার ন্যায্যমূল্য পায় সে বিষয়টি মনিটরিং করবে সরকার। এদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এবার দেশে ৩৮-৪০ লাখ গরু কোরবানি হতে পারে। এর পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক খাসি, মহিষ ও বকরি কোরবানি হয়ে থাকে এই ঈদে। এই চামড়া নিয়ে রীতিমতো এখন কারসাজি ও ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। চামড়া পাচারে সক্রিয় হয়ে উঠছে সিন্ডিকেট চক্র। গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ শিল্পের উদ্যোক্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে ব্যবসায়ীরা চামড়া পাচারের আশঙ্কা করে তা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ইতোমধ্যে চামড়া পাচারের জন্য দেশের ১১টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জানা গেছে, চামড়া শিল্পের তিন সংগঠন বিটিএ, বিএফএলএলইএ ও বাংলাদেশ হাইড স্কিন এ্যান্ড মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে এসব পয়েন্ট চিহ্নিত করে ইতোমধ্যে সরকারের কাছে তালিকা হস্তান্তর করেছে। কোরবানি ঈদের চামড়া ওইসব পয়েন্ট দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচারের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঝুঁকিপূর্ণ স্পট হিসেবে বেনাপোল, সাতক্ষীরা, কলারোয়া, জীবননগর, মেহেরপুর, দর্শনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, রাজশাহীর গোদাই, সিলেটের জাফলং, তামাবিল ও করিমগঞ্জ সীমান্ত পয়েন্টকে চিহ্নিত করা হয়েছে। চামড়ার সঠিক দাম নিশ্চিত না হলে চামড়া পাচার হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচা চামড়ার দাম ভারতে বেশি। তাই ওই দেশে পাচার হতে পারে। ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হচ্ছে ॥ চামড়া সংগ্রহে দেশের সর্বত্র সঠিক পদ্ধতির প্রয়োগ না ঘটায় বিপুল পরিমাণ চামড়া ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। লেদার ইঞ্জিনিয়ার্স এ্যান্ড টেকনোলজি সোসাইটি বাংলাদেশের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর দেশে গবাদী পশু থেকে প্রাপ্ত মোট চামড়ার ১৮ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে মূল্যবান চামড়া সম্পদ থেকে প্রতিবছর দেশ হারাচ্ছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। চামড়া ছাড়ানোর পর ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার মধ্যেই কাঁচা চামড়ায় লবণ দিতে হয়। কিন্তু পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতা, অতিমুনাফা প্রবণতার কারণে পরিমাণমত লবণ প্রয়োগে কার্পণ্য করা হয়। এছাড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণে না রাখার কারণে এসব চামড়ার অনেকাংশই প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে অকেজো হয়ে পড়ে।
×