জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ আর ইউরোপ যেতে চান না আব্দুল্লাহ কুর্দি। তিনি চান তার দুই ‘ঘুমন্ত’ সন্তানদের সঙ্গে বাকি জীবন সিরিয়ায় কাটিয়ে দিতে। এভাবে নিজের দুঃখ ভারাক্রান্ত মনের আকাক্সক্ষার প্রকাশ করলেন তুরস্কে সাগর পাড়ে থাকা তিন বছরের শিশু আইলান কুর্দির বাবা। শিশুটির নিথর দেহটি যেন এখন হয়ে উঠেছে বিশ্বের নিপীড়িত অভিবাসী জনগোষ্ঠী মুখচ্ছবি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে পরিবারের সঙ্গে শিশুটি পাড়ি জমিয়েছিল ইউরোপ অভিমুখে। অতি সম্প্রতি নৌকায় করে সাগর পাড়ি দেয়ার সময় গ্রিস ও তুরস্কের মাঝামাঝি সাগরে ডুবে যে ১২ জন সিরীয় মারা গেছে শিশুটি তাদেরই একজন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
লাল টিশার্ট ও নীল প্যান্ট পরা শিশুটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার পর ইউরোপসহ সারা বিশ্বের মানুষ ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেছে। এই ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, নৌকায় করে মানবপাচার বন্ধ করতে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি এ্যাবোট শুক্রবার আবারও তার দেশের কঠোর অভিবাসন নীতির পক্ষে তার অবস্থান তুলে ধরেছেন। তিন বছরের শিশু আইলান কুর্দির ছবিটি এমন এক সময় প্রকাশ পেল যখন অবৈধ মানবপাচারের ফলে ইউরোপ এক গভীর মানবিক সঙ্কটের মুখোমুখি। টনি এ্যাবোট বলেছেন, পাচারকারীদের পাঠানো নৌকা প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীর সহায়তা নিয়ে মূল ভূখ-ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে। তিনি বলেন, ‘শিশুটির যে ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত আমি মনে করি কোন বাবা মা-ই এই ছবি দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারবেন না।’ তিনি বলেন, অবৈধ মানবপাচারের ব্যবসা বন্ধ করতে পারলেই সাগরবক্ষে মৃত্যু ঠেকানো যাবে।
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা ব্যবহার করে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কথাটির বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘মানবতা’ ভেসে গেল ‘সাগরতীরে’। কেউ কেউ চলমান শরণার্থী সঙ্কট সামলাতে ইউরোপের পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘অভিবাসীদের আগমন বিষয়ে ইউরোপ যে মনোভাব দেখাচ্ছে সেটা দুঃখজনক? বিষয়টি সাধারণ মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সময় এসেছে।’ ব্রিটেনের দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রশ্ন তুলেছে, ‘সিরিয়ার ছোট্ট শিশুর মরদেহের এই শক্তিশালী ছবিটি যদি চলমান সঙ্কট নিয়ে ইউরোপের মনোভাবে পরিবর্তন না আনে, তাহলে আর কীসে কী হবে?’
ইউরোপগামী শরণার্থীদের বেশিরভাগ যাচ্ছে জার্মানিতে। জার্মানিও শরণার্থীদের বড় অংশকে আশ্রয় দিচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় ব্রিটেন শরণার্থীদের নিতে দেখাচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে, জনসংখ্যার অনুপাতে ব্রিটেন খুব কম সংখ্যক শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে? তাই ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি শরণার্থী নীতিতে পরিবর্তন আনার দিয়েছে যেন ইইউর দেশগুলো জনসংখ্যার অনুপাতে সমান সংখ্যক শরণার্থী নেয়।
যেভাবে ডুবে গেল নৌকাটি ॥ তখন নিকষ অন্ধকার। বিশাল বিশাল ঢেউ উঠছিল সমুদ্রে। ডিঙিটা দুলছিল বিপজ্জনকভাবে। যাত্রী আবদুল্লাহ কুর্দি হঠাৎ দেখেছিলেন, হাল ধরে থাকা লোকটা জলে ঝাঁপ দিল। বুঝেছিলেন, নৌকা ডুবছে। সঙ্গে স্ত্রী এবং তিন ও পাঁচ বছরের দুই ছেলে। আরও অন্তত জনা তেরো যাত্রী নৌকায়। আবদুল্লাহ চেষ্টা করলেন হাল ধরার। তবু নৌকা উল্টাল। তখন স্ত্রীর হাতটা শক্ত করে ধরতে ধরতে তিনি দেখলেন, হাতের ফাঁক গলে তাঁর বাচ্চা দুটো পড়ে গেল উথাল সমুদ্রে। পরিবারের সঙ্গে সেই শেষ দেখা আবদুল্লাহার। দিনের আলো ফুটলে তাঁর ছোট ছেলের দেহটা ভেসে এসেছিল তুরস্কের বুদরামের সমুদ্র সৈকতে। ভেজা বালির মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছিল তাঁর আদরের আইলান। লাল জামা, নীল প্যান্ট পরা। পায়ে খুদে খুদে জুতো। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে ধুয়ে দিচ্ছিল তার মুখ। এক তুর্কি পুলিশ কোলে তুলে নিয়েছিলেন প্রাণহীন একরত্তি শরীরটাকে।
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে নানা ওয়েবসাইটে ছবিটা ছড়িয়ে পড়তে শিউরে ওঠে বিশ্ব। সেই সঙ্গে উঠে গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আর কতদিন এভাবে জীবন দিয়ে যাবে আইলানের মতো শিশুরা? আইলান শুধু নয়, বড় ভাই গালিব আর মাও মারা গেছে নৌকোডুবিতে। সব হারিয়ে বেঁচে আছেন শুধু আবদুল্লাহ। যুদ্ধ পরিস্থিতি সিরিয়ার কোবানির পরিবারটাকে আচমকাই শরণার্থী বানিয়ে ছিল। কোবানি ছেড়ে প্রথমে দামেস্ক, আলেপ্পো, সেখান থেকে আবার কোবানি। কিন্তু সিরিয়ায় আইএস জঙ্গী এবং কুর্দি বাহিনীর লড়াইয়ে ছেদ পড়ছে না দেখে ভিটেমাটি ছাড়ার চেষ্টা করে পরিবারটি। একবার চেষ্টা করছিল কানাডা যাওয়ার। আবদুল্লাহর বোন তিমা কুর্দি প্রায় বছর কানাডায় আছেন। তিমা চাইছিলেন, ভাই ও তাঁর পরিবার কানাডাতেই আশ্রয় পাক। কিন্তু তুরস্কে সে রকম শরণার্থী সমস্যা নেই এই যুক্তি দেখিয়ে তাঁদের আবেদন বাতিল করে দেয় কানাডা সরকার। শেষে আবদুল্লাহ ঠিক করেন, সমুদ্র পেরিয়ে যাবেন গ্রিসে। তাঁর আফসোস, কেন টাকা পাঠালাম? তা না হলে হয়ত ভাই সিরিয়াতেই থেকে যেত। পাশাপাশি তিনি ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন কানাডা সরকারের বিরুদ্ধেও। এর আগে তাঁর সঙ্গে কানাডায় বসবাস করার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন এক দাদা। কিন্তু তা খারিজ হয়ে যায়। ঘটনা সামনে আসার পর সমালোচকদের ক্ষোভের মুখে পড়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারও।