ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চার লাখ হেক্টরে ফসলের ক্ষতি ;###;শীতের সবজি নষ্ট, যার প্রভাবে কাঁচা বাজারে আগুন ;###;শত কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে ;###;কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী

উত্তর ও দক্ষিণে দু’দফা বন্যা ॥ অসময়ে বিপর্যয়

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

উত্তর ও দক্ষিণে দু’দফা  বন্যা ॥  অসময়ে বিপর্যয়

শাহীন রহমান ॥ অসময়ের বন্যায় বিপর্যস্ত দেশ। ইতোমধ্যে দু’দফায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। জুলাই-আগস্টে প্রথম দফায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সৃষ্ট বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় দফায় বন্যার কবলের পড়েছে দেশের উত্তরের বেশিরভাগ জেলা। অসময়ের এই বন্যায় পানিবন্দী অবস্থায় উত্তরাঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ মানুষ। সম্পূর্ণ বা আংশিক ফসলের ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির। এ ছাড়াও প্রায় শতকোটি টাকার পুকুর ও জলাশয়ের মাছ ভেসে গেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শীতকালীন সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাজারে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই-আগস্টে সাধারণত দেশে বন্যার প্রকোপ দেখা দিলেও সেপ্টেম্বরের শুরুতে এ বন্যাকে তারা অসময়ের বন্যা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, এ বন্যার কারণে ফসলের যে ক্ষতি হয় তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয় পড়ে। সাধারণত এ সময়ে আমন ও রোপা আমনের ক্ষতি হলে নতুন করে রোপণের সময় থাকে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে এবারের দু’দফা বন্যায় ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ৪ লাখ হেক্টর জমির ফসল আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতির শিকার হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দফায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় ১০ জেলায় গত জুলাই-আগস্টের অতিবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড় কোমেনের প্রভাবে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৫৭ হেক্টর জমির ফসল। দ্বিতীয় দফায় আগস্টের শেষে ও সেপ্টম্বরের বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে উত্তরাঞ্চলের বন্যায় ২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের ১০ জেলার কৃষকরা বন্যায় সবকিছু হারিয়ে এখন সর্বস্বান্ত। এবার মৌসুমী বায়ুর আধিক্য থাকায় বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে দেশে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা প্রথম থেকে এবার বন্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তবে দেশের দুই অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সৃষ্ট বন্যাকে তারা বিশ্বব্যাপী যে জলবায়ু পরিবর্তন দেখা দিয়েছে তারই প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। এ কারণেই মূলত আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিতে দক্ষিণে দেখা দেয় বন্যা। এখন আবার ভাদ্র- আশ্বিনের অসময়ের বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে বন্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ী ঢলের কারণেই দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত। কোথাও কোথাও আবার বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। আর এ বন্যার প্রভাবে দেশের উত্তরাঞ্চল এখন বিপর্যস্ত। ফসলের ক্ষয়ক্ষতিসহ উত্তরের জীবনযাত্রা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বন্যায় তলিয়ে গেছে ক্ষেতের ফসল। বিভিন্ন এলাকায় আমন ধান ও শীতকালীন সবজি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে কাঁচাবাজারে। দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন বাজারে সবজির দাম বেশ চড়া। মাঠ পর্যায় থেকে কৃষকরা বলছেন, পানি দ্রুত না কমলে ফসলের ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিক বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার মানুষ। এর বাইরে উত্তরাঞ্চলের অন্য জেলার ফসলের ক্ষতিসহ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাজারও মানুষ। তবে অন্যবারের চেয়ে এবার সিরাজগঞ্জ জেলায় বন্যার প্রকোপ ও নদী ভাঙ্গন অপেক্ষাকৃত কম বলে জানা গেছে। গাইবান্ধার ৭টি উপজেলার ৬২টি ইউনিয়নের ৩৫৭টি গ্রামের আড়াই লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী। এ জেলায় প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ২৭৬ কোটি টাকার ফসল। ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসার পানির কারণে ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র ও করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতিও একই রয়েছে। ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার কারণে এ জেলার ৯টি উপজেলার ৪ শতাধিক গ্রামের ৩ লাখ লোক পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। বগুড়ার সান্তহার ও আদমদীঘি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যমুনা ও বাঙালী নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ ও ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার কারণে এ জেলায় এখনও প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায়। এ বছর প্রথম থেকেই বন্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এবার বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাতেরও পরিমাণ বেড়ে যায়। যে কারণে মে মাস থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর অবধি দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে। তাদের মতে অধিক বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ী ঢলের কারণে দু’দফায় দেশের দু’অঞ্চলে এবার আলাদাভাবে বন্যার প্রকোপে পড়েছে। জুলাই-আগস্ট মাসে অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, ফেনীসহ বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল যখন পানিতে তলিয়ে যায়; ঠিক একই সময় উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাটসহ অন্য জেলায় প্রচ- দাবদাহে আমন ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এমনকি পানির অভাবে আমন চাষ নিয়ে বিপাকে পড়ে জেলার কৃষকরা। শ্রাবণের মাঝামাঝি আমন চাষের মুখ্য মৌসুম হলেও পানির অভাবে চারা নষ্ট হচ্ছে। পাট পচাতে বিপাকে পড়তে হয়েছে কৃষকদের। একদিকে বৃষ্টি না হওয়া অপরদিকে প্রচ- দাবদাহে কৃষকও পড়েন মহাবিপাকে। এখন আবার অধিকাংশ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তরের উঠতি ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। বানের পানিতে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে কৃষকরা। এর প্রভাব সরাসরি রাজধানীর বাজারে পড়তে শুরু করেছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে সব কাঁচা শাকসবজি চড়ামূল্যে বিক্রি হচ্ছে; যা সাধারণ মানুষের ক্রয় সীমার বাইরে। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ীÑ এ বছর জুন, জুলাই, আগস্টে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে জুলাই-আগস্টে সব বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হলেও জুন থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত রংপুর বিভাগে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ একেবারেই কম ছিল। বর্তমানে অধিক পরিমাণ বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে দেশের প্রধান প্রধান নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা বন্যায় তলিয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, আবাদি জমি ও ঘরবাড়িসহ বিস্তীর্ণ জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ফসলের। এদিকে অসময়ে বন্যা দেখা দেয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে রোপা আমনের। পানি বাড়ছে আর একের পর এক রোপা আমন ক্ষেত ডুবছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা বর্তমানে আলোচিত সমস্যা। এ সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। খরাও হচ্ছে আবার অসময়ে বন্যাও হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি না হয়ে অসময়ে (ভাদ্র-আশ্বিন) বৃষ্টি হওয়ার কারণে বন্যা দেখা দিচ্ছে। নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে পানি দুই কূল ছাপিয়ে আশপাশ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। তাদের মতে, এ ধরনের বন্যা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই পানি নেমে যায়। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কৃষকের ফসল বিশেষ করে আমন ধান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত । তখন নতুন করে আমন ধানের চারা রোপণের সময় থাকে না। ফলে কৃষক আমন ধান হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়। রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা দিয়েছেন গাইবান্ধা থেকে আবু জাফর সাবু, কুড়িগ্রাম থেকে রাজু মোস্তাফিজ, সিরাজগঞ্জ থেকে বাবু ইসলাম, বগুড়া থেকে মাহমুদুল আলম নয়ন।
×