ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিন মাসে ৬৭ হাজার মিমি রেকর্ড বৃষ্টি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

তিন মাসে ৬৭ হাজার মিমি রেকর্ড বৃষ্টি

নিখিল মানখিন ॥ বৃষ্টিপাতে রেকর্ড গড়েছে ২০১৫ সাল। ইতোমধ্যে গত ১৪ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। গত ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে বছরভিত্তিক বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যানে এ তথ্য বেরিয়েছে। পরিসংখ্যানে প্রতিবছরের জুন থেকে এ পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের মোট পরিমাণ হিসাব করা হয়েছে। সাধারণত দেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। এ অনুযায়ী চলতি বছরের জুন থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ইতোমধ্যে প্রায় ৬৭ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সামনে সেপ্টেম্বরের পুরো মাসই পড়ে আছে। ২০০০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জুন থেকে সেপ্টেম্বরে হওয়া বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কোন বছরই এককভাবে ৬৫ হাজার মিলিমিটার অতিক্রম করতে পারেনি। প্রতিবছরই জুনের আগে এবং সেপ্টেম্বরের পরে বৃষ্টিপাত হলেও তা বার্ষিক হিসাবে খুব বেশি প্রভাব ফেলে না বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। এক্ষেত্রে জলবায়ুর পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আবহাওয়াবিদরা জানান, মোট বৃষ্টিপাত জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ২০১০ সালে ৪৮ হাজার মিলিমিটার, ২০১১ সালে ৬৫ হাজার, ২০১২ সালে ৫৬ হাজার, ২০১৩ সালে ৪৯ হাজার এবং ২০১৪ সালে ৫৭ হাজার মিলিমিটার। চলতি বছর ২০১৫ সালের জুন, জুলাই ও আগস্টে ৬৩ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। চলতি মাস সেপ্টেম্বরের গত তিন দিনে হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মিলিমিটার। এ নিয়ে ২০১৫ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হয়েছে ৬৬ হাজার ৫শ’ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। সামনে পড়ে আছে পুরো মাস। এছাড়া চলতি মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে আবহাওয়া অফিস। সাধারণত বছরের জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, সারাদেশে মোট বৃষ্টিপাত জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ২০১০ সালে যথাক্রমে ১৮ হাজার মিলিমিটার, ১২ হাজার, ১০ হাজার ও ৮ হাজার মিলিমিটার, ২০১১ সালে যথাক্রমে ১৬ হাজার মিলিমিটার, ১৪ হাজার, ২২ হাজার ও ১৩ হাজার মিলিমিটার, ২০১২ সালে যথাক্রমে ১৬ হাজার মিলিমিটার, ১৮ হাজার, ১২ হাজার ও ১০ হাজার মিলিমিটার, ২০১৩ সালে যথাক্রমে ১৪ হাজার মিলিমিটার, ১২ হাজার, ১৩ হাজার ও ১০ হাজার মিলিমিটার, ২০১৪ সালে যথাক্রমে ১৯ হাজার মিলিমিটার, ১২ হাজার, ১৫ হাজার ও ১১ মিলিমিটার, ২০১৫ সালে যথাক্রমে ১৯ হাজার মিলিমিটার, ২৯ হাজার, ১৫ হাজার এবং সেপ্টেম্বরের গত তিন দিনে হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। এদিকে গত ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জুন মাসের বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে এক বছর বেশি বৃষ্টিপাত হলে পরবর্তী বছরে হয়েছে কম বৃষ্টিপাত। এভাবে জুনে ২০০০ সালে ১৪ হাজার ৮৮১ মিলিমিটার, ২০০১ সালে ২৪ হাজার ৭০৮, ২০০২ সালে ২০ হাজার ১৩৫, ২০০৩ সালে ২৩ হাজার ২৪৪, ২০০৪ সালে ১৬ হাজার ৭৭৮, ২০০৫ সালে ১২ হাজার ২২৪, ২০০৬ সালে ১২ হাজার ২৭০, ২০০৭ সালে ১৮ হাজার ৮৩৯, ২০০৮ সালে ১৫ হাজার ২৫১ এবং ২০০৯ সালে ৯ হাজার ৭০৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। আর গত ২০০৪ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যানে নিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এক বছরে বেশি হলে পরবর্তী বছরে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। কিন্তু সেই নিময় অনুযায়ী ২০১২ সালে প্রত্যাশিত দেশে জুনে ১৭ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়নি। গত বছরও জুনের অর্ধেকটা সময় তেমন বৃষ্টিপাত হয়নি। গত ২০১১ ও ২০১২ সালে পর পর দু’বছর জুন মাসে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত দশ বছরে সারাদেশের জুলাই মাসের মোট বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেও দেখা যায়, ২০০১ সালে ১৪ হাজার ৫০৯ মিলিমিটার, ২০০২ সালে ২১ হাজার ৩০২, ২০০৩ সালে ১১ হাজার ৩৪৬, ২০০৪ সালে ১৯ হাজার ১৬৬, ২০০৫ সালে ১৭ হাজার ৮৩২, ২০০৬ সালে ১৪ হাজার ৭৫৪, ২০০৭ সালে ২৩ হাজার ৪১৫, ২০০৮ সালে ২১ হাজার ৮৯৩ ও ২০০৯ সালে ১৯ হাজার ৭৭৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এদিকে দেশে বৃষ্টিপাতের মাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে জলবায়ু ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ তারই সাক্ষ্য বহন করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসময়ে অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, হঠাৎ বন্যা আর হিমালয়ের বরফগলা ঢলের চক্রজনিত বাস্তুচ্যুতি ও জীবিকানাশের ঝুঁকি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রায় সকল পরিবেশগত ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫০ বছরের আবহাওয়ার গড় হিসাবই হলো ‘জলবায়ু’ । তাই আবহাওয়া ব্যতিক্রম আচরণ করলে, জলবায়ুতে তার প্রভাব পড়ে। আর আবহাওয়া বা জলবায়ু যে বিষয়ই হোক না কেন, তার সঙ্গে মানুষের সার্বিক অবস্থার গভীর যোগসূত্র রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশে মারাত্মক পানিজনিত সমস্যা বিদ্যমান। আর জলবায়ুর পরিবর্তন এ সমস্যা আরও ঘনীভূত করেছে। গত এক দশকের আবহাওয়ার পরিবর্তন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৬ সালের শেষ দিকে লা নিনা গঠিত হতে থাকে। লা নিনার বেলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হয়। ২০০৭ সাল থেকে যে লা নিনা শুরু হয়, সেটাও স্বাভাবিক নয়। এটা ২০০৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত বলবত থাকে। ওই সময়টা ছিল এনসো নিউট্রাল কিন্তু নিউট্রাল অবস্থাটা হঠাৎ করেই এল নিনোর দিকে মোড় নেয়, যা কিছু ঘটছে এর জন্যই ঘটছে। সাধারণত এল নিনো বছরগুলোতে বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়; খরাজাতীয় পরিস্থিতি বিরাজ করে। যেমনটা হয়েছিল ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৯৭ সালে। এল নিনোর জন্য মৌসুমী বায়ু পূর্বদিক থেকে পশ্চিমে যতটা বেগে আসার কথা ছিল, ততটা পারেনি। তারপরও বিভিন্ন অঞ্চলে পানি হঠাৎ যে বেড়ে গেছে, তা বৃষ্টির পানি নয়। যাকে বলে ফাশ ফাড বা হঠাৎ বন্যা, তা ঘটছে হিমালয়ের বরফ গলা পানির জন্য। বাংলাদেশের ঝড়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখি, এল নিনো বছরগুলোতে ঝড়ের মাত্রা বেড়ে যায়। ১৯৬৩ সালের মে মাসে নোয়াখালী-কক্সবাজার এলাকায় বিরাট ঝড় হয়েছিল। চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে ১৯৭০ সালের নবেম্বরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কথাও সবার জানা। একইভাবে ১৯৮৫ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে বড় ঝড় হয়। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে উপকূলীয় অঞ্চলে বড় ঝড় হয়। ১৯৯৭ সালের নবেম্বরে বড় ঝড় হয় চট্টগ্রামে। নবেম্বরে ২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করী সিডরের ক্ষত তো এখনও শুকায়নি। সেটা হয়েছিল লা নিনা বছরে। এর শুরু ২০০৬ সাল থেকে। একইভাবে এপ্রিল ২০০৯ সালে যে বিজলি হয়, সেটাও হয় লা নিনা পর্যায়ে।
×