ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আসামি করা হয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৫ সদস্যকে

ব্লগার ওয়াশিকুর হত্যা মামলার চার্জশীট দাখিল

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ব্লগার ওয়াশিকুর হত্যা মামলার চার্জশীট দাখিল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা মামলার চার্জশীট দাখিল করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তবে সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আদালত চার্জশীটটি নথিভুক্ত করেনি বলে আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান। সদ্যনিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৫ সদস্যকে আসামি করে চার্জশীট দাখিল করা হয়। আসামিদের মধ্যে ২ জন পলাতক। চলতি বছরের ৩০ মার্চ সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকার তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ির বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে (২৭)। নিহত বাবু ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে ধর্মীয় গোড়ামির বিষয়ে লেখালেখি করতেন। বাবু তেজগাঁও কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে মতিঝিলের ফারইস্ট এভিয়েশন নামের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন। তার পিতার নাম টিপু সুলতান। বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রামে। সামহোয়্যারইন ব্লগে ‘বোকা মানব’ নামে একটি এ্যাকাউন্ট থাকলেও বাবু মূলত ফেসবুকের কয়েকটি একাউন্টে লেখালেখি করতেন। হত্যার পর পালানোর সময় জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে হিজড়ারা ধাওয়া করে ধরে পুলিশে সোর্পদ করে। গ্রেফতারকৃতরা ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই বাবুকে হত্যা করেছে বলে জানায়। এ বিষয়ে ওইদিনই গ্রেফতারকৃত দুইজন ছাড়াও আবু তাহের এবং মাসুম নামের আরও দুইজনকে আসামি করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করেন নিহতের বোনজামাই মনির হোসেন মাসুদ। পরে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মামলাটির তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের ডাকাতি দস্যুতা ও ছিনতাই প্রতিরোধ টিমের পশ্চিম বিভাগের পরিদর্শক মোঃ মশিউর রহমান মামলাটি তদন্ত করে চার্জশীট দাখিল করেন। মঙ্গলবার দুপুরে অভিযোগপত্রটি ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে পাঠানো হয়েছে। চার্জশীটভুক্ত আসামিরা হচ্ছেÑ আরিফুল ইসলাম, জিকরুল্লাহ, সাইফুল ইসলাম, জুনায়েদ ওরফে তাহের ও হাসিব ওরফে আব্দুল্লাহ। আসামিদের মধ্যে আরিফুল ইসলাম ও জিকরুল্লাহ হত্যাকা-ের পরপরই জনতার হাতে ধরা পড়ে। আর সাইফুলকে হত্যাকা-ের কয়েক দিন আগেই ধারালো অস্ত্রসহ যাত্রাবাড়ী থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে সাইফুল হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। জুনায়েদ ওরফে তাহের এবং হাসিব ওরফে আব্দুল্লাহ পলাতক। আসামিদের মধ্যে বাবু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আব্দুল্লাহ। অভিযোগপত্রে ৪০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের জানান, বাবু হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন আরও দুইজনের বিষয়ে তদন্ত চলছে। হত্যাকা-ে সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলে সম্পূরক চার্জশীটে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তদন্তকারী সূত্রে জানা গেছে, ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যার মূল পরিকল্পনা করে আব্দুল্লাহ। পলিকল্পনা বাস্তবায়নে হত্যাকারীরা ৩ মাস আগে যাত্রাবাড়ীতে একটি বাসা ভাড়া করে বসবাস শুরু করে। সেই বাসাতেই ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কিভাবে হত্যা করা যায়, সে বিষয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়। হত্যায় অংশ নেয়ারা বাড়ি থেকে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করার কথা বলে বাড়ি থেকে আসে। এ জন্য তারা দীর্ঘ সময় বাড়ি যেতে পারবে না বলেও বাড়ির লোকজনদের জানায়। হত্যাকারীরা মাদ্রাসায় না গিয়ে যাত্রাবাড়ীর ভাড়া বাসায় উঠে। সেখান থেকেই বাবুকে হত্যার সুবিধাজনক জায়গা ও সময় ঠিক করে। চার্জশীটভুক্ত ৫ আসামির মধ্যে মাস্টারমাইন্ড আব্দুল্লাহ ছাড়া ৪ জনই মাদ্রাসার ছাত্র। হত্যাকা-ের পর জনতার হাতে ধরা পড়া আরিফ ও জিকরুল্লাহ দু’জনই চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র। পলাতক দুইজন ছাড়াও মাসুম ওরফে ইকবাল হাদি (৩০), শরীফ (৩২) ও আবরার (২৫) নামে আরও তিনজনের বিষয়ে তদন্ত চলছে। যদিও তাদের সর্ম্পকে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য মেলেনি। গ্রেফতারকৃত তিনজনের মধ্যে সাইফুল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। জবানবন্দীতে ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই বাবুকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায়। হত্যার জন্য তারা অনুতপ্ত নয়। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের প্রতিবাদে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগারদের মাধ্যমে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ৬ ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। আর হত্যাচেষ্টা হয়েছে অনেক ব্লগার ও মুক্তমনা মানুষকে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খুন হওয়া প্রকৌশলী রাজিব হায়দার শোভন ও ২০১৩ সালের ৯ মে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরিফ রায়হান দ্বীপ হত্যা মামলা দুইটি আদালতে বিচারাধীন। এছাড়া চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক প্রকৌশলী অভিজিত রায় হত্যা, ১২ মে সিলেটে মুক্তমনার আরেক ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ ও সর্বশেষ গত ৭ আগস্ট খিলগাঁওয়ে দিন-দুপুর বাসায় ঢুকে ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আদলের বিভিন্ন নামে প্রতিটি হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। এ তিন ব্লগার হত্যার তদন্ত চলছে। হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
×