ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

‘স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখে ঢাকি’

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

‘স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখে ঢাকি’

অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় আগের একটি স্মৃতিচিত্র এঁকে আজকের লেখাটি শুরু করছি। ১৯৫০ সালের কথা। মুসলিম লীগ-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র তখন পুরনো ঢাকার ১৫০ নম্বর ওল্ড মোগলটুলির একটি অফিস। শেখ মুজিবুর রহমান তখন ছাত্রলীগের নেতা। মুসলিম লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে তখন ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলন ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। মোগলটুলি তার প্রাণকেন্দ্র। শেখ মুজিবের দুই ঘনিষ্ঠ সহচর এমএ ওয়াদুদ আর এমএ আউয়াল তখন এই মোগলটুলির অফিসে রাত্রিবাসও করেন। একদিন সকালে এমএ ওয়াদুদ (তিনি তখন সকলের কাছে ওয়াদুদ ভাই) তাঁর সহকর্মী আউয়ালকে জানালেন, আজ বরিশাল থেকে মানিক ভাই আসবেন। এই মানিক ভাই মানুষটি কে আউয়াল সাহেবকে তা জানানো হলো। তাঁর পুরো নাম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। তিনি শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর অনুসারী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি খাজা নাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ। অন্যটি শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বে প্রগতিশীল অংশ। এই প্রগতিশীল অংশেরই মুখপত্র ছিল কলকাতার পার্ক স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ। মানিক মিয়া দৈনিক ইত্তেহাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাগ হওয়ার পর পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় চলে আসে। মুসলিম লীগের নাজিমউদ্দীন গ্রুপ পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন হয়। ভাষা আন্দোলনের সূচনায় দৈনিক ইত্তেহাদের পূর্ব পাকিস্তানে আসা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীরও পূর্ব পাকিস্তানে আগমন নিষিদ্ধ হয়। সোহ্রাওয়ার্দী গ্রুপে যেসব বড় বড় নেতা ছিলেন যেমন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী, আবদুল মালেক (’৭১-এর ঠ্যাডা মালেক) তারা কেউ মন্ত্রিত্ব, কেউ রাষ্ট্রদূতের পদ পেয়ে নাজিমউদ্দীন গ্রুপে চলে যান। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের একনায়কত্বমূলক শাসনের গণতান্ত্রিক বিরোধিতার স্থানটি শূন্য হয়ে পড়ে। এই শূন্যতা পূরণেই অসীম সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগের কয়েকজন যুব নেতা। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম শেখ মুজিবুর রহমান, এমএ ওয়াদুদ, আনোয়ার হোসেন, নুরুদ্দীন আহমদ এবং আরও অনেকে। তাঁদের উদ্যোগে প্রথমে গণতান্ত্রিক কর্মী শিবির এবং পরে ১৯৪৯ সালের ২৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হন প্রাদেশিক আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি এবং ঢাকায় ইত্তেহাদ নামে পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি না দেয়ায় ‘ইত্তেফাক’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন ফজলুর রহমান খাঁ। পত্রিকাটি ঢিমেতালে চলছিল। তখন এমএ ওয়াদুদ পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনার ভার নেন। বরিশালের ভা-ারিয়া থেকেও তখন মানিক মিয়া ঢাকায় চলে আসেন। কলকাতায় দৈনিক ইত্তেহাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানিক মিয়া ভা-ারিয়ায় চলে গিয়ে কিছুকাল বেকার অবস্থায় কাটান। কিন্তু যোগাযোগ ছিল সোহ্রাওয়ার্দী গ্রুপের যুবনেতা শেখ মুজিব ও তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ সহচর এমএ ওয়াদুদ ও এমএ আউয়ালের সঙ্গে। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগে কয়েকজন অফিসার নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। মানিক মিয়া এই চাকরির জন্য দরখাস্ত করেন এবং ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু কোথায় থাকবেন? শেখ মুজিবকে সে কথা জানাতেই তিনি ওল্ড মোগলটুলিতে মানিক মিয়ার থাকার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। ওয়াদুদ ভাই তাঁর থাকার খাটটি মানিক মিয়ার জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজে মাটিতে শোয়ার ব্যবস্থা করেন। তখন সরকারবিরোধী আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনের ঘাঁটি ছিল মোগলটুলি। ওয়াদুদ ভাই আন্দোলনের সার্বক্ষণিক কর্মী। গায়ে খাকি শার্ট, পরনে খাকি প্যান্ট, মাথায় ফৌজি টুপি। হাতে টিনের চোঙা। রিকশায় বসে সেই চোঙা ফুঁকিয়ে সারা শহরে আন্দোলনের ডাক দিয়ে বেড়াতেন। মানিক মিয়াকে তিনি সাদরে ওল্ড মোগলটুলিতে এনে ওঠালেন। মানিক মিয়ার সঙ্গে ওয়াদুদ ও আউয়ালের সৌহার্দ্য গড়ে উঠল। মানিক মিয়া চাকরির ইন্টারভিউ দেয়ার প্রস্তুতি নিলেন। ঠিক এই সময় ঘটল এক বিপত্তি। মানিক মিয়ার চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দেয়ার আগের রাত্রে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচী প্রণয়নের জন্য ওয়াদুদ ভাই এক কর্মিসভা ডেকেছিলেন। পুলিশ তা জানতে পেরে মাঝরাতে মোগলটুলির অফিস ঘেরাও করে। যুব নেতাকর্মীদের অনেকে বাড়ির দেয়াল টপকে পালিয়ে যান। মানিক মিয়া পালাননি। পুলিশ তাঁকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের এক নেতা ভেবে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। পরে অবশ্য পুলিশের ভুল ভাঙে। তারা মানিক মিয়াকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু তাঁর চাকরির ইন্টারভিউর দিনটি তখন পার হয়ে গেছে। মানিক মিয়া মোগলটুলির বাসায় ফিরে এলেন। সব শুনে ওয়াদুদ ভাই (আমিও তাঁকে ওয়াদুদ ভাই ডাকতাম) বললেন, আল্লাহ্্ যা করেন ভালর জন্য করেন। আপনি সরকারী চাকরি না পাওয়ায় ভালই হয়েছে। আপনি সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের দায়িত্ব নেন। পত্রিকাটি চলছে না। আমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেব। আপনি সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। কলকাতায় দৈনিক ইত্তেহাদে কাজ করার অভিজ্ঞতা তো আপনার আছেই। ওয়াদুদ ভাই প্রস্তাবটি শেখ মুজিবকে (তাঁকেও আমি ভাই ডাকতাম। তিনি তখন উদীয়মান যুব নেতা) জানান। তিনি লাফ দিয়ে উঠলেন। মানিক মিয়াকে তিনি কলকাতা থেকেই চিনতেন। বললেন, আরে মানিক ভাই তো কলকাতায় দৈনিক ইত্তেহাদেও লেখালেখি করতেন। সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ বলতেন, ‘মানিক মিয়ার মধ্যে বিশাল সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে। তা জাগানো দরকার।’ বঙ্গবন্ধুই (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হননি) মওলানা ভাসানীর কাছে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের দায়িত্ব মানিক ভাইয়ের ওপর ন্যস্ত করার কথা বলেন। এরপর আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা ইয়ার মোহাম্মদ খান থাকেন পত্রিকার প্রকাশক ও মুদ্রাকর। মানিক ভাই হন সম্পাদক এবং ওয়াদুদ ভাই প্রধান ব্যবস্থাপক। ওয়াদুদ ভাই ইত্তেফাকের জন্য লিখতেন, পত্রিকার সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন বিভাগ চালাতেন। আবার পত্রিকা বিক্রি করার জন্য রাজপথে হকারিও করেছেন। ইত্তেফাক ও মানিক ভাইয়ের সঙ্গে ওয়াদুদ ভাইয়ের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। মানিক ভাইয়ের ঢাকায় আসার গোড়ার দিকে শুধু মোগলটুলির বাসায় নয়, ওয়াদুদ ভাই যখন তৎকালীন রাজনৈতিক নেতা শামসুদ্দীন এমএলএ’র বাড়িতে আবাসিক গৃহশিক্ষক ছিলেন, তখন মানিক ভাইও ওই বাড়িতে তাঁর সঙ্গে অবস্থান করেছেন। সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাকে’ এমএ ওয়াদুদের সঙ্গে এমএ আউয়ালও এসে জোটেন। দু’জনই এক সময় শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। মুসলিম লীগ সরকারের অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে ‘ইত্তেফাকে’ আরও জোরালো লেখা প্রয়োজন। কারণ, ‘ইত্তেফাক’ তখন একমাত্র বিরোধীদলীয় কাগজ। পত্রিকাটির ছাপা আরও উন্নতমানের করার জন্য হাটখোলা রোডে প্যারামাউন্ট প্রেসে ছাপার ব্যবস্থা হয়। এই সময় ওয়াদুদ ভাই প্রস্তাব দেন মানিক ভাইকে একটি রাজনৈতিক কলাম লেখার জন্য। যাতে মুসলিম লীগের সকল অপকীর্তি, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের প্রতি সকল অবিচারের কথা জোরালো ভাষায় তুলে ধরা হবে। ভাষা আন্দোলনেও সমর্থন জানানো হবে। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব মাঠে আছেন। পত্রিকায় কলম ধরবেন মানিক মিয়া। ওয়াদুদ ভাই মানিক মিয়াকে অনুরোধ জানিয়ে বললেন, ‘দৈনিক ইত্তেহাদে আপনি লেখালেখি করেছেন। আবুল মনসুর আহমদও আপনার লেখার প্রশংসা করেছেন। আপনার সাহস আছে। আপনি প্রতি সপ্তাহে একটা লেখা শুরু করুন।’ মানিক মিয়া রাজি হলেন। লেখা শুরু করলেন তাঁর সেই অপূর্ব ও অসাধারণ রাজনৈতিক কলাম, যা মুসলিম লীগ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ নামে এই কলামটি পরিচিত। কিন্তু সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে এই কলামটি শুরু হয়েছিল ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’ নামে। মানিক মিয়ার লেখনী এবং ওয়াদুদ ভাইয়ের ব্যবস্থাপনার গুণে সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ দেশের সর্বাধিক প্রচারিত কাগজে পরিণত হয়। চুয়ান্নর প্রাদেশিক নির্বাচনের আগের বছর দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ প্রকাশের আয়োজন হয়। এবার উদ্যোগটি নেন মানিক ভাই নিজে। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কিছু টাকা দেন। নিজে ব্যাংক থেকে লোন নেন মানিক ভাই। তাঁর সর্বকাজে সহযোগী এমএ ওয়াদুদ। মানিক ভাই পরবর্তীকালে স্বীকার করেছেন, ‘ওয়াদুদ মিয়া না থাকলে ’৫৩ সালে ওই চার পৃষ্ঠার দৈনিক ইত্তেফাকও প্রকাশ করা সম্ভব হতো না।’ বিপত্তি দেখা দেয় চুয়ান্ন সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বিজয়ের কিছু পরেই। মওলানা ভাসানী ও শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ দেখা দেয়। দৈনিক ইত্তেফাক শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে সমর্থন দেয়। ফলে মওলানা ভাসানী ইত্তেফাকের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পত্রিকার মাস্তুল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন। এমনকি ভাসানী সমর্থক ইয়ার মোহাম্মদ খান ছিলেন ইত্তেফাকের মুদ্রাকর ও প্রকাশক। তিনি নিজের নাম প্রত্যাহার করে ইত্তেফাক বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় মধ্যস্থতার ভূমিকায় নামেন ওয়াদুদ ভাই। তাঁর ধৈর্য ও পরিশ্রমের জন্য ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ হয়নি। মানিক ভাই পত্রিকাটির সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর হয়ে নতুন ডিক্লারেশন লাভ করেন। এর পরেও বিপত্তি কাটেনি। মওলানা ভাসানী তাঁর কিছু পরামর্শদাতার পরামর্শে দৈনিক ইত্তেফাকের মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করেন। এবার মধ্যস্থতার ভূমিকায় নয়, ইত্তেফাক রক্ষার লড়াইয়ে নামেন ওয়াদুদ ভাই। তাঁর পরামর্শে মানিক ভাই সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের মালিকানা মওলানা ভাসানীকে ফিরিয়ে দেন। পত্রিকাটির এ্যাকাউন্টে কিছু টাকা ছিল। সেই টাকা, পত্রিকাটির হেডপিসের ব্লক, সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপনের সব কাগজপত্র ওয়াদুদ ভাই কারকুনবাড়ি লেনের বাসায় গিয়ে মওলানা ভাসানীকে বুঝিয়ে দেন। ইয়ার মোহাম্মদ খানের কারকুনবাড়ি লেনের এই বাসায় তখন মওলানা ভাসানী অবস্থান করছিলেন। ওয়াদুদ ভাইকে মওলানা ভাসানী নিজ হাতে চা আর কেক খাইয়েছিলেন। এরপর মওলানা ভাসানীর পরিচালনা ও মালিকানায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক আবার প্রকাশিত হয়েছিল। আবার সম্পাদক হয়েছিলেন ফজলুর রহমান খাঁ। কিন্তু পত্রিকাটি বেশিদিন টেকেনি। দৈনিক ইত্তেফাক টিকে রয়েছে। ১৯৫৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হয়। আমি ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেই ১৯৫৫ সালে। তার আগে কাজ করতাম ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়ার দৈনিক মিল্লাত কাগজে। মোহন মিয়াও তখন মুসলিম লীগ-বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। আমার ইচ্ছে ছিল পুরোপুরি আওয়ামী লীগপন্থী ইত্তেফাকে কাজ করার। দেশের প্রখ্যাত তরুণ সাংবাদিকরা তখন ইত্তেফাকে কাজ করেন। আমি তখন ছাত্রলীগের কর্মী। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এমএ আউয়াল। সেই সুবাদে তাঁকে ধরলাম, ইত্তেফাকে ঢোকার জন্য। তিনিও তখন ইত্তেফাকের সঙ্গে জড়িত। আউয়াল ভাই পরামর্শ দিলেন ‘আমি তোমার কথা মানিক মিয়াকে অবশ্যই বলব। তুমি আগে ওয়াদুদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করো। ইত্তেফাকে সব ব্যাপারে তাঁর কথাই শেষ কথা। আমি তাঁকেও তোমার কথা বলব।’ আউয়াল ভাইয়ের কথায় রাজি হলাম। ওয়াদুদ ভাইকে তখন দূর থেকে চিনি। তিনি সকল মহলে আওয়ামী লীগের জিওসি নামে পরিচিত ছিলেন। গম্ভীর, রাশভারি এই মানুষটিকে দেখলে আমি ভয় পেতাম। খাকি পোশাক পরা ওয়াদুদ ভাইকে মিটিং-মিছিলে দেখলে একজন মিলিটারিম্যান বলে আমার কাছে মনে হতো। কিন্তু তাঁর গাম্ভীর্যের আড়ালে যে অসীম দরদী স্নেহপ্রবণ মনটি লুক্কায়িত ছিল, তার প্রমাণ পরে পেয়েছি। দৈনিক ইত্তেফাক অফিস তখন হাটখোলা রোডে প্যারামাউন্ট প্রেসের ভেতরে। অফিস বলতে কয়েকটা চেয়ার-টেবিল। বাইরে একটা টিনের শেডে এ্যাকাউন্টস-এর অফিস। আমি ওই অফিসে ওয়াদুদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি প্রথম পরিচয়েই আমাকে তুমি সম্বোধন করলেন। বললেন, ‘মিল্লাতে তোমার লেখা আমি পড়েছি। তুমি তো আমাদের লোক। ইত্তেফাকে চলে এসো। মানিক ভাইকে তোমার কথা বলে রেখেছি। তিনি এখনি এসে পড়বেন।’ কিছুক্ষণের মধ্যে মানিক ভাই এলেন। আমার সঙ্গে দু’একটা কথা বলার পরেই বললেন, ‘যান আজকের সম্পাদকীয়টা লিখে ফেলুন। বিষয় খাদ্য পরিস্থিতি।’ সেদিনই ইত্তেফাকে আমার চাকরি হয়ে গেল। আমার জন্য বসার কোন ব্যবস্থা ছিল না। প্যারামাউন্ট প্রেসের গুদাম ঘরে বসে ইত্তেফাকের জন্য প্রথম সম্পাদকীয় লিখেছি। ইংরেজীতে একটা কথা আছে ভার্সেটাইল জিনিয়াস, যার বাংলা করা হয় বহুমুখী প্রতিভা। সম্ভবত কথাটা ওয়াদুদ ভাইয়ের জন্য সর্বাংশে প্রযোজ্য। বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কোন্ আন্দোলনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না বা নেতৃত্ব দেননি তা বলা মুশকিল। অসম্ভব সাহসী রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠক ও নেতা ছিলেন। অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। ভাষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন, শিশু সংগঠন গড়ে তোলা, নারী মুক্তি আন্দোলনে সাহায্য জোগানো, স্বাধিকার আন্দোলন থেকে একটি জনপ্রিয় সংবাদপত্রকে গড়ে তোলাÑ সর্বক্ষেত্রে এমএ ওয়াদুদ তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁর চরিত্রের এসব দিক নিয়ে তাঁর বহু গুণগ্রাহী স্মৃতিকথা লিখেছেন। আমি শুধু তাঁর ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে (২৮ আগস্ট) শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচিত্র আঁকতে চাই। একটু পরের কথা আগে লিখছি। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি করাচী থেকে ঢাকা সফরে এলেন। ঢাকা বিমানবন্দরে তাঁকে সরকারী ও বেসরকারীভাবে বিরাট সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। ঢাকায় বিমান থেকে নেমেই তিনি চারপাশে তাকালেন, তারপর তাঁকে স্বাগত জানাতে আসা শেখ মুজিবকে জিজ্ঞাসা করলেন, হোয়ার ইজ ওয়াদুদ? শেখ মুজিব তাঁকে জানালেন, ওয়াদুদ গুরুতর অসুস্থ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছেন। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী বললেন, ‘আমি প্রথম হাসপাতালে যাব। তারপর অন্য কাজ।’ প্রধানমন্ত্রীর বিরাট গাড়িবহর হাসপাতালের দিকে ছুটল। সোহ্রাওয়ার্দী গাড়ি থেকে নেমেই বডিগার্ডদের পেছনে ফেলে হাসপাতালের একটি সাধারণ ওয়ার্ডে ঢুকলেন। তারপর গিয়ে বসলেন একেবারে ওয়াদুদ ভাইয়ের শিয়রের কাছে। অনেকক্ষণ অসুস্থ মানুষটির হাত জড়িয়ে বসে রইলেন। তারপর ভাঙা বাংলায় বললেন, ‘ওয়াদুদ, তুমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠো।’ (পরবর্তী অংশ আগামী শুক্রবার) লন্ডন, ১ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার, ২০১৫
×