ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বদেশ রায়

ইয়াসমিন হক আমাদের মাফ করবেন

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৩১ আগস্ট ২০১৫

ইয়াসমিন হক আমাদের মাফ করবেন

মোবাইলে বিডিনিউজ২৪-এ অধ্যাপক ইয়াসমিন হকের ছবি দেখে শুধু লজ্জিত হয়নি, চোখের জল আটকাতে পারিনি। নিজেকে কিছুক্ষণ সামলে নিয়ে তাঁকে ফোন করি। ফোন করেছিলাম নিজেকে সামলাতে না পেরে। কিন্তু সত্যি অর্থে কিছুই তাঁকে বলতে পারিনি। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দু’চোখ জলে ভরে যায়, গলা ধরে আসে। শুধু তাঁকে বলি, আপনাকে কী বলব? অপর প্রান্তে তাঁরও গলা ধরা। তাঁর দু’চোখ যে জলে ভরা তা বুঝতে কোন কষ্ট হয়নি। কথা বাড়াতে পারিনি। তিনি বলেছিলেন, জাফর বসে আছে (জাফর ইকবাল)-তাঁকে ফোন করতে পারিনি। তাঁদের দু’জনের কষ্ট আমাদের থেকে অনেক বেশি। তাঁরা দু’জনেই গোটা দেশের তরুণ-কিশোরদেরকে নিজ সন্তানের থেকে কম মনে করেন না। অনেকটা ওদের জন্যই তাঁদের জীবন উৎসর্গকৃত। ফোন রেখে ইয়াসমিন হকের কান্নাজড়িত কণ্ঠের স্বরটি উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। কেন আজ তিনি এত ভেঙ্গে পড়েছেন। ইয়াসমিন হক সম্পর্কে আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষের উপলব্ধি- জীবনে যে ক’জন বীরত্বপূর্ণ মানুষ দেখেছি, ইয়াসমিন হক তাঁদের একজন। এমনকি ব্যক্তিগত আলোচনায় অনেকের সঙ্গে বলেছি, ইয়াসমিন হক যদি শেখ হাসিনার পাশে থাকতেন, তাহলে জাতি আরও অনেক পেত। ইয়াসমিন হককে জানি, তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে আর কোথাও যাবেন না। কী মমত্বের সঙ্গে তিনি শিক্ষকতা করেন, তা প্রকাশের ভাষা নেই। আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর ভালবাসা, কমিটমেন্ট ও শ্রদ্ধা কোন্ উচ্চতায় তার অনেক উদাহরণ আছে। গণজাগরণ মঞ্চে জাফর ইকবালের পাশে তেজস্বিনী ইয়াসমিন হককে লাখো মানুষ দেখেছেন। তার পরেও একটি ক্ষুদ্র ঘটনা বলি, অধ্যাপক জাফর ইকবাল একদিন একটি ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন, শিশু-কিশোরদের অনুষ্ঠানে। সেখানে শিশু-কিশোরদের অনেক সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁকে ফুলের তোড়া দেয়া হয়, তিনি তার সবই নিয়েছিলেন। ধূর্ত ইসলামী ছাত্র শিবির তাদের একটি গ্রুপের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে সেখানে ঢুকিয়ে দেয়। জাফর ইকবাল বুঝতে পারেননি। তিনি তাদের কচি মুখ দেখে সে ফুল নেন। এ ঘটনা শুনে ইয়াসমিন হক ক্ষেপে যান, তিনি তাঁর জীবনের বন্ধু জাফর ইকবালকে বলেন, তুমি দেখবে না কারা তোমাকে ফুল দিচ্ছে। যতই বালক বা কিশোর হোক, তারা তো শিবির। ইয়াসমিন হক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এটা প্রমাণ করার জন্য কিন্তু এই উদাহরণ দেইনি। ইয়াসমিন হক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এ কথা আজ প্রমাণ করতে বসার অর্থ তাঁকে ছোট করা। এত ছোট যেন তাঁকে না করি। বরং তিনি যে কত বড় তা গতকাল তাঁর ভেঙ্গে পড়া দেখে বুঝতে পারি। কারণ, তিনি তো শুধু শিক্ষক নন, তিনি মা, মায়ের মমতায় তিনি তাঁর ছাত্রদের দেখেন। তাই নিজের সন্তানরা যখন তাঁর গায়ে হাত দিয়েছে, তখন এ জাতির অন্য সকল মানুষের থেকে তিনিই তো বেশি লজ্জিত। কারণ, যারা তাঁকে অপমান করেছে তারা তাঁর সন্তান। আর এ সত্যকে তো অস্বীকার করার উপায় নেই, কুপুত্র অনেক হয়, কুমাতা কখনই নয়। এ কারণেই বীরত্ব দিয়ে গড়া ইয়াসমিন হকের অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে, কান্নাজড়িত হয়েছে তাঁর কণ্ঠ। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ইয়াসমিন হকের প্রতি এ আচরণ গোটা জাতির জন্য লজ্জার। ছাত্র নামধারী যারা এ কাজ করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেও এ লজ্জা মোছার নয়। তার পরও এই অপরাধীরা কোনমতেই পার পেয়ে যেতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেবেন, এ বিশ্বাসও জাতির আছে। হয়ত আমাদের এ সব লেখা প্রকাশ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর ব্যবস্থা নেবেন ওই ছাত্র নামধারী গু-াদের প্রতি। তবে ইয়াসমিন হকের ওপর এই হামলার পরে, কতকগুলো বিষয় যদি একটু গভীরভাবে ক্ষতিয়ে না দেখা হয়, তাহলে কিন্তু এমন লজ্জার পুনরাবৃত্তি বার বার ঘটতে থাকবে। সঙ্কট আরও গভীরে যাবে। যেমন, কেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে টিকতে দেয়া হলো না? কেন আজ জাফর ইকবাল, ইয়াসমিন হকদের আন্দোলন করতে হচ্ছে? আর কেন এ সব ঘটনা ঘটার পরে শেষ পর্যন্ত প্রতিক্ষেত্রে শেখ হাসিনাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়? কোথায় এ অযোগ্যতা, তা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। অন্যদিকে, অতীতের ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যতের শেখ হাসিনার উন্নত বাংলাদেশের সহযাত্রী হিসেবে ছাত্রলীগ টিকে থাকতে চায় না সন্ত্রাসীদের সংগঠন হিসেবে নিজেদের পরিচিত করতে চায়Ñএ সিদ্ধান্তও ছাত্রলীগকে নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী, সরকার বা প্রশাসন সিদ্ধান্ত বা ব্যবস্থা নেয়ার আগেই যদি ছাত্রলীগ ওই সব সন্ত্রাসী যারা ইয়াসমিন হককে অপমান করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিতে পারে, যদি ছাত্রলীগ নেতৃত্ব নিজে থেকে ফুটেজ দেখে তাদেরকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করতে না পারেÑতাহলে বুঝতে হবে সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসের পথ ধরেছে। এ পচন কেটে ফেলা ছাড়া শেখ হাসিনার আর কোন উপায় থাকবে না।
×