ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে ভিন্নতা;###;ফরমালিনের মাত্রা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ;###;ফলে ক্রেতারা বঞ্চিত হচ্ছেন সঠিক তথ্য থেকে

খাদ্যে ভেজালের মাত্রা নিয়ে বিভ্রান্তিতে তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৩০ আগস্ট ২০১৫

খাদ্যে ভেজালের মাত্রা নিয়ে বিভ্রান্তিতে তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক

শাহীন রহমান ॥ খাদ্যে ভেজাল নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা হলেও ভেজালের মাত্রা নিয়ে এখনও রয়ে গেছে বিভ্রান্তি। বিশেষ করে ভেজালের মাত্রা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে ভিন্নতা রয়েছে। আবার অনেক সময় সঠিক পরীক্ষা ছাড়াই ঢালাওভাবেই খাদ্যদ্রব্যে ব্যাপক ভেজালের কথা বলা হচ্ছে। পরীক্ষায় এমনও দেখা গেছে, এক প্রতিষ্ঠান থেকে খাদ্যে রাসায়নিক পদার্থ ফরমালিনের উপস্থিতির কথা বলা হলেও অন্য প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায় তা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতার কারণে ভেজাল নিয়ে সাধারণ মানুষ গোঁজামিলের মধ্যে পড়েছে। ফলে ভেজাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জানায় সাধারণ মানুষ অনেক সময় পড়ছে ভোগান্তির মধ্যে। খাদ্যে ভেজালের ভিন্নতার পরিসংখ্যানও মানুষের মধ্যে তৈরি করছে আতঙ্ক। গত বছর ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে আমসহ মৌসুমী ফলে ফরমালিন থাকার অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশ পথে সাঁড়াশী অভিযান চালানো হয়। ফরমালিন থাকার অভিযোগে ধ্বংস করে ফেলা হয় কোটি কোটি টাকা মূল্যের মৌসুমী ফল। পরে পরীক্ষায় দেখা গেছে ফরমালিন পরীক্ষার যন্ত্রটিও ঠিক ছিল না। এ বিষয়ে আদালতের এক নির্দেশের পর বিসিএসআইআর ও বিএসটিআইসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আদালতে দেয়া রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় ডিএমপির ফরমালিন মাপার যন্ত্রটি ঠিক ছিল না। এটি মূলত ছিল বাতাসের ফরমালিন মাপার যন্ত্র; খাদ্যদ্রব্যের ফরমালিন মাপার যন্ত্র নয়। ফলে মৌসুমী ফলসহ খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন থাকা না থাকা নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে দেখা দেয় ব্যাপক বিভ্রান্তি। আবার খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন বা অন্য রাসায়নিক পদার্থ মেশানো ও তার মাত্রা নিয়ে প্রকাশিত দুটি গবেষণা প্রতিবেদনে ভিন্ন তথ্যও ভোক্তাদের বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দেয়। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সরকারী সংস্থাগুলোর তথ্যের গরমিল সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব সংস্থার পক্ষ থেকে বাজারে শতকরা ৯৫ ভাগ লিচু ও শতভাগ জামে বিষাক্ত ফরমালিন পাওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হলেও বিএসটিআইসহ সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাতে ক্ষতিকর মাত্রায় ফরমালিনের অস্তিত্ব না থাকার কথা বলা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করার দায়িত্ব সরকারের। বিশেষ করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ও দফতরের অধীনে রয়েছে একাধিক পরীক্ষাগার। কিন্তু এসব পরীক্ষাগারে নিজ উদ্যোগে খাদ্যে স্যাম্পল পরীক্ষা করে ভোক্তাদের জানানোর ব্যবস্থা করা হয়নি। তাদের মতে, বিষ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার ওপর ন্যস্ত রয়েছে। খাদ্যে বিশেষ করে ফলমূল, মাছ-মাংস, দুধ, সবজিতে ব্যবহৃত ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, টেক্সটাইল ডাই, কীটনাশক (ডিডিটি, পিসিবি অয়েল) পরীক্ষা ও তার আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তা জনগণকে অবহিত করা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব প্রতিপালনে গবেষণাগারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব সংস্থার নিজস্ব গবেষণাগার রয়েছে, যা খাদ্য বিশ্লেষণ কার্যকলাপের সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িত। ফরমালিনের মাত্রা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। কোন পক্ষ বলছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে ফরমালিন স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। আবার অন্যপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ফরমালিনের কোন সহনীয় মাত্রায় নেই। তাদের মতে, খাদ্যের পরিপূরক হিসেবে ফরমালিন ব্যবহারের কোন বিধান নেই। ফলে খাদ্যে যে কোন মাত্রার ফরমালিন ব্যবহারই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, খাদ্যদ্রব্য বিশেষ করে ফলমূলে প্রাকৃতিকভাবেই ফরমালিনের অস্তিত্ব থাকে। কৃত্রিমভাবে মেশানো ফরমালিন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশ শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) সূত্রে জানা গেছে, ফলমূলে প্রাকৃতিকভাবে যে ফরমালিন থাকে তা গবেষণায় ধরা পড়ে না। শুধু কৃত্রিমভাবে মেশানো ফরমালিনের অস্তিত্ব পরীক্ষায় ধরা পড়ে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞদের মতে, ফরমালিনের গ্রহণীয় বা অগ্রহণীয় মাত্রা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোন সুযোগ নেই। কেননা ফরমালিন যেকোন মাত্রারই হোক না কেন, তা কোনভাবেই মানবদেহের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। এটা কোনভাবেই খাদ্যের সঙ্গে থাকা উচিত নয়। ফরমালিন কোন স্বীকৃত প্রিজারভেটিভ নয়। তাই এর কোন সহনীয় মাত্রার ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। এটি একটি বিষাক্ত দ্রব্য, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে মানবশরীরের জন্য ফরমালিনের গ্রহণযোগ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে শূন্য দশমিক ১৫ পিপিএম। এর বিপরীতে ডিএমপি, বিএসটিআই ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সহনীয় মাত্রা বানিয়ে নিয়েছে ২ পিপিএম, যা আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে প্রায় ১৪ গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এসব কারণে মানবশরীরের ফরমালিনের সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য মাত্রা নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ব্যাপক বিভ্রান্তি। কিন্তু সরকারী কোন সংস্থার পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, প্রস্তাবিত ফরমালিন আইনেও তাই ফরমালিনের কোন সহনীয় মাত্রা রাখা উচিত হবে না। বরং এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা বাহানায় পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এ্যান্ড ড্রাগ এ্যাডমিনিস্ট্রেশন, যুক্তরাজ্যের (এমএইচআরএ) মেডিসিন এ্যান্ড হেলথ কেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি, অস্ট্রেলিয়ার টিজিএ (থেরাপিউটিক গুডস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন) ইত্যাদি আন্তর্জাতিক স্বনামধন্য সংস্থাগুলো ফরমালিনের কোন সহনীয় মাত্রা নির্ধারণের চেষ্টা করেনি। কারণ যে বিষাক্ত দ্রব্য ক্যান্সার তৈরি করে শরীরে তার সহনীয়তার প্রশ্নই আসে না। শুধু ফরমালিন নয় আন্তর্জাতিক ও দেশের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে খাদ্যদ্রব্যের ভেজালের মাত্রা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। ফলে ক্রেতা ভেজালের সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এফএও এবং খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারের ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসের যৌথ পরীক্ষায় রাজধানীর ৮২টি দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, মাছ, ফল ও শাকসবজির নমুনার ৪০ শতাংশে মিলেছে নিষিদ্ধ ডিডিটি, এ্যালড্রিন, ক্রোলড্যান হেপ্টাক্লোরসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান। এতে বলা হয়েছে, ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজিতে বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশক রয়েছে। চালের ১৩টি নমুনার ৫টিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ও ক্যাডমিয়াম পাওয়া গেছে। মুরগি ও মাছে পাওয়া গেছে মানুষের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক। আম ও মাছের ৬৬টি নমুনায় পাওয়া গেছে ফরমালিন। লবণে রয়েছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি সীসা। অপরদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০১৪-তে উল্লেখ করা হয়েছেÑ ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের (আইপিএইচ) পরীক্ষাগারে ২০০৯-২০১৩ সালে মোট পরীক্ষাকৃত খাদ্য নমুনায় ৪৯ শতাংশই ভেজাল মিশ্রিত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১১ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভেজাল নমুনা পাওয়া গেছে, যা নমুনার শতকরা ৫৪ দশমিক ০৪ ভাগ। বর্তমানে এ হার কমে ৪৩ দশমিক ০২ এ নেমে এসেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে পরীক্ষায় কিছু খাদ্যে শতকরা ১শ’ ভাগই এবং ঘি, জুস, মধু, ক্যান্ডি ও সয়াবিন তেলের ৮০-৯৯ শতাংশে ভেজাল পাওয়া গেছে। আবার জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) অধীন ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি তাদের গবেষণালব্ধ তথ্য ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, দেশের মানুষ প্রতিদিন যে মাছ, মাংস, দুধ, ফল, চাল, ডাল, তেল, মসলা ও লবণ খাচ্ছে, তার শতকরা ৪০ থেকে ৫৪ ভাগেই ভেজাল রয়েছে। এসব পরীক্ষাগারের খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল সম্পর্কে যেসব তথ্য দেয়া হচ্ছে তার মধ্যে বেশ গরমিল রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফলমূলসহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যদ্রব্যে যে ভেজাল রয়েছে এটা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। তবে ভেজালের মাত্রা নিয়ে সরকারী বিভিন্ন দফতরের দায়িত্বশীলতার অভাব রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অধীনে একাধিক পরীক্ষাগার থাকলেও ভেজালের মাত্রা পরীক্ষা করে কখনও জনসাধারণকে জানানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে কখনও সতর্কও করা হয়নি। বিএসটিআইয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, বিএসটিআইয়ের দায়িত্বের মধ্যে না পড়লেও খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিগত কয়েক বছর ধরে অভিযান চালানো হয়েছে। এ বিষয়ে জনগণকে সতর্ক করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিএসটিআইয়ের কাজ হলো কোন প্রতিষ্ঠান গুণগতমানের পণ্য উৎপাদন করছে কিনা, তা যাচাই করা। প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত খাদ্যের মান পরীক্ষা করে পণ্য উৎপাদনের অনুমতি প্রদান করা। কিন্তু এর বাইরে বিশেষ করে ফলমূলসহ হোটেল রেস্তরাঁর তৈরি খাবারের মান পরীক্ষা করে অভিযান চালানো বিএসটিআইয়ের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। তারপরও বিএসটিআই এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে।
×