ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক

সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্র নক্সা চূড়ান্ত

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৫ জুলাই ২০১৫

সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্র নক্সা চূড়ান্ত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নতুন মানচিত্রের নকশা চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। এই মানচিত্র অনুযায়ী দুই দেশের সীমান্তের ছিটমহল এলাকায় নতুন করে সীমানা চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়া সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় জমি হস্তান্তর, ছিটমহলবাসীদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছে দুই দেশ। শুক্রবার ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সীমান্ত চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপের দুই দিনব্যাপী বৈঠক শুক্রবার শেষ হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের ৪০জন প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন। এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। অপরদিকে ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথান। বৈঠকে উভয় দেশের ছিটমহল এলাকার জেলা প্রশাসকরাও যোগ দেন। বৈঠকে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্রের নতুন সীমানা চিহ্নিত করা হয়। উভয় দেশের সীমানায় সীমিতভাবে রদবদল আনা হয়েছে। এর ফলে বিদ্যমান দুই দেশের মানচিত্র বদলে যাবে। বৈঠকে দুই দেশের কর্মকর্তারা মানচিত্রের খুঁটিনাটি বিবেচনা করে সীমানা চূড়ান্ত করেছেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের লক্ষ্যে স্যার সিরিল রেডক্লিফের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র এঁকেছিলেন। তারপর পূর্ব পাকিস্তানের এলাকাগুলো নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ। এখন সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেই মানচিত্র কিছুটা বদলে গেছে। আর মানচিত্র পরিবর্তনের মতো বড় একটি কারণে ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তিতে স্পষ্টভাবে বলা রয়েছে, দুই দেশের কোন সীমানা কিভাবে নির্ধারিত হবে। এই চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চার রাজ্য- অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের সীমারেখায় পরিবর্তন হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগ্রাম ও লালমনিরহাটের সীমারেখায় পরিবর্তন হয়েছে। দুই দিনব্যাপী বৈঠকে দুই দেশের অপদখলীয় ভূমির বিষয়ে আলোচনা হয়। দুই দেশের মধ্যে অপদখলীয় ভূমি সমস্যার সমাধান ও নতুন করে সীমানা চিহ্নিত করে দ্রুত স্ট্রিপ ম্যাপ তৈরির জন্য উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। এছাড়া স্ট্রিপ ম্যাপ তৈরির পর দ্রুত সীমানা পিলার বসানোর বিষয়ে সম্মত হয়েছেন উভয় দেশের প্রতিনিধিরা। বৈঠকে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ইতোমধ্যেই এক হাজার ১১৪টি স্ট্রিপ ম্যাপ সই ও বিনিময় হয়েছে। তবে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী অপদখলীয় জমি ও অচিহ্নিত এলাকার ৩৫টি স্ট্রিপ ম্যাপ দ্রুত চূড়ান্ত করতে হবে। বৈঠকের বিষয়ে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, খুঁটিনাটি সব বিষয় আলোচনা হয়েছে। লোকজন কিভাবে যাবে, কখন যাবে, পুজোর আগে না পরে, জমি বিক্রি নিয়ে কি হবে, আমরা কতটুকু নিরাপত্তা দেব এমন সব বিষয়। কর্মকর্তা পর্যায়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে না পারলে সরকারের উচ্চপর্যায়ে সমাধান করা হবে। প্রয়োজনে উভয় দেশের সরকারের সহযোগিতা নিয়ে নির্ধারিত সময় ৩১ জুলাই মধ্যরাতেই ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হবে। বৈঠকে ছিটমহল এলাকার সাধারণ নাগরিকদের সাময়িক চলাচলের জন্য তিনটি নতুন পয়েন্ট চালুর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব পয়েন্ট দিয়ে এসব নাগরিকরা উভয় দেশের মধ্যে সাময়িকভাবে চলাচল করতে পারবে। ছিটমহল বিনিময় চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সেখানের বাসিন্দারা হলদিবাড়ি, বুড়িমারি ও বাংলাবান্ধা পয়েন্ট দিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিনিধিদের এই বৈঠকে ছিটমহলবাসীদের নিরপত্তার বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে। ছিটমহল বিনিময় না হওয়া পর্যন্ত উভয় দেশ ছিটমহলবাসীকে নিরাপত্তা দেবে। এছাড়া ছিটমহল এলাকায় কোন ধরনের আইন শৃঙ্খলার অবনতি না ঘটে সে বিষয়েও উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। ছিটমহল এলাকার সাধারণ মানুষের সম্পদের যথাযথ নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়। এ বিষয়ে উভয় দেশের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ছিটমহল এলাকার সাধারণ মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা দিতে সরকারের বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। ছিটমহল বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই নির্দেশনা মেনে চলা হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের ১৬২ ছিটমহলের মধ্যে ভারতীয় ১১১ ছিটমহলের অবস্থান নীলফামারীতে চারটি, লালমনিরহাটে ৫৯, পঞ্চগড়ে ৩৬ ও কুড়িগ্রামে ১২টি। আর বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহলের অবস্থান ভারতের কোচবিহারে ৪৭ ও জলপাইগুড়িতে চারটি। জনগণনা জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের ১১১ ছিটমহলের ৪১ হাজার ৪৪৯ বাসিন্দার মধ্যে ভারতে যেতে চান মাত্র ৯৭৯ জন। এর মধ্যে নীলফামারীর চার ছিটমহল থেকে কেউ ভারতে যেতে চায়নি। তবে পঞ্চগড়ের ৩৬ ছিটমহল থেকে ৪৮৩ জন, কুড়িগ্রামের ১২ ছিটমহল থেকে ৩০১ জন ও লালমনিরহাটের ৫৯ ছিটমহল থেকে ১৯৫ জন ভারতের যাওয়ার জন্য নিবন্ধন করেন। ভারতে যেতে ইচ্ছুক নাগরিকদের তালিকা ইতোমধ্যেই জেলা প্রশাসকদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুই দেশই নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। এই সময়সীমার মধ্যেই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হবে। তবে দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় ও নাগরিকত্ব নির্ধারণের পরেও কোন সমস্যা হলে ২০২০ পর্যন্ত তা সমাধান করা হবে। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চলতি বছরের ৩০ নবেম্বরের মধ্যে ছিটমহলের ভূমি জরিপ, রেকর্ড তৈরি, খতিয়ান ম্যাপ তৈরির পর দুই দেশের জেলা প্রশাসনের মধ্যে বিনিময় করা হবে। ছিটমহলবাসীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই দুই দেশের সরকার অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ছিটমহলবাসীদের পুনর্বানের লক্ষ্যে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার থেকেও সেদেশের ছিটমহলবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। ছিটমহলবাসীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ইতোমধ্যেই তিন হাজার নয় কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও ভারতের জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপের এই বৈঠক বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়। শুক্রবার রাত পৌনে আটটায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বৈঠক চলছিল।
×