ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুকে সর্বজনীন স্মরণে মিডিয়ার সহযোগিতা চাই

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২৪ জুলাই ২০১৫

বঙ্গবন্ধুকে সর্বজনীন স্মরণে মিডিয়ার সহযোগিতা চাই

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘সর্বজনীন’ করতে গণমাধ্যমের সহযোগিতা চেয়ে বলেছেন, অবশ্যই আমরা আপনাদের (গণমাধ্যম) কাছ থেকে কিছু চাইতে এসেছি। এটি আমাদের কিংবা আওয়ামী লীগের জন্য নয়, বঙ্গবন্ধুর জন্য। আশা করি, বঙ্গবন্ধুকে সার্বজনীন করতে সকলেই আমাদের সহযোগিতা করবেন। কেননা যত দোষ ত্রুটিই থাক, অনেকে অনেক সমালোচনাও করতে পারেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুই এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। দ্বিতীয় কেউ নয়। বৃহস্পতিবার ধানম-ির আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের সম্পাদক, প্রকাশক, কর্মাধ্যক্ষ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ সব কথা বলেন। শোকাবহ ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। দীর্ঘদিন অনেকটাই নিশ্চুপ থাকার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সরব হয়ে ওঠা এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে এ মতবিনিময় সভার উদ্যোগকে সাধুবাদই জানিয়েছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা। বলেছেন, কুহেলিকার অন্ধকার থেকে এখন সৈয়দ আশরাফ প্রদীপের আলোতে উদ্ভাসিত হয়েছেন। এটা সত্যিই আনন্দের। মতবিনিময়কালে শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নিজস্ব স্বকীয়তা থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সৈয়দ আশরাফ বলেন, আমরা কোন কর্মসূচী কিংবা অনুষ্ঠান চাপিয়ে দিতে চাই না। চাপিয়ে দেয়া কোন কিছু মৌলিকও হয় না। আমরা চাই গণমাধ্যমগুলো নিজস্ব স্বকীয়তা থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনুষ্ঠান করুক কিংবা সংবাদ প্রকাশ করুক। বঙ্গবন্ধুকে জনমানুষের কাছে পৌঁছে দিক। তাদের এ সৃজনশীলতা থেকে নতুন প্রজšে§র পাশাপাশি আমরাও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নতুন অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারবো। মতবিনিময় সভায় প্রবীণ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা বিভিন্ন পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে যথেচ্ছ ব্যবহার এবং শোক দিবস উপলক্ষে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানান। জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ইতোমধ্যেই দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৫ আগস্টকে ঘিরে চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। কারও নামে এমন চাঁদাবাজির অভিযোগ এলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর ছবি যথেচ্ছ ব্যবহার রোধেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা সম্পর্কে একাধিক সাংবাদিকদের নানা অভিযোগের জবাবে হাস্যোজ্জ্বল সৈয়দ আশরাফ বলেন, প্রতিদিন মিডিয়াতে কথা বললে পপুলারিটি (জনপ্রিয়তা) বাড়ে না, বরং কমে। আর যত কম কথা বলা যায়, ততই ভুল হওয়ার সুযোগ কম থাকে। প্রতিদিন কথা বললে একটি মিথ্যা কথা ঢাকতে অনেক মিথ্যা কথাও বলতে হয়। আর আমি প্রতিদিন কথা বলবো, আমাদের দলের অন্য নেতারা সুযোগ পাবেন না- এটা তো ঠিক নয়। সভায় সৈয়দ আশরাফ আরও বলেন, এবার বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ থেকে ৪০ দিনব্যাপী কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। আমরা চাইছি সব দল ও সংগঠন এবং গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী পালন করবে। কেননা বঙ্গবন্ধু কেবল আওয়ামী লীগের নয়, দেশের সব মানুষের জাতির পিতা। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র মতো আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও শাহাদাতবাষির্কী এখনও সার্বজনীন হতে পারেনি। তবে ইতিহাস কখনও এক জায়গায় স্থির থাকে না। একদিন আমরাও হয়তো বা আমাদের জাতির পিতাকে সার্বজনীন করতে পারবো, সবাই মিলেই তাঁর জš§ ও শাহাদাতবার্ষিকী পালন করতে পারবো। গণমাধ্যমকে সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, সব সময়ের মতো সরকার এখনও গণমাধ্যমের পাশে রয়েছে। আমরা চাই স্বাধীন ও সার্বভৌম সাংবাদিকতা। আর গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যে কোন হামলা-মামলা ও নির্যাতনের বিষয়ে কোন সহযোগিতার প্রয়োজন পড়লে সরকার অবশ্যই তা করবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুই হচ্ছেন একটি ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনদিনই আসতো না। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, দেশের স্বাধীনতা। গণমাধ্যমের প্রতি তাই অনুরোধÑ জাতির পিতার মতো মহাপুরুষের দীর্ঘ ত্যাগ ও সংগ্রামী জীবনের কথা দেশের নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরুন। শুধু লেখনীর মাধ্যমেই নয়, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমেও ছোট ছোট শিশুদের সামনে বঙ্গবন্ধুর আমরর্কীতি তুলে ধরতে হবে। সাংবাদিকরা যা বলেন ॥ মতবিনিময় সভায় সিনিয়র সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে সার্বজনীন করা এবং বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে জাতীয়ভাবে পালনের পক্ষে মতামত দেন। এজন্য আওয়ামী লীগকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচী ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচার দেখে মনে হয় তিনি কেবলই আওয়ামী লীগের সম্পত্তি। বঙ্গবন্ধুকে কোন দলের একক সম্পদ হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবে না। বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতির সম্পদ। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও শাহাদাতবার্ষিকী জাতীয়ভাবে পালন করতে হলে আওয়ামী লীগকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে মানুষের আত্মার আত্মীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। প্রয়োজনে জামায়াত ছাড়া সব রাজনৈতিক দল থেকে নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় কমিটি করে একটা ঐতিহাসিত ‘ইভেন্ট’ করারও পরামর্শ দেন তারা সমকালের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের সকলের চেতনা। তিনি কোন দলের সম্পদ নয়, সমগ্র জাতির সম্পদ। যে মিথ্যা ধারণা বঙ্গবন্ধু সম্পর্র্কে এতদিন দেয়া হয়েছিল, সেটি এখন কাটতে শুরু করেছে তা জেনে আমরা আনন্দিত। আমরা শৃঙ্খলিত গণমাধ্যম নয়, সুশৃঙ্খল গণমাধ্যমের ভূমিকা রাখতে চাই। তিনি উত্তরা ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী আমলাতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য সৈয়দ আশরাফের প্রতি আহ্বান জানান। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবেদ খান পোস্টার-ফেস্টুনসহ নানা স্থানে বঙ্গবন্ধুর ছবি যথেচ্ছ ব্যবহারের সমালোচনা করে বলেন, যেভাবে বঙ্গবন্ধুর ছবিকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে আমাদের কষ্ট লাগে। এটি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আর আওয়ামী লীগই যাতে সরকার পরিচালনা করতে পারে, সরকার নয়Ñ এটিও নিশ্চিত করতে হবে। ডিইউজে সভাপতি আলতাফ মাহমুদও বঙ্গবন্ধুর ছবি যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন প্রণয়নের দাবি জানান। মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সার্বজনীন অনুষ্ঠান করা যাচ্ছে না শুধুমাত্র রাজনীতির কারণে। বঙ্গবন্ধুকে শুধু আওয়ামী লীগের সম্পত্তি করা হলেই সমস্যা। বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামী লীগের সম্পত্তি হতে পারে না। তিনি সমস্ত বাঙালী জাতির সম্পদ। এখন শুধু দলের পোস্টার-ব্যানারেই নয়, বাজার কমিটিতেও বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব করে পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুকেই ছোট করা হচ্ছে। বিএফইউজের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকলে মুসলিম লীগের মতো অনেক বড় দলও হারিয়ে গেছে। তাই দল ও সরকার যেন এক হয়ে না যায় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ এখন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাই সরকারের সব অর্জনগুলো দলের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। কালের কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, বঙ্গবন্ধুকে শুধু ১৫ আগস্টের শোক দিবসের মধ্যে সীমাবন্ধ না রেখে সারাবছর বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যমে তাকে স্মরণ করতে হবে। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে ভালভাবে জানাতে পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুকে ভালভাবে তুলে ধরতে হবে। সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতীয় সম্পদ। তাই তার মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য একটি জাতীয় কমিটি করতে হবে। যেখানে সব রাজনৈতিক দলের নেতারা থাকবেন। সেখানে সকল শ্রেণী পেশার মানুষেকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালনের নামে যাতে কোন চাঁদাবাজি না হয় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী দলের নেতাকর্মীদের বেশি করে পাঠ করার ব্যবস্থা করতে হবে এতে তারা বঙ্গবন্ধুর মতো আদর্শবাদী হয়ে উঠবে। জনকণ্ঠের উপ-সম্পাদক ওবায়দুল কবির দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের যোগাযোগ বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়ে বলেন, দলের মাঠের নেতারা আওয়ামী লীগের অনেক সিদ্ধান্তের কথা জানে না, সাংবাদিকরাও সঠিক তথ্য জানতে পারে না শুধু দলীয় মুখপাত্রের অভাবে। এটি দ্রুতই ঠিক করা দরকার। এ মতবিনিময় সভায় সিনিয়র সাংবাদিকদের মধ্যে আরও বক্তব্য ও উপস্থিত ছিলেনÑ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, সমকালের প্রকাশক এ কে আজাদ চৌধুরী, সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মনিরুজ্জামান, ইনকিলাব সম্পাদক এম এম বাহাউদ্দিন, একাত্তরের মোজাম্মেল হক বাবু, যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, সময় টেলিভিশনের আহমেদ জুবায়ের, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের খালেদ মুহিউদ্দিন, আরটিভির মোর্শেদ আলম এমপি, বাংলাভিশনের মোস্তফা ফিরোজ, যমুনা টেলিভিশনের জাকারিয়া কাজল, এটিএন নিউজের মুন্নী সাহা, দেশ টিভির অলোক গুপ্ত, প্রমুখ। আওয়ামী নেতাদের মধ্যে দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আহমদ হোসেন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, বিএম মোজাম্মেল হক, ড. হাছান মাহমুদ, ফরিদুন্নাহার লাইলী, এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, অসীম কুমার উকিল, এস এম কামাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
×