ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিসরের প্রতি সৌদি ভূমিকা কি বদলে যাচ্ছে!

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২৩ জুলাই ২০১৫

মিসরের প্রতি সৌদি ভূমিকা কি বদলে যাচ্ছে!

সম্প্রতি উইকিলিকস সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যেসব কূটনৈতিক তারবার্তা ফাঁস করেছে, তাতে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইরান, সিরিয়া ও ইয়েমেনের প্রতি সৌদি আরবের নীতির ধারাবাহিকতার পরিচয় পাওয়া গেলেও মিসরের বেলায় তা ছিল না। রিয়াদের মিসরনীতির অদল-বদল হয়েছে। তার প্রমাণ, মিসরে ২০১১ সালের অভ্যুত্থান এবং পরবর্তীকালে মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্ষমতায় উত্থানের প্রতি সৌদি আরবের বৈরী মনোভাব। তাই দেখা যায় ২০১৩ সালে সামরিক জান্তার হাতে প্রেসিডেন্ট মুরসির ক্ষমতাচ্যুতিকে সমর্থন দিয়েছে রিয়াদ। তখন অবশ্য সৌদি বাদশাহ ছিলেন আবদুল্লাহ। তাঁর মৃত্যুর পর এ বছরের গোড়াতে সৎভাই সালমান বাদশাহ হওয়ার পর সৌদি ভূমিকায় পরিবর্তন এসেছে। একটি দৃষ্টান্তই সেই পরিবর্তনকে দেখিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ব্রাদারহুডের প্রতি আগের সেই সৌদি বৈরিতা আর নেই। মিসরে গত দু’বছর ধরে ব্যাপক দমনপীড়ন চলছে মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর। এই দমনপীড়ন বন্ধ করতে হলে জেনারেল সিসির সঙ্গে ব্রাদারহুডের একটা সমঝোতায় আসা দরকার। প্রবাসী অনেক ব্রাদারহুড নেতা সেই সমঝোতায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সৌদি আরবকে কামনা করছেন। উইকিলিকসের ফাঁস করা সৌদি পররাষ্ট্র দফতরের মেমো এবং কায়রোর সৌদি দূতাবাসের তারবার্তাগুলো থেকে দেখা যায় যে, রিয়াদ মিসরের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ওপর দৈনন্দিন নজর রাখত। তারবার্তাগুলোতে মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানে হুঁশিয়ারি সঙ্কেত থাকলেও বক্তব্যের সুর থেকে এই সংগঠনটি সম্পর্কে এক ধরনের আচ্ছন্নতাও প্রকাশ পায়। একটি তারবার্তায় কায়রোর দূতাবাস থেকে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল-ফয়সলকে মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যবসায়ী হাসান মালেকের বিস্তারিত পরিচয় দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট ও ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য মুরসি ২০১২ সালে তাঁকে নিয়োগ করেছিলেন। তারবার্তার শব্দাবলী ছিল লক্ষণীয়ভাবে সতর্ক। ওতে বলা হয়, মিসর সরকারের ‘দাবি’, মালেক ১৯৯২ সালে সরকারের কম্পিউটার ব্যবস্থা হ্যাক করার পরিকল্পনায় সক্রিয় ছিলেন। তারবার্তাগুলোতে ব্রাদারহুডের শক্তমানব খয়রাত আল-শাতেরের ব্যাপারেও রিয়াদের আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। তারবার্তায় তার পরিচিতি রয়েছে। তাঁকে সেখানে ব্রাদারহুডের প্রকৃত নেতা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং সর্বোচ্চ নেতাকে দুর্বল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কায়রোয় সৌদি রাষ্ট্রদূত আহমেদ কাত্তান স্বাক্ষরিত এক তারবার্তায় আল-শাতেরের সঙ্গে সংলাপ শুরু করার অনুমতি চেয়ে বলা হয় ‘ইনি হবেন মিসরের রাজনৈতিক অঙ্গনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব।’ তারবার্তাগুলো থেকে জানা যায় যে, এক হাজার কোটি ডলারের বিনিময়ে মোবারককে মুক্তি দেয়ার জন্য এক অজ্ঞাতনামা মিসরীয় কর্মকর্তা আল-শাতেরের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শাতের প্রস্তাবটিতে রাজিও হয়েছিলেন। এক হাজার কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল উপসাগরীয় দেশগুলোর। ব্রাদারহুডের সুরা পরিষদকে উদ্দেশ্য করে সংগঠনের তরুণ সদস্যদের লেখা ৭ পৃষ্ঠার এক অভ্যন্তরীণ মেমো সৌদি পররাষ্ট্র দফতরের হাতে যায়। কিভাবে যায় তা স্পষ্ট নয়। মেমোর অনেক অপূর্ণতা ছিল। তবে ওতে ২০১১ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় সংগঠনের নেতৃত্ব ও তরুণ সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল কিভাবে শুরু হয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ আছে। মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই ব্যবধান আরও বেড়ে যায়। পরিণতিতে কিছু সদস্য পদত্যাগ করেন কিংবা তাদের সাসপেন্ড করা হয়। অন্যান্য তারবার্তায় সিনাই পরিস্থিতির পরস্পরবিরোধী মূল্যায়ন আছে। ২০১৪ সালের এক ই-মেইলে বলা হয় যে সিনাহিয়ের জিহাদী ও গাজার সালাফিদের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত এবং তারা মিসর সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ‘এক নতুন মিসরীয়-মার্কিন সমঝোতার’ কথা উল্লেখ করা হয়। ২০১৪ সালের এক ই-মেইলে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি কাতারের সমর্থনকে কেন্দ্র করে রিয়াদ ও দোহার মধ্যে সৃষ্ট সংঘাত সম্পর্কে খানিকটা আঁচ পাওয়া যায়। কাতারের আলজাজিরা টিভিতে মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে সংবাদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হচ্ছিল। উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদে (জিসিসি) বড় ধরনের ফাটল ধরার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এটাই। এই ফাটল মাসের পর মাস স্থায়ী হয় এবং শেষে ২০১৪ সালের নবেম্বরে এর অবসান হয়। অবসান ঘটার পেছনে যে বিষয়টা কাজ করেছিল, তা হচ্ছে জিসিসি দেশগুলোর কাছে কাতারের এই মর্মে এক ঘরোয়া ও লিখিত অঙ্গীকার যে, আলজাজিরা কেন্দ্রের সম্পাদকীয় নীতি বদলানো হবে। কিন্তু যখন তা বদলাল না তখন ফাটল আগের মতোই চলতে লাগল- যদিও তা প্রকাশ্যে নয়। ই-মেইলে বলা হয়, চ্যানেলটি এখনও মিসরীয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে, সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছে, সন্ত্রাসবাদী মুসলিম বাদারহুডকে সমর্থন দিচ্ছে এবং তাদের রাজপথের আধিপত্যকারী শক্তি হিসাবে চিত্রিত করছে। এর জবাবে মিসরের অনেক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আলজাজিরার বিরুদ্ধে মিডিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তথ্যগুলো ফাঁস হওয়ায় সরকার অনুগত সাংবাদিক মোস্তফা বাকরির জন্য বিব্রতকর হয়েছে বলে একটি তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়। সৌদি সংস্কৃতিমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে পাঠানো সেই বার্তায় কায়রোর সৌদি রাষ্ট্রদূত জানান যে, সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় ইরানীরা তাঁর সঙ্গে এবং অন্যান্য মিসরীয় মিডিয়া ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ওতে বলা হয়, বাকরি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যার মধ্যে ছিল সৌদিদের আর্থিক সাহায্যে তার সাপ্তাহিক পত্রিকা আল-ওসবুকে দৈনিকে রূপান্তরিত করা, একটা রাজনৈতিক দল গঠন করা ও একটা টিভি স্টেশন খোলা, যা কিনা শিয়াদের বিরুদ্ধে সৌদিনীতির পক্ষে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে। তারবার্তায় বাকরিকে শাসক এসসিএএফএর ঘনিষ্ঠজন এবং পার্লামেন্ট সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়। মিসর-ইরান সম্পর্কে বরফগলা শুরু হওয়ার ব্যাপারে সৌদি আরবের উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও সৌদিরা বাকরির প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সোদি আল ফয়সল স্বাক্ষরিত এবং সৌদি রাজদরবারের প্রধান খালেদ আল-তুয়াইজিরিকে উদ্দেশ করে পাঠানো ২০০৯ সালের তারবার্তায় তৎকালীন ইরানী পার্লামেন্টের স্পীকার আলী লারিজানির মিসর সফরের পরিপ্রেক্ষিতে কায়রো ও তেহরানের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর তীক্ষè নজর রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। আল ফয়সল ওতে উল্লেখ করেন যে, লারিজানির পর তিনি কায়রো সফরে গিয়েছিলেন এবং মিসরীয়রা তখন তাকে এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছিল যে, মিসরের ইরাননীতিতে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তারা লারিজানির সফরের গুরুত্বকে খাটো করে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। মিসরের মিডিয়ার ওপর সৌদি প্রভাব আদৌ উল্লেখ করার মতো কোন খবর নয়। তারপরও এটা বিস্ময়কর যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আল ফয়সলের মতো ব্যস্ত একজন মানুষ রাষ্ট্র পরিচালিত আল-আকবর পত্রিকায় ব্যঙ্গরচনা লেখক আহমেদ রাগাবের লেখা নিয়ে বাহ্যত ভুল বোঝাবুঝি ব্যাখ্যা করার মতো সময় দিয়েছেন। সৌদি সংস্কৃতিমন্ত্রীর কাছে পাঠানো ক্লাসিফাইড হিসাবে চিহ্নিত তারিখবিহীন একটি তারবার্তায় আল ফয়সল সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন, কিভাবে তিনি সাবেক মিসরীয় পুরাকীর্তি মন্ত্রী জাহি হাওয়াসের কাছ থেকে জেনেছিলেন রাগাবের কলামে মিসরকে আর্থিক সাহায্য সমর্থন না দেয়ার জন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সমালোচনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়েছিল রিয়াদকে। তবে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পরোক্ষভাবে দোহার সমালোচনা করা। কায়রোর সৌদি দূতাবাস থেকে ২০১২ সালে রিয়াদে পাঠানো ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ একটি মেমোতে এক কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার আঁচ পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে, সে সময় মিসর বিদেশী অর্থ গ্রহণের জন্য এনজিও কর্মীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিল। আসলে এটা মিসর কর্তৃপক্ষের একটা চাতুরি, যাতে করে মিসরকে সামরিক সাহায্য কাটছাঁট করতে ওয়াশিংটনকে চাপে ফেলা যায়। ওয়াশিংটন এমন কিছু করলে মিসর তখন সেটাকে মিসর-ইসরাইল শান্তিচুক্তি লঙ্ঘন হিসাবে তুলে ধরতে পারবে এবং তার সুযোগ নিয়ে মিসর সেই চুক্তি বাতিলও করে দিতে পারবে। শুধু তাই না, কায়রো ইসরাইলকে গ্যাস রফতানি বন্ধ করে দেয়ার সুযোগ পাবে এবং এই চাপে ফেলে সিনাইয়ে মিসরের সামরিক উপস্থিতি সীমিত করে শান্তিচুক্তিতে যেসব ধারা রাখা হয়েছিল, সেগুলো নতুন করে রচনা করতে পারবে। তারবার্তায় এমনও বলা হয় যে, সে সময় সিনাইয়ের উত্তরাঞ্চলে গ্যাস পাইপ-লাইনে যে বার বার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছিল, সেগুলো ছিল মিসর সরকার বা সেনাবাহিনীর কাজ। সূত্র : আল-আহরাম উইকলি
×