ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের আমেজ এখনও

বন্ধন সুদৃঢ় করার উৎসব, আবেগ ভালবাসার স্ফুরণ

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৩ জুলাই ২০১৫

বন্ধন সুদৃঢ় করার উৎসব, আবেগ ভালবাসার স্ফুরণ

মোরসালিন মিজান ॥ আমার পাগলা ঘোড়ারে কই থাইকা কই লইয়া যাস...। আসলেই মানুষের এখন পাগলা ঘোড়ার জীবন। ছুটে চলেছে। বেদম। কাজ আর কাজ নিয়েই থাকতে হয় শুধু। আর যেটুকু ফুরসত- নিজের জন্য তুলে রাখা চাই। এসব বাস্তবতার বাইরে আছে আলসেমী, আত্মকেন্দ্রীকতার মতো বালাই। বিশেষ করে শহুরে জীবন এসব বালাই দ্বারা আক্রান্ত। তবে ঈদ অদ্ভুত এক উৎসবের নাম। এ উৎসব বদলে দেয় অনেক কিছু। পুরনো চর্চা থেকে বের করে আনে। এবারের ঈদেও তাই হয়েছে। ঈদের লম্বা ছুটি কাজে লাগিয়েছেন প্রায় সবাই। পরিবারকে সময় দিয়েছেন। প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। সারা বছর যে সম্পর্কটির খোঁজখবর করা যায়নি, দারুণ যতœ করছেন সেটিরও। এভাবে বন্ধনগুলো দৃঢ় হয়েছে। মানবিকতা আর ভালবাসার বোধগুলো প্রস্ফুটিহ হয়েছে ফুলের মতো। ঈদে সরকারী ছুটি ছিল তিন দিনের। সেইসঙ্গে যে যার মতো বাড়তি যোগ করেছেন। যেটুকু অবসর, পুরোটা নিয়ে ছুটে গেছেন গ্রামে। ট্রেনের টিকেটের জন্য ভোর রাত থেকে অপেক্ষা, বাসে পেছনের সিট, লঞ্চের ডেকে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকা। তার পর বাড়ি। প্রিয়জনের মুখটি দেখা। আবেগে জড়িয়ে ধরা। এই আবেগ এই ভালবাসাবাসীর দুর্লভ সুযোগটি করে দিয়েছে ঈদ। শুধু কি মানুষে মানুষে দেখা? বাড়ির সামনে নিজ হাতে লাগানো গাছে পেয়ারা ধরেছে, মুগ্ধতা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকা। পেড়ে খাওয়া। এক ডুবে পুকুর পার। এ মাথা থেকে ও মাথা। বাড়ি থেকে বাজারে যাওয়ার সাঁকোটি এখন কালভার্ট। সেখানে বসে শৈশবের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। সবই সম্ভব করেছে ঈদ। ছুটি শেষে সোমবার বরিশাল থেকে কর্মস্থল ঢাকায় ফিরেছেন আশিকুর রহমান। একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেন তিনি। বয়সে যুবক। সদরঘাটে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বলেন, সারা বছর ব্যস্ত থাকি। চাইলেই গ্রামে যেতে পারি না। অথচ বাবা মা থেকে শুরু করে প্রিয় যত মুখ, সবাই থাকেন গ্রামে। ঈদে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সাকুল্যে চারদিন ছিলাম। অথচ প্রেম ভালবাসায় পূর্ণ হয়ে ফিরেছি। ফিরতে মন চায় না। কিন্তু ফিরতে তো হবেই। এখন ঢাকায়ও বহু মানুষ ঈদ করেন। স্থানীয়দের পাশাপাশি, অসংখ্য মানুষ শহরটিকে আপন করে নিয়েছেন। ঈদের দিন মোটামুটি আপন গৃহেই কাটিয়েছেন ঢাকার মানুষ। সারা বছর ব্যস্ত থাকার কারণে ঘরের সঙ্গে খুব বেশি ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ তাঁরা পান না। সে সুযোগ করে দিয়েছিল ঈদ। ফলে অনেক বিচ্ছিন্নতা দূর হয়ে গেছে। জং ধরা সম্পর্কগুলো ঝালাই করার চেষ্টা করেছেন অনেকে। ঈদে স্বামী স্ত্রী সন্তানÑ সবাই সবার খুব কাছে থাকার চেষ্টা করছেন। যে গৃহকর্তা ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই কর্মস্থলের উদ্দেশে ছুট দেন, সেই তিনি স্ত্রীর সঙ্গে রান্না ঘরে গিয়েছেন। সন্তানকে নিজ হাতে নতুন পোশাক পরিয়ে দিয়েছেন। গৃহকর্তী স্বামী সন্তানের পছন্দের খাবার তৈরি করেছেন নিজ হাতে। সকলে একসঙ্গে বসে খেয়েছেন। টিভিতে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা উপভোগ করেছেন। ঈদে চাকরিজীবী বাবা মাকে অধিক সময়ের জন্য পেয়েছে সন্তানরা। তাতেই আনন্দ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। যৌথ পরিবারগুলোতে সদস্য সংখ্যা বেশি হয়। সবার সঙ্গে সবার দেখা হয় না প্রতিদিন। দেখা হলে কথা হয় না। ঈদে তাঁদের মধ্যে চলেছে মেরাথন আড্ডা। চাচাত মামাত ভাই বোনদের উপস্থিতিতে কোন কোন পুরনো বাড়ি বিয়ে বাড়ির চেহারা পেয়েছে। ঢাকা যাদের আত্মীয় পরিজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তাঁরাও পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। একে অন্যের বাসায় অতিথি হয়েছেন। অনেক বাসার সামনে লম্বা সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে অতিথিদের গাড়ি। গৃহকর্তা গৃহকর্তী তাঁদের বিদায় জানাতে নিচে নেমে এসেছেন। ঈদের দ্বিতীয় দিন এমন একটি দৃশ্য চোখে পড়ে মনিপুরি পাড়ায়। একটি পাঁচতলা পুরনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ে, মেয়ের জামাই ও নাতিকে বিদায় জানাচ্ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা সিরাজ উদ্দীন ও তাঁর স্ত্রী ফরিদা খাতুন। ফরিদা নাতিকে কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত আসেন। ততক্ষণে গাড়ির দরজা খুলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সিরাজ উদ্দীনকে। গাড়ি মূল রাস্তায় ওঠার পর ছোট্ট আলাপচারিতায় তিনি বলেন, আমার একটিই মেয়ে। বিদেশে থাকে। বহু বছর পর ঈদ করতে ঢাকায় এসেছে। ঈদের দিন শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কাটিয়ে নাতিকে নিয়ে এসেছে বাবার বাড়ি। মেয়েকে কাছে পাওয়া, ফুটফুটে নাতিকে আদর করতে পারাটাই তাঁর কাছে ঈদ বলে জানান সিরাজ উদ্দীন। নিকট আত্মীয়দের পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গেও চমৎকার সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয় ঈদ। প্রিয়জন বন্ধুজনরা মিলে মজা করে শহর ঘুরে বেড়িয়েছেন। ফাঁকা রাস্তা, পার্ক, খোলা উদ্যান, রেস্তোরাঁয় দেখা গেছে এমন দৃশ্য। ঈদের তৃতীয় দিন বিকেলে বসুন্ধরা শপিংমলের ফোটকোর্টে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে বসেছেন সমবয়সীরা। খাবার ঠা-া হচ্ছে। কিন্তু আড্ডা গরম। বহুদিনের জমানো কথাগুলো হচ্ছে। পৃথক দুটি টেবিল একত্রিত করে বসেছিলেন একদল যুবক। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সবাই ঢাকায় থাকেন। তবে একেকজন একেক পেশায়। সবাই একসঙ্গে ছুটি পান না। শুক্রবারেও অনেকের কাজ থাকে। তবে ঈদের ছুটিটা সবার। একইসঙ্গে। বিশেষ সুযোগটা তাই হাতছাড়া করেননি। আমিনুল নামের এক বন্ধু পেশায় ব্যাংকার। বললেন, অন্য সময় এত বেশি ব্যস্ত থাকি যে, বাসায়ও পর্যাপ্ত সময় দিতে পারি না। বন্ধুদের দেব কিভাবে? শামীম নামের আরেক বন্ধু কলেজে পড়ান। বললেন, আমার সময় আছে। কিন্তু এই সময়ের সঙ্গে বাকিদের সময় মিলে না। হাবিব নামের বন্ধুটি ব্যবসায়ী। বেশিরভাগ সময় থাকেন বিদেশে। তাঁর কথাটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। বলেন, খুব করে চাইলে আপনি হয়ত অবসর সময় বের করতে পারবেন। সবাই মিলিত হতে পারবেন। কিন্তু অবসর আর ঈদ এক ব্যাপার নয়। ঈদে মানসিক প্রস্তুতিটাই থাকে অন্যরকম। মন নরম হয়ে যায়। যত সুখ স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। প্রিয়জনকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। সুন্দর এই আবেগ আর আকুতির জোরালো বহির্প্রকাশ ঈদ।
×