ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ কার্ডের আবেদন ফুরোয়নি আজও

যত্নে গড়া শিল্পকর্ম- প্রিয়জনের স্পর্শে ভোলায় বিচ্ছিন্নতা

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৫ জুলাই ২০১৫

যত্নে গড়া শিল্পকর্ম- প্রিয়জনের স্পর্শে  ভোলায় বিচ্ছিন্নতা

মোরসালিন মিজান হ্যাঁ, পুরনো হয়েছে ঈদকার্ড। ব্যবহার কমেছে। তবে আবেদন ফুরোয়নি। এখনও কী সুন্দর এক একটি কার্ড! যতেœ গড়া। ভালবাসায় ভরপুর। হাতে নিলে মন সত্যি ভাল হয়ে যায়। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগেও মাধ্যমটি কাজে লাগিয়ে অনেকেই প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। বড় উৎসব অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে চোখের আড়ালে থাকা প্রিয়জনদের খুব মিস করে মানুষ। আর ঈদ তো ঈদ-ই। এ সময় বহু দূরের প্রিয়জনকে নিভৃতে স্মরণ করা হয়। পরস্পরের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার চেষ্টা চলে। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে বন্ধুজন ও শুভানুধ্যায়ীরা একে অপরকে বিশেষ এক ধরনের চিঠি লেখেন। চিঠিটি ঈদকার্ড নামে পরিচিত। অনন্য সুন্দর এ শিল্পকর্মের মাধ্যমে ছোট ছোট কথায় ভাব-ভালবাসা বিনিময় করা হয়। এ রীতি বহুদিনের পুরনো। এখনও আবেদন ফুরোয়নি। রঙিন খামের গায়ে সুগন্ধী কালি দিয়ে ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে দূর-দূরান্তে। মামুলিকার্ড। তাতে প্রিয়জনের ছোঁয়া থাকে। ঈদকার্ড তাই বিচ্ছিন্নতার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। প্রিয়জন পরিচিতজন স্বজন-সুহৃদরা পরস্পরের মধ্যে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। এখানেই শেষ নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার টানাপোড়েনের সম্পর্কটিও অনায়াসে ভুলিয়ে দিচ্ছে শুভেচ্ছা বিনিময়ের অনন্য এ মাধ্যম। শত বৈরিতার মধ্যেও আসন্ন ঈদে দুই নেত্রী পরস্পরকে ঈদকার্ড পাঠিয়েছেন। উভয়ে উভয়ের জন্য শুভ কামনা করেছেন। আনন্দঘন ঈদ প্রত্যাশা করেছেন। এখানেই ঈদকার্ডের আসল সৌন্দর্য। একই কারণে হারিয়ে যায়নি ঈদকার্ড। ঢাকার বিভিন্ন গিফটশপ ঘুরে আর সব কেনাকাটার পাশাপাশি অনেকেই ঈদকার্ড কিনছেন। দোকানগুলোও সাজিয়েছে ঈদের পসরা। রাজধানীর পুরানা পল্টন, নিউমার্কেট, ধানম-ি, বসুন্ধরা সিটি শপিংমল, এ্যালিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুলসহ বিভিন্ন এলাকার গিফটশপ ঘুরে দেখা যায় এমন দৃশ্য। কার্ডের গায়ে নানা রকম লতাপাতা ফুলের নকশা করা। পাখি প্রজাপতি ইত্যাদি আঁকা। ফুলের গায়ে, প্রজাপতির ডানায় উজ্জ্বল পাথর পুঁতি জরি বসিয়ে নতুন মাত্রা যোগ করা হয়েছে। কোন কোন ঈদকার্ডে বাংলা, ইংরেজী ও আরবী ভাষায় লেখা হয়েছেÑ ঈদ মোবারক। কোনোটির গায়ে আঁকা আছে মসজিদের ছবি। শক্ত কাগজ কেটে চমৎকার নকশা করা হয়েছে কিছু কার্ডে। আকারও তিনটি। ছোট বড় এবং মাঝারি। বিশাল আকারের কিছু কার্ড আছে। দুই হাতে মেলে ধরতে হয়। কোনটি থেকে সুগন্ধ ছড়ায়। কোনটিতে হাত ছোঁয়ালে আলো জ্বলে। মিষ্টি সুর বেজে ওঠে কোন কোনটির বেলায়। অধিকাংশ গিফটশপে ঈদকার্ড থাকলেও আর্চিস গ্যালারি, হলমার্কসহ কিছু ব্র্যান্ডের আলাদা সুখ্যাতি আছে। বিদেশী হলেও গিফটশপ দুটির সঙ্গে বহু দিনের জানাশোনা বাংলাদেশের মানুষের। মঙ্গলবার হলমার্কের হাতিরপুলের শোরুমে গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতীয় তলার একটি অংশ গ্রিটিংস কার্ডে সাজানো। বিশেষ উঁকি দিয়ে আছে ঈদকার্ডগুলো। একটি কার্ড হাতে নিয়ে দেখা যায়, এর চারপাশে জরি লতাপাতা আঁকা। জরি বসানো। মাঝখানটায় ইংরেজীতে লেখাÑ ‘ঈদ ইজ টাইম টু ওয়েলকাম ব্রাইট এ্যান্ড সানি ডেজ দ্যাট উইল ফুলফিল অল ইউর ফেভারিট ড্রিমস এ্যান্ড ফিল ইউর লাইফ উইথ ওয়ান্ডারফুল মোমেন্টস।’ লাল গোলাপের প্রচ্ছদে আরেকটি ঈদকার্ড। এখানে বলাটি এ রকমÑ ‘ফ্লাওয়ারস শ্যাল স্পিক অল দৌজ থিংস হুইচ মিয়্যার ওয়ার্ডস আর আনএ্যাবল টু এক্সপ্রেস।’ এভাবে ছোট ছোট কথা। মিষ্টি উচ্চারণ। প্রিয়জনের জন্য। শোরুমের কর্মী আবদুল হকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঈদে ২০টির মতো নতুন ডিজাইন এসেছে। দাম ১০০ থেকে ৭৭৫ টাকা পর্যন্ত। চাহিদা কেমন? জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ঈদে কার্ড বিনিময় তো অনেক কাল আগের সংস্কৃতি। এর প্রতি একটি দুর্বলতা এখনও আছে। রমজানের এক সপ্তাহ পর থেকেই ঈদকার্ড বিক্রি শুরু হয়ে যায়। মুখে যে কথাটি বলা যায় না তা কার্ডের মাধ্যমে বলা হচ্ছে। আগের তুলনায় বিক্রি কমলেও, আবেদন এতটুকু কমেনি বলে জানান তিনি। কাছাকাছি দূরত্বেই আর্চিসের একটি শোরুম। এখানেও নানা ডিজাইনের ঈদকার্ড। বেশ কয়েকটি কার্ডের গায়ে মসজিদের নক্সা। যথারীতি আছে লতাপাতা, ফুল। হ্যান্ডমেড কিছু ঈদকার্ডও দেখা গেল এখানে। কার্ডগুলো হাতে নিলে রেখে আসা কঠিন হয়ে যায়। প্রতিটি কার্ডের দাম ২৮৫ টাকা। শোরুমটির দায়িত্বে থাকা শুভ জানালেন, ঈদকার্ড বিনিময়ের সংস্কৃতি এখনও আছে। বিক্রিও ভাল। যারা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার একটু বাইরে দিয়ে হাঁটেন, প্রিয়জনকে আন্তরিকভাবে দু’কথা বলতে চান, তারা এখনও ঈদকার্ড কেনেন। পুরনো পল্টনের দোকানগুলোতেও এখন ঈদকার্ডের পসরা। এক সময় আজাদ প্রোডাক্টসের ঈদকার্ড না হলে ঈদের আনন্দ অপূর্ণ থেকে যেত। এখন সে অবস্থা নেই। তবে ঈদকার্ড সাজানো। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ইকবাল হোসেন জানান, তাঁরা এখন মূলত বিয়ের কার্ড করেন। ঈদ সামনে রেখে করা হয় ঈদকার্ড। এবার ১৫টির মতো নতুন ডিজাইন করা হয়েছে বলে জানান তিনি। দাম অপেক্ষাকৃত কম। ১৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। আইডিয়াল প্রোডাক্টসের শোরুমেও দেখা গেল ঈদকার্ড। দাম প্রায় অভিন্ন। ম্যানেজার নজরুল ইসলাম জানালেন, ঈদকার্ডের প্রচলনটা ধরে রেখেছে মূলত কর্পোরেট হাউসগুলো। এসব হাউসের পক্ষ থেকে ঈদকার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানানো হয়। আর সাধারণ মানুষ? কারা কেনেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা একটু সুরুচির তারা ঈদকার্ড কিনতে আসেন। শেষ করা যাক হলমার্কের প্রসঙ্গ টেনে। এখানে ঈদকার্ড কিনতে এসেছিলেন আনিসুল ইসলাম ও ফাহমিদা হোসেন দম্পতি। একজন ডাক্তার। অন্যজন প্রকৌশলী। দুজনই নীরবে কার্ড দেখছিলেন। এই যুগে কি কার্ডের কোন আবেদন আছে? এমন প্রশ্নে ডাক্তার স্বামী বললেন, ঈদ কার্ড তো ঐতিহ্যের অংশ। প্রতিটি কার্ডের গায়ে চমৎকার সব কথা লেখা থাকে। যেন প্রার্থনা সঙ্গীত। প্রিয়জনের মঙ্গল কামনা করে এই যে প্রার্থনা তা কেবল ঈদকার্ডেই আন্তরিক মনে হয়। ইঞ্জিনিয়ার পতœী একটু লাজুক ধরনের। মুখে কিছু বললেন না। একটি কার্ড দেখিয়ে দিলেন। কার্ডের গায়ে লেখাÑ উইথ লাভ ক্যান সে হুয়াট ওয়ার্ডস ডোন্ট শো ইন মেনি, মেনি ওয়েজ।’
×