ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দাউদ হায়দার

রশীদ হায়দার : ৭৫

প্রকাশিত: ০৫:১২, ১৫ জুলাই ২০১৫

রশীদ হায়দার : ৭৫

‘জমিদার হাকিমউদ্দিন শেখ ও তাঁর দুই নম্বর বৌ রহিমা খাতুনের দ্বিতীয় ছাওয়ালের নাম দুলাল, আল্লাহ হায়াতদরাজ করলি ছাওয়ালডা বাপের নাম ফিলাগে (ফ্ল্যাগ) উড়াবি। সেদিন দেখলেম কলেজ তেন বারায়ে চারডে হুরির সাথে গপ্পো মারতি-মারতি যাচ্ছে, আমাক দেখে চাচাও কোলে না, ছালামও দিলে না। রাজপুত্তর বলে কতা।’- এরকম বয়ানই নাকি শুনেছেন পাড়াতুতো ফুফাতো মগরেব, পাবনার বড় মসজিদের জুমার নামাজের পরে, এক মুসল্লির কণ্ঠে বলছিলেন, আমাদের বড় পুকুরের ইটে-বাঁধানো ঘাটে, ছোটরা শুনছিলুম সন্ধ্যালগ্নে। পাবনার ডায়লগে তাঁর আরও কথা : ‘রোফের (জিয়া হায়দার) মতো দুলালও সন্ধে হলি শহরে হল্ডুক মারবের যায়, নাটক-গানবাজনা-সাহিত্য লিয়ে কালচার করে। গোরস্থানের ভূতরা একদিন ঘাড় মটকালি টের পাবিনি। এত মিয়ে লিয়ে ঘোরাঘুরি কি কামে, অ্যাকটাক বিয়ে করলিই হয়। ঘটকালির যন্যি গনি ডাক্তার তো আছেই। দরকার হলি হোমিপক্কি (হোমিওপ্যাথি) অ্যাক ডোজ খাওয়ায়ে দিবিনি। দুলালের উড়ু উডু মন আমার ভাল্লাগে না।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। উদাস হন। বুঝলুম, নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা মন রে মোর, পাথারে হোস নে দিশেহারা। .... দুলালকে এত গুঞ্জরণ তবে? কই, আমরা তো শুনি না। শুনবোই-বা কী করে। বড়দের নিয়ে ছোটদের সামনে কেউ টুঁ শব্দ করেন না। এই কালচার দোহারপাড়ার বাড়িতে নেই। যমের চেয়েও ভয়ঙ্কর দুলাল, কলেজ থেকে ফিরে, দেখলেই পড়া ধরেন, তাও আবার ইংরেজী। পালিয়ে বেড়াই, দৃষ্টি এড়াই। আমাদের অগ্রজ দুলাল, রশীদ হায়দার। ভ্রাতুকুলে দ্বিতীয়। পয়লা অগ্রজ রোউফ, জিয়া হায়দার গত হয়েছেন। মৃত্যুর পরে পাবনার দোহারপাড়ার কবরেই আছেন নিশ্চয়। দোজখে যাননি। রশীদ হায়দারই এখন আমাদের মুরুব্বি। আজ তাঁর জন্মদিন (১৫ জুলাই ১৯৪১)। দেখতে দেখতে বেলা হলো, ৭৫ বছর। পরিপূর্ণ জীবনে ধনী, সুখী। স্ত্রী ঝরা, দুই কন্যা হেমা, ক্ষমা, নাতিপুতি (রাতুল, রায়া, সহন, শরন) নিয়ে আনন্দিত। পারিবারিক। মশগুল। ভাইবোনদের নিয়ে পুলকিত, চাঁদের হাট। জিয়া হায়দারের পরে তিনিই আমাদের ভার নিয়েছেন। এও এক গুরুদায়িত্ব, বৃহত্তর সংসার দেখভালের। ভাইবোনদের সাংসারিক সুখে প্রফুল্ল, দুঃখে কাবু। ভাইবোনদের সংসারে সাহায্য করছেন না ঠিকই, দরকার নেই করার, কিন্তু তিনিই তো মাথার ওপরে, জ্বলন্ত সূর্য। আমাদের যাবতীয় আবদার, চাওয়াপাওয়া তাঁর কাছে। গর্বিত অগ্রজের জন্মদিনে। রশীদ হায়দারের ডাকনাম দুলাল, আমরা বলি দাদুভাই। মেজভাই বা মেজদা নয়। কী করে অনুজ-অনুজাকুলে চালু হলো দাদুভাই, অতীত-রহস্য অজানা। যেমন অজানা, তাঁর ‘ছেঁমড়ি লিয়ে’ হল্ডুক-মারা (ঘোরাঘুরি ) তথা প্রেম। আসলে ওসব লোককথা, গুজব, পাড়ার মিচকে ছাওয়ালপলের রটনা। রামের মতো প্রেমেও এক বৌ (রাম যদিও সীতাকে তালাক দেন, লোকের কানকথায়) নিয়ে দিব্যি বহাল। প্রেমে উদ্বেল। আদর্শ স্বামী। যদিও স্ত্রীকে (ঝরা, আনিসা হায়দার) এখনও কোনো বই উৎসর্গ করেননি। শুনেছি, করবেন, প্ল্যান আছে। পাবনার দোহারপাড়ার বাড়িতে, জমিদার মোহাম্মদ হাকিমউদ্দিন শেখ, জমিদারির দাপটে যা করার করেছেন, ধানচাল মাপা, জমির খাজনা, হিসেবনিকেশ, মামলামোকদ্দমা করা, করেছেন এমনকি বাদ দেননি জমিদখলও। অবাক মানি, এই বাড়িতে, জমিদারের চোখ রাঙানি, সতর্ক-দৃষ্টি সত্ত্বেও কি করে সাহিত্যের প্রবেশ। বলা হয়, প্রবেশের মূলে ছোট চাচা আবুল কাশেম। তিনি হাকিমউদ্দিনের ছোট ভাই, কনিষ্ঠ। হতে পারে অনুজের বদখেয়ালে ঝামেলা পাকাননি। প্রশ্রয়ও দিয়েছেন হয়ত, মনে-মনে। ‘সে বারতা পাওনি তুমি, ছিলে মগন গভীর স্বপনে।’ ছোট চাচা নাটক লিখতেন, তাঁর নাটকও পাবনার বনমালী রঙ্গমঞ্চে প্রদর্শিত। নাটক না হয় গৃহে প্রবেশ, বাড়িতে কবিতা এলো কি করে? জানি, নাটককে বলা হয় দৃশ্যকাব্য, আদিতে কবিতা আওড়েই নাটক হতো, কবিতাই মূলত নাটক। গ্রিক নাট্যকারদের ভাষ্য মান্য। মানলুম। বলা হয় প্রবাদে, আগের লাউ (নৌকো) যেদিকে যায়, পাছার লাইও সেদিকে। .... তাই যদি যায়, হায়দার-পরিবারের সাত ভাইয়ের পাঁচভাই-ই কবিতা লেখেন (অনুজ আরিফ হায়দারও), বাদ কেন রশীদ হায়দার? শুনেছি, কবিতা লেখার প্রশ্নে, ওঁর শরীরজুড়ে ম্যালেরিয়া, কম্প দিয়ে জ্বর। কিন্তু কবিতা পাঠে অক্লান্ত। তরুণতম কবিদের কবিতাও বাদ দেন না। আগার লাউ, পাছার লাউয়ের কথা বলছিলুম। জিয়া হায়দার নাটক লিখেছেন, রশীদ হায়দারও। ওঁর তৈলসঙ্কট নাটককে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক বলেছেন মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, একটি লেখায়। কেন অন্যতম, জিজ্ঞেস করেছিলুম বার্লিনে। তাঁর বিচারে (ছিলেন প্রধান বিচারপতি), সমকালীন বাংলাদেশকে, কালিকচিত্রে, রশীদের মতো কেউ চিত্রায়িত করেননি। রশীদ হায়দারের শিরায়মজ্জায় নাটক আছে, আশ্চর্য এই, নাটক নিয়ে হেলদোল নেই। শেকসপিয়র দ্য সেকেন্ড-এর মতো বিশ্বকাঁপানো একটি নাটক লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন কাফকার দ্য ট্রায়ালের নাট্যরূপ (আঁদ্রে জিদ ও জ্য লুই বার-এর নাট্যরূপ), নাম কাঠগড়া। অগ্রজ জিয়া হায়দার কবি, নাট্যকার, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলার প্রধান, আরিফ হায়দার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক, অগ্রজ-অনুজের প্রেরণামূলক সঞ্চারণবোধেও নাটক লিখছেন না আর। এ কি জমিদারপুত্র-দুলালের সৃজনসুষমাবোধ? গদ্যই রশীদের মাতৃভাষা, পরিশীলিত, মার্জিত, ঝঙ্কৃত, ছন্দোময়। গদ্যে বিশিষ্ট বলেই হয়ত ভিত্তিচ্যুত নন, গদ্যের সমগ্রতায় সপ্রাণ। যে উত্তাল সময়ে জন্ম, দেখেছেন ভারতভাগ। সবটা মনে নেই নিশ্চয়, কথাও নয় থাকার। পাকিস্তানের ধ্বংস, কবর স্মৃতিতে উজ্জ্বল অবশ্যই। বাংলাদেশের জন্মের খুঁটিনাটির প্রত্যক্ষদর্শী। সাক্ষী। ওঁর বহু গল্প, উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ বহুধায় সুচিহ্নিত। সর্বদাই মাটিলগ্ন মানুষ। কবিতা লেখেননি কখনও, কিন্তু মনমনন, মেজাজে, ঘুমেজাগরণে আপাদমস্তক কবি। দৃশ্যকাব্যের রচয়িতামাত্রেই কবি। বলেন, যদিও ‘কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি, তক্ষণি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত। টাইফয়েডও হয়।’ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র রাজনীতির হাওয়া থেকে দূরে। স্বাধীনতার পরেও কোন রাজনৈতিক দলে গা ভাসাননি। সুবিধা নেননি। বিশ্বমানবসঙ্ঘে আস্থাশীল, মানবিকতায় গরীয়ান। কমিউনিজমের সামাজিকতায় বিশ্বাসী। তাঁর ধর্ম শিল্পসাহিত্য, আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। খাঁটি বাঙালী তিনি। অগ্রজের ৭৫ জন্মবর্ষে নির্বাসিত অনুজের শুভেচ্ছা। প্রণতি। ১৩ জুলাই ২০১৫, বার্লিন, জার্মানি লেখক : কবি
×