ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আশ্রমে ১৩ বছরের ২৬ ঈদে কোন ছেলেমেয়ে আসেনি দেখতে

চোখের জলে ঈদ কাটে

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১৪ জুলাই ২০১৫

চোখের জলে ঈদ কাটে

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে পরিবারের সকলকে নিয়ে আনন্দ করা। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাত করা। ভাববিনিময় করা। কিন্তু এসব আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বরিশালের বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ ও বিভাগীয় বেবি হোমের আশ্রিত শিশুরা। বৃদ্ধাশ্রমের আশ্রিতদের ছেলেমেয়ে, ভাইবোন, নাতি-নাতনি থেকেও আজ অপনজন বলতে কেউ নেই। তাই প্রতিবছর অসহায় নিঃসঙ্গ ওই সব বৃদ্ধদের ঈদের দিন কাটে চোখের জলে। এমনকি ঈদের দিনও তাদের খোঁজ নিতে আসে না পরিবারের কেউ। বেবি হোমের শিশুদের জন্য ঈদের দিন নানা উৎসবের আয়োজন করা হলেও তারা কাছে পায় না কোন আপনজনকে। অধিকাংশ শিশুই জানে না তাদের পিতা-মাতার পরিচয়। নগরীর আমতলার মোড়সংলগ্ন শান্তি নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের আশ্রিতদের খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানা গেছে লোকহর্ষক কাহিনী। এখানকার অধিকাংশ বৃদ্ধের চোখের পাতায় মোটা দাগের রেখা স্পষ্ট। মুখজুড়ে বিষণœতার ছাপ। উষ্কখুষ্ক পাকা চুল। একটু চলাফেরা করলেই বয়সের ভারে হাঁপিয়ে ওঠেন। তবুও প্রতিদিন তাঁরা দুই মিনিটের পথ হেঁটে শান্তি নিবাসের প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে থাকেন যদি দেখা মেলে সন্তানদের। একপর্যায়ে ধৈর্য হারিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন। আবার আশা নিয়ে ছুটে যান প্রধান ফটকে। আশা ভঙ্গের এমন নিষ্ফল চেষ্টা চলে দিনে কয়েকবার। এভাবেই স্বজনদের প্রতীক্ষায় সন্ধ্যা নেমে আসার পর চোখের জল ফেলে তাঁরা ফিরে আসেন নিজ নিজ কক্ষে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় তারা ঘুমিয়ে পড়েন। শান্তি নিবাসে মনের অশান্তি নিয়ে বসবাসকারী ৭১ বছরের সালেহা বেগম, বৃদ্ধা আমিরুন নেছা, রিজিয়া বেগম, সুফিয়া বেগমসহ অনেকেই জানান, আমরা এখন বাতিলের খাতায়। আমাগো নিয়ে সন্তানদের ভাববার সময় নেই। সারাদিন তারা ব্যস্ত থাকে। তাই গত কয়েক বছর ঈদের দিনেও তারা আমাদের খোঁজ নিতে আসতে পারেনি। বলেই অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ওই নিবাসে আশি বছরের আরেক বৃদ্ধা কদবানু বেগম তাঁর অতীতের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, পটুয়াখালীর বড়বিগা গ্রামের বাসিন্দা ছিলাম। সন্তানদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে রায়টের আগে স্বামীর সঙ্গে সন্তানদের নিয়ে বরিশাল শহরে আসি। এরপর দুর্ভিক্ষ, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা সঙ্কটের মুহূর্তেও সন্তানদের আগলে রেখেছি। এমনও হয়েছে দু’দিন ধরে নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাইয়েছি। ঝড়-ঝাপটায় বুকে আগলে রেখেছি। এরপর সন্তানরা বড় হয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে একে একে সবাই যে যার মতো করে থাকতে শুরু করে। ওদের সঙ্গে আমাকে রাখা বোঝা মনে হতো। তাই নিজের ইচ্ছায় একদিন চলে আসি শান্তি নিবাসে। প্রায় ১৩ বছর ধরে এখানে আছি। সন্তানদের কথা স্মরণ করে তিনি আরও বলেন, চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে ভোলা-বরিশাল রুটের লঞ্চে চাকরি করে। আরেকজন থাকে স্টেডিয়ামসংলগ্ন এলাকায়। চার মেয়ের মধ্যে তিন মেয়ে বরিশাল ও ছোট মেয়ে নলছিটিতে শ্বশুরবাড়িতে থাকে। এখানে আসার পর থেকে ঈদের দিন তাকে কেউ দেখতে আসেনিÑ এটাই তাঁর বড় দুঃখ। তিনি বলেন, অন্তত ঈদের দিন ছেলেমেয়ে ও নাতিদের দেখা পাব, সেই আশায় কোনমতে হেঁটে গেটের সামনে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। এক সময় অধৈর্য হয়ে চলে আসি। ঘণ্টাখানেক পর আবার দেখা পাওয়ার আশায় গেটের সামনে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াই। সন্ধ্যা নেমে গেলেও পরিচিত কাউকে না দেখে চোখের পানি ফেলে রুমে চলে আসি। মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে মাঝেমধ্যে কাঁদি। কক্ষে গিয়ে নিজেকে বোঝাই, হয়ত ব্যস্ততার কারণে কেউ আসতে পারেনি, কাল আসবে। এমন কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে যাই টেরও পাই না। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সন্তান ও নাতিদের নিয়ে একসঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে এখনও খুব ইচ্ছা হয়। শান্তি নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্বে নিয়োজিত বরিশাল সেফ হোমের উপ-তত্ত্বাবধায়ক শ্যামল সেনগুপ্ত বলেন, প্রতিবছর ঈদের আগে বৃদ্ধাদের নতুন কাপড়, গামছা, বিছানার চাদরসহ বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
×