ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল খান

কেন রাজনীতিবিদরা নিজেদের অপরিহার্য মনে করেন?

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৪ জুলাই ২০১৫

কেন রাজনীতিবিদরা নিজেদের অপরিহার্য মনে করেন?

গ্রীক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারোফাকিস গ্রীসের নিষ্পত্তিমূলক গণভোট ফল প্রকাশ হওয়ার পরই ৬ জুলাই পদত্যাগ করেন। কারণ অন্যান্য ইউরোপীয় অর্থমন্ত্রী এবং অন্য দাতারা চান না যে, তিনি মন্ত্রীদের আসন্ন সভায় অংশগ্রহণ করুন। ‘আমি গর্বের সঙ্গে পাওনাদারগণের ঘৃণা পরিধান করব’, তিনি বলেন তার পদত্যাগ ঘোষণায়। গ্রীসের ৪১ বছরে দেশের প্রথম গণভোটে রেসকিউ ঋণের বিনিময়ে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে পাওনাদারদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ওই দেশের জনগণ। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, গণভোটের মাধ্যমে সরকারের তথা অর্থমন্ত্রীর নীতির প্রতি জনগণের সমর্থন-বিজয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি পদত্যাগ করেন। এই গণভোটের রায় পরবর্তীকালে ‘একটি ছোট ইউরোপীয় জাতি ঋণ-দাসত্বের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার অনন্য মুহূর্ত হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকব’, ভারোফাকিস বলেন। ‘এটা আমার দায়িত্ব, গণভোটের মাধ্যমে আমাদের অর্জিত মূলধন প্রধানমন্ত্রী যেন গ্রীসের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারেন, সে ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা’, বলেন ভারোফাকিস। কানাডার ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল পার্টি পরপর দু’বার ক্ষমতায় এবং এ পার্টি অক্টোবরের নির্ধারিত আগামী সাধারণ নির্বাচনে আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসবে সেটাই ধারণা করা হচ্ছে। তবুও চার চারজন মন্ত্রী গত এক বছরে পদত্যাগ করে তাদের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটিয়েছেন। তাদের সবারই আসন্ন নির্বাচনে একেবারে নিরাপদ আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে ফিরে আসা ছিল অবধারিত। সর্বশেষ পদত্যাগ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি তিন মেয়াদি এমপি। হাউস অফ কমন্সে পদত্যাগের ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘আমি এ পবিত্র সংসদকে খুব মিস করব এবং মিস করব সব পক্ষের অন্য মানুষদের যারা এখানে আছেন। কিন্তু আমার জীবনে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করার জন্য সময় এসেছে,’ বলেন ৪৫ বছর বয়সী বিদায়ী মন্ত্রী। বিশেষ করে ওয়েস্টমিনিস্টার গণতন্ত্রের চর্চা যে সমস্ত দেশে হয় তার সম্পূর্ণ বিপরীতে বাংলাদেশের জনগণের সাধারণভাবে কোনদিনও দেখা যায়নি কোন মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ বা তাদের রাজনৈতিক জীবনের ইতি টেনেছেন। এমনকি আশি বছর পার হয়ে যাওয়া রাজনীতিবিদ, যারা বহু বছর আমলা হিসেবে দেশের সেবা করেছেন এবং রাজনীতিতে যোগদান করার পর বহু বছর মন্ত্রিত্ব করেছেন, সেই অশীতিপর বৃদ্ধ রাজনীতিবিদরা এখনও রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয়। ভাবখানা জাতির এখনও তাদের সেবার ভীষণ প্রয়োজন এবং তাদের সেবার অপেক্ষায় তারা ভীষণভাবে উদগ্রীব। কয়েক বছর আগে কানাডার ফেডারেল ইমিগ্রেশন মন্ত্রী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ এক পিজা দোকান মালিক একটি শপথ বিবৃতি দেন এই বলেÑ মন্ত্রীর সংসদ নির্বাচনের সময় বিনামূল্যে তার প্রচারণা স্বেচ্ছাসেবকদের পিজা খাওয়ানোর বিনিময়ে কানাডায় তার অবৈধ অভিবাসী অবস্থানকে বৈধতা দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অভিযোগকারীর কানাডিয়ান আদালতে নিজেরই জালিয়াতি এবং প্রতারণায় জড়িত থাকার একাধিক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রীকে নৈতিক কারণে পদত্যাগ করতে হয়। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ওই অভিযোগকারী তার বিবৃতি মিথ্যা বলে প্রত্যাহার করেন এবং নীতিশাস্ত্র প্রশাসকের পরবর্তী ক্লিয়ারেন্সের পরেও মন্ত্রী তার পদ ফিরে পাননি এবং তিনি আর রাজনৈতিক জীবনে ফিরে আসেননি। ২০০২ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডাঃ বি চৌধুরীকে পদত্যাগ করতে বিএনপি সংসদীয় দলের পক্ষ থেকে যখন তাকে আল্টিমেটাম দেয়া হয় তখন পদত্যাগ করার কোন সাংবিধানিক বা আইনী বাধ্যবাধকতা তাঁর ছিল না। সংবিধান কোন রাজনৈতিক দল নয়, যে কারণে এক সংজ্ঞায়িত পরিস্থিতিতে এবং আইনের অধীনে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করতে পারে। তার কোনটিই রাষ্ট্রপতি চৌধুরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। তাঁর পদত্যাগ ছিল একেবারে নৈতিক বিবেচনার ওপর ভিত্তি করে। কেননা তিনি বুঝতে পারলেন, যারা তাকে নির্বাচিত করেছেন তিনি আর তাদের আস্থা বহন করছেন না। বিএনপির সংসদীয় দল সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব পদক্ষেপের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সমর্থিত একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করে, যার মাধ্যমে তাঁকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে বলা হয়, অন্যথায় তাঁকে অভিশংসিত করার হুমকি দেয়া হয়। তাঁর দেয়া রাষ্ট্রপতির এক বাণীতে তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাকে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাকারী’ হিসেবে আরোপ না করার অপরাধে তাকে অভিযুক্ত করা হয়, যেটা একদিকে যেমন সত্য নয়, তেমনি অন্যদিকে প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের সংযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দৃশ্যত, প্রেসিডেন্ট চৌধুরী ইতিহাসের নির্লজ্জ বিকৃতির পুনরুক্তি না করে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ অফিসের মর্যাদা অক্ষুণœ রেখেছিলেন। আমি তাঁর মহান রাষ্ট্রনায়কোচিতের জন্য তাকে প্রশংসা করে ইংরেজীতে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিলÑ ‘এক অভিমানী রাষ্ট্রনায়কের মহৎ প্রস্থান’। আমি নিম্নলিখিত উপসংহার দিয়ে আমার নিবন্ধের ইতি টেনেছিলাম, ‘একজন রাজনীতিবিদ থেকে এক রাষ্ট্রনায়কে অধ্যাপক চৌধুরীর রূপান্তর অনেক উপায়ে বরং দ্রুত অত্যাশ্চর্য ছিল এবং একইভাবে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে তাঁর অপসারণ সমানভাবে অপ্রত্যাশিত ছিল। একজন রাজনীতিবিদ থেকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার উত্থান প্রমাণ করে, সুযোগ দেয়া হলে আমাদের সমাজে এখনও অনেক মানুষ আছেন, যারা আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবার আস্থা ও সম্মান অর্জনের লক্ষ্যে নিজেদের পরিবর্তিত করতে পারেন।’ তবে তাঁর পদত্যাগের পর অধ্যাপক চৌধুরী কি আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী নিজেকে ধরে রাখতে পেরেছেন? আমরা এই আত্ম অনুসন্ধানময় প্রশ্নের একটি সম্মতিসূচক উত্তর পেলে খুশি হতাম। তাঁর পদত্যাগের পর তিনি তার নিজের রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যে কারণে তিনি তার প্রাক্তন সহকর্মী এবং কমরেডদের হাতে নিগৃহীত হন। পদত্যাগ করার কয়েক সপ্তাহ পর ‘পল্টন ময়দানে’ কয়েকটি বামপন্থী রাজনৈতিক দলের দ্বারা আয়োজিত একটি রাজনৈতিক সমাবেশে তিনি যোগ দেন। কিন্তু মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী পল্টন ময়দানে তাঁর শ্রমসাধ্য এবং গোপন যাত্রা একজন পলাতক আসামির আসন্ন বন্দীকারীকে মূর্খ বানিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বলে মনে হয়েছিল। একজন প্রাক্তন ভিসির (এখন যিনি গণতন্ত্রের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিফলনের চেষ্টা করছেন) নেতৃত্বে তার সাবেক দলের ‘বুদ্ধিজীবী’ সমর্থকরা আরও শক্ত হাতে ‘গণতন্ত্রের শত্রুদের’ দমনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি দেন। দলীয় ক্যাডাররা সম্ভবত ডাঃ বি চৌধুরীর ওপর যে উৎকট হামলা চালিয়েছিল সেটা একটি নতুন জন্ম নেয়া ‘গণতন্ত্রের শত্রু’কে শক্ত হাতে দমনের আহ্বানেরই প্রতিফলন ছিল। এটাও যথেষ্ট ছিল না। অধ্যাপক চৌধুরী প্রজাতন্ত্রের একজন সাবেক যথাযথভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েও ব্যক্তিগতভাবে দুই আসন থেকে একটি সংসদীয় আসনের দৌড়ে অংশগ্রহণ করেন; কিন্তু উভয় আসনেই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। এর পরেও আটের দশকের মাঝামাঝি বয়সের হয়েও, জাতির এখনও তার অপরিহার্য সেবার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। তিনি এখনও মনে করছেন, জাতিকে এখনও তার অজানা প্রতিভার সেবা প্রদানের অনেক কিছু রয়ে গেছে। সে ব্রতে তিনি এখন তার প্রাক্তন নেতা, যার আদেশে দেশের সর্বোচ্চ পদ থেকে তার অভিশংসন আসন্ন ছিল, সেই নেতার নেতৃত্বে ‘গণআন্দোলনের’ মাধ্যমে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ ব্রত নিয়ে তার সাবেক দল এবং কমরেডদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, যে দল তেরো বছর আগে তাকে প্রজাতন্ত্রের প্রথম নাগরিকের আসন থেকে অপমানজনকভাবে বিতাড়িত করেছিল। তার বর্তমান কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে আমি যদি গুগলসের সার্চ ইঞ্জিন থেকে তাকে এক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অভিহিত করে নিবন্ধটি এক্সপাঞ্জ করতে পারতাম তাহলে শান্তি পেতাম। লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
×