ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেলস্টেশন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে ঘরমুখো মানুষের ঢল

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৪ জুলাই ২০১৫

রেলস্টেশন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে ঘরমুখো মানুষের ঢল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন রাজধানীর মানুষ। তাই সোমবার ভোর থেকে রেল স্টেশন, বাস টার্মিনাল থেকে শুরু করে নদীবন্দরে নেমেছিল ঘরমুখো মানুষের ঢল। যে যেভাবে পারছেন, যাচ্ছেন। নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত হলেই হলো। এদিকে টিকেট কালোবাজারী, অল্প সময়ের মধ্যে টিকেট শেষ হয়ে যাওয়া, ভোগান্তিসহ নানা অভিযোগের মধ্য দিয়ে রেলওয়ের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শেষ হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে রেলওয়ের অগ্রিম টিকেট নেয়া যাত্রীরা সোমবার থেকে যাত্রা শুরু করেছেন। নয় জুলাই বিক্রি হয় ১৩ জুলাইয়ের রেলের আগাম টিকেট। যাত্রা শুরুর প্রথম দিনে কিছু ট্রেন বিলম্বে ছেড়ে যাবার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। ট্রেনের ছাদে ও ইঞ্জিনে এমনকি বাম্পারে ঝুলে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার চিত্রও চোখে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কাউকে কোন বাঁধা দেয়া হয়নি। বাস ও লঞ্চের চিত্রও ছিল একই রকম। ১৬ জুলাই থেকে ট্রেনের ফিরতি টিকেট বিক্রি শুরু হবে। শেষ দিনে ট্রেনের টিকেট বিক্রি করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে সবার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যাত্রীদের অভিযোগ টিকেট না পাওয়া। আবার রেল কর্মকর্তারাও অতিষ্ঠ অভিযোগ শুনতে শুনতে। যারা কাউন্টারের ভেতরে বসে টিকেট বিক্রি করছিলেন, তারা অনেকটা অসহায়। টিকেট নেই বললেই শুনতে হয়েছে গালাগালি। মানুষের চিৎকার, চেঁচামেচি তো আছেই। সোমবারের টিকেট সংগ্রহে প্রতিদিনের মতো রবিবার বিকেল থেকেই দীর্ঘ লাইন ছিল। প্লাটফরমজুড়ে ছিল রাতজাগা মানুষের অপেক্ষা। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে লাইন বাড়তে থাকে। পায়ে-পায়ে মানুষের সব স্রোত যেন কমলাপুরমুখী। শেষ দিনে কমলাপুর রেল স্টেশনজুড়ে ছিল তিন ধরনের মানুষের আনাগোনা। এক শ্রেণীর মানুষ যারা অগ্রিম টিকেট নেয়ার জন্য আসেন। আরেকটি পক্ষ যারা নিয়মিত ট্রেনের টিকেট সংগ্রহ করেন। অপর পক্ষ হলো যারা ১৩ তারিখের অগ্রিম টিকেট সংগ্রহ করেছিলেন, তারা। যাত্রার দিনে স্ট্যান্ডিং টিকেট সংগ্রহ করেন অনেকে। তবে শেষ দিনে বেশিরভাগ যাত্রীর অভিযোগ ছিল টিকেট না পাওয়ার। বাস্তবতা হলো, সাধারণ যাত্রীদের জন্য নয় হাজার ৩৫টি টিকেট মাত্র। এর মধ্যে বিমানবন্দর রেল স্টেশন থেকেও অগ্রিম টিকেট দেয়া হয়। সব মিলিয়ে কত জনই বা টিকেট পেতে পারেন। একজনের জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ টিকেট চারটি। বেশিরভাগ যাত্রীই চার টিকেট সংগ্রহ করেন। এ হিসেবে দুই হাজার ২০০ কিছু বেশি মানুষ দিনে টিকেট কেনার সুযোগ পান। অথচ রেলস্টেশনজুড়ে ছিল টিকেটের বিপরীতে তিনগুণের বেশি লোকজন। ফলে যাই হওয়ার তাই হয়েছে। তাছাড়া নির্দিষ্ট কোটার বাইরে তদবিরের টিকেট তো রয়েই গেছে। রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছরের মতো এবারও ২৫ ভাগ ই-টিকেট, পাঁচ ভাগ ভিআইপি আরও পাঁচ ভাগ টিকেট বরাদ্দ রেলওয়ের স্টাফদের জন্য। ৬৫ ভাগ সাধারণ যাত্রীদের। এরপর বিভিন্ন তদবিরও রক্ষা করতে হয় রেলের কর্তাব্যক্তিদের। সাধারণ মানুষ শেষ পর্যন্ত কত ভাগ টিকেট পেয়েছেন সে প্রশ্ন তো রয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, যাত্রীবেশে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে দিনভর বিপুলসংখ্যক কালোবাজারি টিকেট সংগ্রহ করেছে। এসব টিকিট পরে সাধারণ যাত্রীদের কাছে চড়াদামে বিক্রি করছেন তারা। তবে এ সংক্রান্ত প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেনি। যদিও জনকণ্ঠ’র অনুসন্ধানে একাধিক যাত্রীকে দ্বিগুণের বেশি টাকায় টিকেট সংগ্রহ করার বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একযাত্রী বলেন, তিনি ১৭ জুলাইয়ের হাওর এক্সপ্রেসের মোহনগঞ্জের টিকেট সংগ্রহ করেছেন দুই হাজার টাকায়। তিনি কার কাছ থেকে টিকেট সংগ্রহ করেছেন এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি। তবে বলেছেন, লাইনে দাঁড়াতে হয়নি তাকে। বাড়তি টাকায় লাইনে দাঁড়িয়ে খুলনা ও রাজশাহীর টিকেট সংগ্রহ করেছেন একাধিক ব্যক্তি। এদিকে কালোবাজারী ঠেকাতে কমলাপুর রেল স্টেশনজুড়ে ৩২টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। শেষ দিনে স্টেশন ম্যানেজারের রুম, জিআরপি অফিসসহ আরও একাধিক রুমে এসব ক্যামেরা পর্যবেক্ষণে কাউকে দেখা যায়নি। তবে র‌্যাব-৩ এর অভিযোগ কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিক কেউ অভিযোগ জমা দেননি। মৌখিক অভিযোগ এলেও র‌্যাবের তদন্তের শেষ পর্যন্ত কোন প্রমাণ মেলেনি বলে জানা গেছে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কালোবাজারিরা লাইনে দাঁড়ালেও দেখে বুঝার কোন উপায় নেই। কে কালোবাজারি আর কে যাত্রী। কাউন্টারে সিরিয়াল অনুযায়ী টিকেট বিক্রি হয়। তবে কাউকে সন্দেহ হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সোমবার কমলাপুর স্টেশনে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত শনিবার ৪ ও ৫নং কাউন্টারের সামনে থেকে সূবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের ৮টি এসি চেয়ারের টিকেটসহ কচি মারমা ও মাহবুব নামের দু’জন কালোবাজারিকে আটক করা হয়। রবিবার আটক হয় আরও দু’জন। এ দু’জন শুক্রবারও টিকেট কিনেছেন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে কমলাপুর স্টেশনের ম্যানাজার সিতাংশু চক্রবর্তী বলেন, লাইনে দাঁড়ালে কে কালোবাজারি আর কে যাত্রী বুঝার উপায় নেই। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কালোবাজারিদের ধরতে অত্যন্ত তৎপর। স্টেশনের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, কাউন্টারের সামনে সিরিয়াল ধরে কেউ টিকেট কাটলে কাউকেতো কালোবাজারি বলে পাকড়াও করা যায় না। তবে কেউ যদি টিকেট বেশি দামে বিক্রি করেন এবং তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা রেল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয় কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। কমলাপুর স্টেশনে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা বলেন, কালোবাজারিরা প্রথমে টিকেট নেয়ায় পরে সঙ্কট হয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘দশজন যদি কাউন্টারের সামনে দাঁড়ান তাহলে নিয়ম ?অনুযায়ী তারা চল্লিশটি টিকিট নিয়ে নেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কালোবাজারিদের কাছে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের আন্তঃনগরের টিকেট পাওয়া যায়। ঈদ যত ঘনিয়ে আসে টিকেট বিক্রির দরও তত বাড়তে থাকে। কমলাপুর স্টেশনের ম্যানেজার বলেন, অতীতের তুলনায় বর্তমানে কালোবাজারে টিকেট বিক্রির প্রবণতা কমেছে। বছর তিনেক আগের তুলনায় কালোবাজারির সংখ্যা হাতেগোনা। ঈদের অগ্রিম টিকেট কাটতে আসা কয়েকজন যাত্রী অভিযোগ করে বলেছেন, ট্রেনের টিকেট প্রায় অর্ধেক চলে যায় ভিআইপি কোটায়। তার মধ্যে কালোবাজারিরা সিরিয়ালে দাঁড়ানোর কারণে প্রকৃত যাত্রীরা টিকেট প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ট্রেনের টিকেট প্রতিজন চারটি করে নেয়ার সুযোগ থাকায় কালোবাজারিরা সংঘবদ্ধ হয়ে রাত থেকে কাউন্টারের সামনে অবস্থান নেয়। প্রত্যেকে চারটি করে টিকেট নিয়ে নেন। শেষ দিনের টিকেট বিক্রি কার্যক্রম ও প্রথম দিনের ঈদের ট্রেন যাত্রা শুরু পরিদর্শনে এসে কমলাপুরে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, আগামী ২০ থেকে ২৬ জুলাই ঈদের ফিরতি ট্রেন স্পেশাল সার্ভিস চলবে। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে স্পেশাল সার্ভিস চালু হয়েছে। প্রথম দিনেই কমলাপুর থেকে ২৯টি ট্রেন দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেড়ে গেছে। এর মধ্যে ২৮টি যথাসময়ে ছেড়ে গেছে। কোন শিডিউল বিপর্যয় ঘটেনি। একটি ট্রেন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে যথাসময়ে ছেড়ে যেতে পারেনি। এ সময় তার সঙ্গে কমলাপুর রেলস্টেশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, টিকেট কালোবাজারির এসব অভিযোগ সত্য নয়। ঢাকার কমলাপুরে রেলওয়ে স্টেশনে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে টিকেট বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত গন্তব্যের টিকেট নিচ্ছেন। বিক্রির সময় রেলওয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে তদারকি করছে। তিনি জানান, টিকেট কালোবাজারি রোধে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা স্টেশন ও আশপাশের এলাকায় নজরদারী করছে। এ পর্যন্ত কোন অভিযোগও পাওয়া যায়নি।
×