ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আল বিদা মাহে রমজান

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৩ জুলাই ২০১৫

আল বিদা  মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ মাহে রমজানুল মোবারকের আজ ২৫তম দিবস। আগামীকাল পবিত্র শবে কদর, আল কুরআন নাযিলের রজনী। ৬১৯ খ্রিস্টাব্দের মাহে রমজানের ২০ তারিখ ওফাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হুজুরে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদীজা (রাঃ)। তিনি নারী পুরুষের মধ্যে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী, নূরনবীর সাথে প্রথম নামাজ আদায়কারী। ইসলামের একেবারে শুরুর যুগে ধনসম্পদ ও মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে অবিস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন এ অতুলনীয় বিশ্ববরেণ্য মহিলা। তার একটি বড় পরিচয় ৬১০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার জাবালে নূরের হেরা গুহা আলোকিত করে যখন পাক কালাম কুরআন শরীফ নাযিলের শুভ সূচনা হয়েছিল তখন সে পর্বতশৃঙ্গে স্বামীভক্ত ধনাঢ্য খাদীজা মাথায় করে পানাহার নিয়ে যেতেন আখেরি পয়গাম্বরের জন্য। তাই আজ কুরআন নাযিলের মাসে, কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ হওয়ার পুণ্য স্মৃতিময় রজনী শবে কদরের প্রাক্কালে সর্বোপরি কুরআন শরীফ নাযিলের সূচনা পর্বের মাত্র ৯ বছরের ব্যবধানে এ মাসে ওফাতপ্রাপ্ত হওয়া মহীয়সী মহিলা মা খাদীজা আমাদের হৃদয় নিংরানো স্মরণ শ্রদ্ধা, সালাম ও ভালবাসা পাওয়ার দাবি রাখে। হযরত খাদীজার (রাঃ) বাল্য ও কৈশোর জীবনের তেমন কোন তথ্য সিরাতের গ্রন্থাবলীতে পাওয়া যায় না। তবে সেই জাহিলী সমাজে তিনি যে অতি পুতঃপবিত্র স্বভাব-বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন সে কথা বিভিন্নভাবে জানা যায়। আবু হালা হিন্দা ইবন যুরারা আত-তামীমীর সঙ্গে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়। তার মৃত্যু পর আতিক ইবন আবিদ মতান্তরে আয়িজের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হয়। বালাজুরী বলেছেন, দ্বিতীয় স্বামী আতীকের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপর দয়াল নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তোলেন। নবী (সাঃ) যখন খাদীজাকে (রাঃ) বিয়ে করেন তখন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বয়স পঁচিশ এবং খাদীজা (রাঃ) তাঁর চেয়ে পনেরো বছরের বড়। আজ-জাহবী ঃ তারিখ-১/৪২। বিয়ের পনেরো বছর পর হযরত নবী করীম (সাঃ) নুবুওয়াত লাভ করেন। সহীহ বুখারীর ‘ওহীর সূচনা’ অধ্যায়ে একটি হাদীসে বিষয়টির বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। নবীজীর আরেক স্ত্রী হযরত আয়িশা (রাঃ) অতি চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘রাসূলুল্লাহর (সাঃ) প্রতি প্রথম ওহীর সূচনা হয় ঘুমে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। স্বপ্নে যা কিছু দেখতেন তা সকাল বেলার সূর্যের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর নির্জনে থাকতে ভালবাসতেন। খানাপিনা সঙ্গে নিয়ে গুহায় চলে যেতেন। সেখানে কয়েকদিন ইবাদতে মশগুল থাকতেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে আবার খাদীজার কাছে ফিরে আসতেন। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আবার গুহায় ফিরে যেতেন। এ অবস্থায় একদিন তাঁর কাছে সত্যের আগমন হলো। ফেরেশতা এসে তাঁকে বললেন : আপনি পড়ুন। তিনি বললেন : আমি তো পড়ালেখার লোক নই। ফেরেশতা তাঁকে এমন জোরে চেপে ধরলেন যে, তিনি কষ্ট অনুভব করলেন। ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন : পড়ুন। তিনি আবারও বললেন : আমি তো পড়ালেখার লোক নই। ফেরেশতা দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারও তাঁর সঙ্গে প্রথমবারের মতো আচরণ করলেন। অবশেষে বললেন : পড়ুন আপনার প্রতিপালকের নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপি- থেকে। পড়ুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’ (সূরা আল ‘আলাক-৫) রাসূল (সাঃ) ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরলেন। খাদীজাকে ডেকে বললেন : ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও, কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।’ তিনি ঢেকে দিলেন। তাঁর ভীতি কেটে গেল। তিনি খাদীজার নিকট পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং নিজের জীবনের আশাঙ্কার কথা ব্যক্ত করলেন। খাদীজা বললেন : না, তা কক্ষণও হতে পারে না। আল্লাহর কসম! তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরিব-দুঃখীর সাহায্যকারী, অতিথিপরায়ণ ও মানুষের বিপদে সাহায্যকারী। অতঃপর খাদীজা (রাঃ) রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) সঙ্গে করে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নওয়াফিলের নিকট নিয়ে যান। সেই জাহিলী যুগে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হিব্রু ভাষায় ইনজীল কিতাব লিখতেন। তখন তিনি বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন। খাদীজা বললেন : ‘শুনুন তো আপনার ভাতিজা কি বলে।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন : ‘ভাতিজা তোমার বিষয়টি কি?’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। সব কথা শুনে ওয়ারাকা বললেন ঃ এত সেই ‘নামুস’ বা খোদার দূত-আল্লাহ যাকে মূসার (আঃ) নিকট পাঠিয়েছিলেন. . .।’ পবিত্র কুরআনুল কারীম নাযিলের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেকগুলো ঘটনার নিবিড় সাক্ষী ও সহযোগী ছিলেন মা খাদীজাতুল কোবরা (রা.)। ইমাম যুহরী বলেন : খাদীজা (রাঃ) প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন। আল্লাহ পাক ইসলামের প্রতি, ইসলামের মহান নবীর প্রতি এ মহীয়সী মহিলার মতো আমাদেরও সর্বস্ব ত্যাগী হওয়ার তাওফিক দান করুন।
×