ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী ॥ সিরিজে ১-১ সমতা

উড়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৩ জুলাই ২০১৫

উড়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা

মিথুন আশরাফ ॥ গায়ানার স্মৃতি পুনরাবৃত্তি করে ফেলল বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে রবিবার দ্বিতীয় ওয়ানডেতে খেলতে নামার আগে ১৫ ওয়ানডে খেলে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের সুপার এইটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের গায়ানাতে যে জয় মিলেছিল, সেই জয়টি এতদিন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র জয় ছিল। এবার আবারও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাল বাংলাদেশ। এ জয়টি আসল এবার বাংলার মাটিতে। নাসির হোসেনের (৩/২৬) স্পিন ঘূর্ণি, মুস্তাফিজুর রহমানের (৩/৩৮) গতির ঝড়ের পর ম্যাচ সেরা সৌম্য সরকার (৮৮*) ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের (৫০) রেকর্ড ১৩৫ রানের জুটিতে ৭ উইকেটে প্রোটিয়াদের হারিয়ে গায়ানার স্মৃতি আবারও মিরপুরে ফিরিয়ে আনল টাইগাররা। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৪৬ ওভারে ১৬২ রানে অলআউট করে ৩ উইকেট হারিয়ে ২৭.৪ ওভারে ১৬৭ রান করে জয় পেয়ে গেল বাংলাদেশ। এ জয়টি পাওয়ায় তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১-১ সমতাও আসল। বুধবার চট্টগ্রামে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে যে দল জিতবে, সিরিজ তাদেরই হয়ে যাবে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর আনন্দের সঙ্গে বাংলাদেশ শিবিরে স্বস্তিও মিলে গেল। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা যে নিশ্চিত করে নিয়েছে মাশরাফিবাহিনী। এ নিয়ে আর কোন দ্বিধাই থাকল না। তাতে কী উৎসবও হলো না? ইমরান তাহিরের বলে যখন ডিপ মিডউইকেট দিয়ে সৌম্য সরকার ছক্কা হাঁকিয়ে জয় নিশ্চিত করলেন, স্টেডিয়ামে আগত দর্শকরা তো নাচতে থাকলেন। ক্রিকেটাররাও আনন্দে মাতলেন। ক্রিকেটারদের সঙ্গে আবারও পুরো জাতি উৎসবে মাতল। জিম্বাবুইয়েকে ৫-০, পাকিস্তানকে ৩-০, ভারতকে ২-১ ব্যবধানে সিরিজে হারানোর পর এখন তো দক্ষিণ আফ্রিকাকেও সিরিজে হারানো আশা জেগে গেল! বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ শুরুর আগে একটি প্রশ্ন সবার মুখে মুখে ছিল, গায়ানার স্মৃতি পুনরাবৃত্তি করতে পারবে বাংলাদেশ? সেটি যে ওয়ানডেতেই হতে হবে এমন নয়, দুই ম্যাচের টি২০ সিরিজে হলেও হত। কিন্তু বাংলাদেশ দুটি টি২০তেই হেরে গেল। প্রথম ম্যাচে ৫২ রানে ও দ্বিতীয় ম্যাচে ৩১ রানে হেরে যায় বাংলাদেশ। এরপর যখন প্রথম ওয়ানডেতেও ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে হার হলো, তখন বাংলাদেশের সিরিজ হারই হবে, এমন ভাবাও হলো। এর মধ্যে একটি ঘটনা ঘটল। যার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন প্রশংসা পেতেই পারেন। দ্বিতীয় ওয়ানডের আগের দিন ক্রিকেট, কোচ, কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি সভা করলেন। যেখানে ক্রিকেটারদের সতর্ক করে দিলেন এবং দলে পরিবর্তনের কথাও বললেন। তাতেই যেন কাজও হয়ে গেল। ক্রিকেটাররাও শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খেলতে থাকলেন। জিতেও গেলেন। যখনই দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেট পড়ল, তখনও বিসিবি সভাপতি হাত তালি দিতে থাকলেন। যখন ব্যাটসম্যানরা বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকলেন, তখনও হাত তালি দিতে থাকলেন। পুরো খেলা স্টেডিয়ামে বসেই দেখলেন। এ ম্যাচ জয়ে যেমন জয়ের দিক দিয়ে গায়ানার স্মৃতির পুনরাবৃত্তি হলো। দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস শেষ হতেই গায়ানা স্মৃতি সামনে এসে পড়ল। এর আগে যে সেই গায়ানাতেই একবারই মাত্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে অলআউট করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। গায়ানায় ১৮৪ রানে অলআউট করে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৬৭ রানের জয়ও পেয়েছিল বাংলাদেশ। টস জিতে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাটিং করা শুরু করল, মনে হয়েছে, উইকেটে রান তোলা কঠিন, উইকেটে স্পিন ধরেছে। আবার বল স্লো হয়েছে। বল নিচুও হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা সেখানেই যেন মাত খেয়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশের বেলাতে এর কোন প্রভাবই মিলল না। শুরুতেই ৫ রানে তামিম ইকবাল (৫) ও ২৪ রানে লিটন কুমার দাসকে (১৭) আউট করা গেলেও এরপর যে ওপেনার সৌম্য সরকার ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ মিলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যে কোন উইকেটে সর্বোচ্চ ১৩৫ রানের জুটি গড়লেন, সেখানেই আসলে খেলা শেষ হয়ে গেল। জয়ের জন্য ৪ রান যখন দরকার, তখন আউট হয়ে গেলেন মাহমুদুল্লাহ। ইনজুরি থেকে ফিরে প্রথম ওয়ানডেতে জৌলুস ছড়াতে না পারলেও নির্ভরযোগ্য এ ব্যাটসম্যান দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই অর্ধশতক করলেন। এরপর সাকিব এসে সৌম্যের সঙ্গে শুধু জয় পেয়ে মাঠ থেকে বের হওয়ায় ভাগ বসালেন। বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাল। এখন শুধু টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়াই বাকি থাকল। যাদের একবারই মাত্র হারিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া টেস্ট খেলুড়ে সব দলকেই একের অধিকবার হারানোর যোগ্যতা দেখিয়েছেন টাইগাররা। টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর মধ্যে জিম্বাবুইয়েকে সর্বোচ্চ ৩৬ বার, নিউজিল্যান্ডকে ৮ বার, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৭ বার, ভারতকে ৫ বার, পাকিস্তানকে ৪ বার, শ্রীলঙ্কাকে ৪ বার, ইংল্যান্ডকে ৩ বার, দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২ বার ও অস্ট্রেলিয়াকে ১ বার হারিয়েছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে এ নিয়ে ৩০৮ ম্যাচে ৯৪টি জয়ও তুলে নিল বাংলাদেশ। পেসার কাগিসো রাবাদাকে নিয়ে খানিক ভয় ছিল। কিন্তু রাবাদা কেন বাংলাদেশ ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার কোন বোলারই নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। প্রোটিয়া বোলাররা যা করতে পারেননি, তা অবশ্য করে দেখিয়েছেন বাংলাদেশ বোলাররা। বাংলাদেশ বোলাররা সহজাত উইকেট পেয়ে জৌলুস ছড়িয়েছেন। এমনই অবস্থা হয়েছে, ১০০ রান তুলতেই ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে সফরকারীরা। সেই ১০০ রান করতেও ৩১.৩ ওভার খেলতে হয়েছে। যেখানে প্রথম ওয়ানডেতে ৬৫ রানে ২ উইকেট হারিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। আর কোন উইকেটই হারায়নি। বাংলাদেশের করা ১৬০ রান অতিক্রম করতে গিয়ে ৮ উইকেটের বড় জয়ও তুলে নিয়েছিল। সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়েও গিয়েছিল। সেখানে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকা ধসের মধ্যেই পড়েছে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সামনে জিততে ১৬৩ রানের টার্গেট দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। নাসির হোসেন তো তুখোড় অফ স্পিনার হয়ে উঠছেন। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা বলেছিলেন, ‘নাসির আমাদের দলের সেরা অফ স্পিনার।’ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে সমতা আনার ম্যাচে বুঝিয়ে দিয়েছেন নাসির, সে আসলেই দলের সেরা অফ স্পিনার! নাসির নিজেকে প্রমাণ করে চলেছেন। তবে পেসার মুস্তাফিজুর রহমান কিন্তু আবারও ঝলক দেখিয়ে দিয়েছেন। ভারতের বিপক্ষে সিরিজে মুস্তাফিজকে বিশ্ব ক্রিকেট চিনেছে। তুখোড় বোলিং করেছিলেন। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে সবচেয়ে বেশি ১৩ উইকেট নিয়েছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জৌলুস যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন। দুই টি২০ ও প্রথম ওয়ানডে মিলিয়ে মাত্র ১ উইকেট নিয়েছিলেন। চতুর্থ ওয়ানডেতে এসে কোন উইকেটের দেখাই পাননি মুস্তাফিজ। সেই মুস্তাফিজ দ্বিতীয় ওয়ানডেতে এসে কী বোলিংই না করলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম উইকেটই নিয়ে নিলেন। এরপর এক এক করে উইকেট পড়তেই থাকল। দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোরবোর্ডে যখন ১৬ রান জমা হয়, তখন ডি কককে (২) আউট করেন মুস্তাফিজ। এরপর ৪৫ রানে হাশিম আমলাকে (২২) দ্বিতীয় ওয়ানডেতে জুবায়ের হোসেনের পরিবর্তে খেলার সুযোগ পেয়ে ২ উইকেট নেয়া রুবেল হোসেন সাজঘরে ফেরান। ৫৯ রানে রিলি রুশোকে (৪) নাসির আউট করে দেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে ধস নামা শুরু হয়ে যায়। এরপর ৭৪ রানে ডেভিড মিলারকে (৯) মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, ৯৩ রানে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান করা ডু প্লেসিসকে (৪১) নাসির, ১০০ রান করতেই জেপি ডুমিনিকে (১৩) মুস্তাফিজ আউট করে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে চিড় ধরিয়ে দেন। ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকা যেন বিপদের মধ্যেই পড়ে যায়। এলোমেলো হয়ে যায়। সেখান থেকে আর যে প্রোটিয়ারা বড় স্কোর গড়তে পারবে না তা বোঝাই যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। ১৬২ রানে ফারহান বেহারডিয়ানকে (৩৬) মাশরাফি সাজঘরে ফেরানোর আগে ১১৬ রানের সময় ক্রিস মরিসকে (১২) রুবেল, ১৩৮ রানে কাগিসো রাবাদাকে (১০) মুস্তাফিজ ও ১৬০ রানে কাইল এ্যাবোটকে (৫) নাসির আউট করে দেন। যখন বেহারডিয়ানকে সাজঘরে ফেরান, তখনই বাংলাদেশ বোলারদের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাকের পর (২০৭ উইকেট) ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করেন মাশরাফি (৯৮ উইকেট)। কিন্তু ৯৮ উইকেট নিয়েও মাশরাফির চেয়ে এক ম্যাচ বেশি (১৫৫ ম্যাচ) খেলে তৃতীয় স্থানে থাকা সাকিব আল হাসান কোন উইকেটই পেলেন না। দুই টি২০ ও দুই ওয়ানডে মিলিয়ে মাত্র ১ উইকেট পেয়েছেন সাকিব। এ সিরিজে ভালই উইকেট খরা যাচ্ছে তার। সাকিব উইকেট না পেলেও মুস্তাফিজ আবার ছন্দে ফিরেছেন। নাসির হোসেন ঝলক দেখাচ্ছেন। এর সঙ্গে রুবেল হোসেনের জৌলুসে বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো অলআউট হতে বাধ্য হলো দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার এ অবস্থা দেখে ক্রিকেটপ্রেমীরা ভীষণ খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি মনে হয়েছে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে। তিনি যে ম্যাচের আগের দিন ক্রিকেটারদের সতর্ক করেছেন, তা কাজে লেগেছে। তাতেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে যে এর আগে একবারই গায়ানাতে অলআউট করতে পেরেছিল বাংলাদেশ, হারাতে পেরেছিল, এবার আবারও সেই দুই স্মৃতিরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। তাতে জয় মিলল বাংলাদেশেরই। সিরিজেও আসল সমতা। স্কোর ॥ দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংস ১৬২/১০; ৪৬ ওভার (ডু প্লেসিস ৪১, বেহারডিয়ান ৩৬, আমলা ২২, ডুমিনি ১৩, মরিস ১২, রাবাদা ১০; নাসির ৩/২৬, মুস্তাফিজ ৩/৩৮, রুবেল ২/৩৪)। বাংলাদেশ ইনিংস ১৬৭/৩; ২৭.৪ ওভার (সৌম্য ৮৮*, মাহমুদুল্লাহ ৫৫, লিটন ১৭, তামিম ৫; রাবাদা ২/৪৫)। ফল ॥ বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী। সিরিজ ॥ ১-১ সমতা আসল। ম্যাচসেরা ॥ সৌম্য সরকার (বাংলাদেশ)।
×