ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

আক্রান্ত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও ধর্মের দুর্বৃত্তায়ন

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৩ জুলাই ২০১৫

 আক্রান্ত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও ধর্মের দুর্বৃত্তায়ন

সম্প্রতি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নিউইর্য়কের একটি অনুষ্ঠানে দেয়া মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছে একটি মহল। এই বির্তকটা যতটা সরব বাইরে তারচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। এই মন্তব্য জিইয়ে রেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে নতুন ইস্যু খুঁজতে চাইছে হেজাবিরা। গতকালের পর আজ পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি- মক্কায় হজ করতে গেলে ছোট একটি পুস্তিকা দেয়া হয় সবাইকে। বাঙালীদের জন্য বাংলা ভাষায় লেখা। সৌদি আরবের ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত। সেখানে লেখা আছে- ‘কোন মুসলিম পুরুষের জন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন, কোন মহিলার পাশে অথবা তার পেছনে দাঁড়িয়ে মসজিদ-উল হারাম বা অন্য যে কোন মসজিদে নামাজ আদায় করা উচিত নয়। অবশ্য এ অবস্থা হতে বেঁচে থাকার সমর্থ না থাকলে অন্য কথা।’ তা মসজিদে হারামে নামাজ পড়ার জন্য কাতারবন্দী হয়েছি। সামনে দেখি বেশ কয়েকজন মহিলা, তাদের পাশে পুরুষও আছেন। সেজদা দিচ্ছি, দেখি সোমালী কয়েকজন মহিলা আমাকে ডিঙিয়ে অন্য কোথায় স্থান পাওয়া যায় কিনা খুঁজে দেখছেন। একজন মুসল্লিকেও আমি বেদাআত বলতে শুনিনি। যেই হেজাব নিয়ে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিরুদ্ধে কথা তুলছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে বলি, ঐ পুস্তিকায় লেখা হয়েছেÑ ‘ইহরাম অবস্থায় মহিলাদের জন্য হস্তদ্বয়ের দস্তানা (হাত মোজা) পরিধান করা এবং নেকাব বা বোরকা দ্বারা মুখ ঢাকা হারাম। তবে মাহরাম নয় এমন পরপুরুষের উপস্থিতিতে ওড়না অথবা ঐ জাতীয় জিনিস দ্বারা চেহারা ঢাকা ওয়াজিব, যেমনিভাবে ইহরামের অবস্থা ছাড়াও পরপুরুষের উপস্থিতিতে ওড়না বা অনুরূপ কাপড় দ্বারা মুখ আবৃত করা ওয়াজিব।’ এটি হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে পবিত্র কর্তব্য হজের সময় দিকনির্দেশনা। এবং শব্দটি লক্ষ্য করুন ওয়াজিব, ফরজ বা সুন্নত নয়। তাহলে সাধারণ অবস্থায় কী হবে? শুধু তাই নয়, ‘বরকত লাভের উদ্দেশ্যে হাজারে আসওয়াদকে স্পর্শ করা। এটি একটি বেদায়াত।... কা’বা শরীফের সমস্ত আরকান (কোণ) এবং সমস্ত দেয়াল চুম্বন করা ও স্পর্শ করা’ একই রকমভাবে নাজায়েজ। আমি সব দেশের হাজীদের দেখেছি এই বেদায়াত করার জন্য তারা প্রায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। আমি কখনও দেখিনি [যতদিন গেছি সেখানে] ভয়াবহ সৌদি রক্ষীদের সেখানে কোন তা-ব চালাতে। আমাদের আরো অজ্ঞতার ও মূর্খতার আরেকটি উদাহরণ দিই। উলুধ্বনি দিলে আমরা মনে করি চারদিক হিন্দুত্বে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সেই অজ্ঞতার ধারক খালেদা জিয়া বলে বসলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলুধ্বনি চলবে। অর্থাৎ হিন্দুরা সব দখল করে নেবে। এই চরম সাম্প্রদায়িক উক্তির বিরোধিতাও তখন খুব কম বুদ্ধিজীবী করেছেন। সাম্প্রদায়িক এই মহিলা শিক্ষিত হলে এ কথা বলতেন না। কারণ উলুধ্বনি এসেছে আরবীয়দের কাছ থেকে, আনন্দ-ধ্বনি হিসেবে এবং এখনও তা প্রচলিত। সম্বোধন নিয়েও আমাদের মধ্যে সংস্কার আছে। মুসলমান কেউ নমস্কার বলবে না, কারণ হিন্দুরা বলে নমস্কার, যদিও এটি এক অর্থে সালাম বা প্রণাম। হিন্দুরা বরং অনেক বেশি দক্ষ এখন আসসালামালাইকুম বলায়, যার অর্থ আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। এটি আরবি শব্দ। অনেক হিন্দু আবার মনে করেন ধর্মনিরপেক্ষ আদাব ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু আদাব বাংলা বা সংস্কৃত নয়, আরবি। অনেকে এ সবের পরিবর্তে ব্যবহার করেন গুডমর্নিং, সেক্যুলার শব্দ হিসেবে। এই ইংরেজী সম্বোধনও এক অর্থে কুশল বিনিময়, যেমন সালাম বা নমস্কার বিনিময়। ভাষাকেও আমরা কিভাবে সাম্প্রদায়িক করে ফেলি! মাঝে মাঝে দেখি, আরবি আবওয়া পরে গম্ভীর মুখে অনেকে ঘোরাফেরা করছেন। তারা মনে করতেন এটিই বোধহয় মুসলমানি পোশাক। মধ্যপ্রাচ্যে সবাই পরে। সুতরাং, এ দেশে এটি পরে ঘোরাফেরা করে মুসলমানত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতেন। মূর্খদেরই এরকম ধারণা হয়। আরব দেশে ইসলাম প্রচারের আগেও মানুষ এ ধরনের পোশাক পরত। গরম ও লু থেকে বাঁচার জন্য। এর সঙ্গে মুসলমানত্বের কোন সম্পর্ক নেই। ॥ চার ॥ ইসলাম শান্তির ধর্ম বলি আমরা সবাই কিন্তু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোতেই অশান্তি এবং রাজ-রাজড়ার শাসন। ইসলাম শান্তির ধর্ম- এটি যদি মুসলমানরা অনুধাবন করতেন তা হলে তো এই অশান্তির সৃষ্টি হতো না। ধর্ম পালন করলে অশান্তি হয় না। ধর্মের সঙ্গে পার্থিব লোভ ও ক্ষমতার আকাক্সক্ষা যুক্ত হলে তখন আর ধর্ম পালন হয় না। ধর্ম ব্যবহার হয়। শেষ নবীর (দ:) মৃত্যুর পর থেকেই এর সূচনা কেন হলো। তিনি যে রকম জীবন যাপন করে গেছেন তার সাহাবীরা যে রকম জীবন যাপন করে গেছেন তাতে তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। খালিফা ওসমান (রা.) এর সময় থেকেই ক্ষমতা দখল নিয়ে এই রক্তারক্তির শুরু। অনেক আগে উপমহাদেশে মুসলমানদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব ও নেতা বিচারপতি সৈয়দ আমীর আলী বিখ্যাত একটি বই লিখে গেছেন ‘দি স্পিরিট অব ইসলাম’ নামে। দুঃখ করে তাতে তিনি লিখেছিলেন বিশ্বাসীরা দুঃখ পেতে পারেন মানবধর্ম কিভাবে আজ অশান্তিময় হয়ে উঠছে। বিশ্বে যাদের শান্তি আনার কথা তারাই সব দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। প্রায় ১০০ বছর আগে তিনি এ মন্তব্য করেছিলেন। তারা ভাষায়- Ò... to every Islamist devoted to the founder of his faith, it must cause sorrow and shame. Alas! that the religion of humanity and universal brotherhood should not have escaped the curse of internecine strife and discord that the faith which has to bring peace and rest to the distracted world should itself be torn to pieces by angry passions and the lust of power... in Islam, the evils that we shall have to describe arose from the greed of earthly advancement, and the revolutionary instinct of individuals and classes impatient of moral law and order. আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের এবং মিসরে ফাতিমিদের বিরুদ্ধে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলেছে তা আজকাল কেউ বলেন না। মুসলমান মুসলমানকে কী পরিমাণ নিধন করেছে তা বলার নয়। মুক্তচিন্তা থাকবে কী থাকবে না বা ইলমুল কালাম যাকে বলা হয় তা নিয়ে দ্বন্দ্বও শুরু হয়। আর আগে নবী (দ:) পরে উত্তরাধিকারী কে হবে তা নিয়েও দ্বন্দ্বের শুরু। এ প্রশ্নেই মুসলমানরা প্রথম দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় সুন্নি এবং শিয়াতে। আলীর সমর্থকরাই শিয়া মতবাদ বা শিয়াত ই আলীর উদ্যোক্তা। শিয়ারাও পরে অনেক উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। রসুলের (দ:) সময় দুই গোত্র বানী হাশেম ও বানী উমাইয়ার গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বও ইসলামে সংঘাতের শুরু করে। হাশেম বংশ প্রভাবশালী ছিল। যেহেতু ইসলামের বাণী তাদের মধ্য থেকেই অনেকে গ্রহণ করেছিলেন এবং উমাইয়ারা বিরোধিতা করেছিলেন ওসমান (রা.) ছাড়া। হাশেম বংশের আবুবকর ও উমর খলিফা হওয়ায় দ্বন্দ্ব এতটা তীব্র হয়ে উঠেনি। এরপর ওসমান (রা.)-এর খলিফা হলে পুরনো দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এছাড়া ইসলাম অনারব দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে আরবরা শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যে গর্ব করতেন অনারবরা তা মানতে রাজি ছিলেন না। ওসমান (রা.) বিরুদ্ধে প্রথমে বিক্ষোভ ও ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে কিন্তু তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন। তিনিই বলা যেতে পারে খাঁটি অর্থে রসুলের (দ:) বাণী উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘আমি মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে পারি না। রসুলুল্লাহর খলিফা হয়ে আমি কিভাবে জাতির রক্ত প্রবাহিত করব। আমি সেই খলিফা হতে চাই না। যিনি মুসলিম জাতির মধ্যে রক্তারক্তির সূচনা করবেন।’ খলিফা ওসমান যখন কোরান তেলাওয়াত করছিলেন তখন তাকে খুন করা হয়। তার রক্ত কোরানের যে আয়াতের ওপর পড়েছিল, লিখেছেন ইসলাম বিশেষজ্ঞ সা’দ উল্লাহ, ‘আল্লাহই তোমার জন্য যথেষ্ট; তিনি প্রাজ্ঞ, তিনি সব শোনেন।’ এরপর আলী (রা.) খলিফা হন। তার এক বছর বয়স থেকে নবী (দ:) তাকে লালন পালন করেন পুত্র স্নেহে। এরপর রসুলের (দ:) কন্যা ফাতিমার জন্ম। রসুল তাদের বিয়ে দেন। আলীকে সিরিয়ার শাসনকর্তা মাবিয়া না মানায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। রসুলের (দ:) পুত্রতুল্য আলী যুদ্ধ করেন রসুলের (দ:) প্রিয় স্ত্রী আয়েশার সঙ্গে। সেই শুরু যা এখনও বিভিন্ন ফর্মে চলছে। এই সমস্ত সংঘাত পর্যবেক্ষণ করে বিখ্যাত ঐতিহাসিক বার্নার্ড লুই যা মন্তব্য করেছেন তা যুক্তিযুক্ত। লিখেছেন তিনিÑ ÒWhenever a grievance or a conflict of interest created a faction in Islam, its doctrines were theology its instrument a sect, its agent a missionary, its leader usually a messiah or its representative. But to describe these socially motivated religious heresies as ÔcloaksÕ or ÔmasksÕ behind which men hid their real and material purposes in order to deceive the pious is to distort history. আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই বাক্যগুলো যখন পড়ি তখন জনাব গোলাম আযম বা জনাব আহমদ শফী বা বিভিন্ন চরের পীর যারা রাজনীতি করছেন তাদের কথা মনে পড়ে। তবে এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ পাকিস্তানের আবুল আলা মওদুদী যার খেদমতগার হচ্ছে আদালত কর্তৃক ক্রিমিনাল হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতী ইসলামীরা। ইসলামের ইতিহাসের খ- খ- চিত্র তুলে ধরলাম এ বিষয়টি অনুধাবনের জন্য যে, এই যে সংঘাত, একে অপরের চেয়ে বেশি ধার্মিক তা প্রমাণের চেষ্টা, পরিণামে জঙ্গী মৌলবাদের বিকাশÑ এর পেছনে যতটা না ধর্ম তার চেয়ে বেশি হচ্ছে পার্থিব লোভ, ক্ষমতা আহরণ ও কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা। যে কারণে লক্ষ্য করবেন মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ রাজতন্ত্রের অধীন, যা ইসলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। (চলবে)
×