ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আল বিদা মাহে রমজান

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১২ জুলাই ২০১৫

আল বিদা মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ রমজানুল মোবারকের আজ ২৪তম দিবস। মাহে রমজান আসলে আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আলোকিত হয়, আবাদ হয় মসজিদ। আমাদেরকে মাহে রমজানে সিয়াম সাধনার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ ও সামাজিক বিভিন্ন কাজের আঞ্জাম দিতে হবে। কারণ এত অখ- ইবাদত ও সেবার মানসিকতা বছরের অন্য সময় আসে না। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালবাসতে চায়, তার উচিত আমাকে ভালবাসা এবং যে ব্যক্তি আমাকে ভালবাসতে চায়, তার উচিত আমার সাহাবাদের ভালবাসা এবং যে ব্যক্তি আমার সাহাবাদের ভালবাসতে চায়, তার জন্য উচিত আমার কুরআনকে ভালবাসা এবং যে আমার কুরআনকে ভালবাসতে চায়, তার উচিত মসজিদকে ভালবাসা, কেননা মসজিদ আল্লাহর ঘর। আল্লাহ তায়ালা তার তাযীম করার হুকুম দিয়েছেন এবং এ কাজে বরকত রেখেছেন, তার বাসিন্দারাও বরকতময়। মসজিদ এবং মসজিদের বাসিন্দাগণ আল্লাহর হিফাযতে থাকে, যতক্ষণ তারা নামাযে মশগুল হয়। আল্লাহ তাদের সমুদয় প্রয়োজনও মেটান। যতক্ষণ তারা মসজিদে অবস্থান করে আল্লাহ তাদের মাল আসবাবের হিফাযত করেন (কুরতূবী, মা’আরিফুল কুরআন)। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় জেনে রাখা দরকার, কেউ যদি কোন যমীন মসজিদের জন্য ওয়াক্ফ করে দেয়, তখন ওই যমীন তারই মালিকানাধীন থাকবে, যতক্ষণ না সে যমীন রাস্তাসহ তার মালিকানা থেকে পৃথক করে দেয়, সকলের জন্য নামায আদায়ের ব্যাপক অনুমতি দেয়। মালিকানা থেকে পৃথক না করা পর্যন্ত তা পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর জন্য মসজিদ হিসেবে গণ্য হয় না। ওয়াকফের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তর করা একান্ত আবশ্যক। সকলের জন্য নামায আদায়ের অনুমতি না থাকলে প্রকৃত হস্তান্তর হয় না। তাই প্রকৃত ধর্মীয় মসজিদ বানানোর জন্য তথায় সর্বস্তরের মানুষের নামায আদায়ের ব্যাপক অনুমতি থাকা অত্যাবশ্যক। অনুমতির পর একজনও যদি সেখানে নামায আদায় করে মালিকের মালিকানা অধিকার চিরতরে শেষ হয়ে যায়, প্রতিষ্ঠিত হয় মসজিদের মর্যাদা। (হিদায়া, ২য় খ-)। কোন মসজিদ যদি ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয় তবে ওই মসজিদটি ভেঙ্গে পুনর্নির্মাণ করা জায়িয আছে (আদাবুল মাসাজিদ-মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া)। যদি এলাকায় জনমানবশূন্য হয়ে পড়ার কারণে কোন মসজিদ অবহেলিত হয়ে পড়ে বা ক্রমেই ভঙ্গুর দশায় পৌঁছে যায়, তথাপিও ওই মসজিদ কিয়ামত পর্যন্ত মসজিদই থাকবে, কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে সাব্যস্ত হবে না (শামী, বাহরুর রাইক)। বলা বাহুল্য, নামাযের মধ্যে সিজদা ব্যতীত গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক বিষয় আছে। যেমন কিরআত, রুকু ইত্যাদি। কিন্তু ‘সিজদা’ শব্দ হতে মসজিদের নামকরণের দ্বারা সিজদার অস্বাভাবিক গুরুত্ব/মর্যাদা প্রকাশ পেয়েছে। কারণ মানুষের সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন অঙ্গ মাথা মাটিতে ঠেকানোর অর্থ অন্তর হতে অহঙ্কার ও অহমিকা দূর করে আল্লাহর প্রভুত্বের সামনে চরম বিনয় প্রকাশ করা, সেদিকে লক্ষ্য করেই রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন- সিজদা অবস্থায় বান্দা তার প্রভুর সর্বাধিক সান্নিধ্যে যায় (মুসলিম, নাসাঈ)। মসজিদ একজন মুসলমানের মনে সর্বদা আল্লাহর সমীপে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের প্রেরণা সৃষ্টি করে আর এটি প্রত্যেক মুসলমানের চরম ও পরম লক্ষ্য। হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রচারিত ধর্মমতে, উপাসনালয় ইবাদত ও ভ্রাতৃময় সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে একটি পবিত্র প্রতীক। নচেৎ প্রয়োজনের তাগিদে যে কোন স্থান ইবাদত-বন্দেগীর স্থলে পরিণত করা হতে পারে। প্রত্যেক জায়গাই আল্লাহর নিকট সমান। আল্লাহর সামনে বিনয়ী ভাব, ধর্মানুষ্ঠানমূলক প্রার্থনার মাধ্যমে যা ব্যক্ত করা হয়, যে কোন স্থানে তা প্রকাশ করা যায়। তাই মহানবী (সা.) এরূপ বলেছেন যে, তাঁকে সমস্ত পৃথিবী মসজিদরূপে প্রদান করা হয়েছে। অথচ পূর্বের নবীগণ কেবল গীর্জা ও নির্দিষ্ট উপাসনালয় ব্যতীত অন্যত্র ইবাদত করার অনুমতি পাননি। তিনি আরও বলেছেন, ‘যেখানেই সালাতের সময় হবে, সেখানেই তুমি সালাত আদায় করবে এবং সেটাই একটি মসজিদ’ (মুসলিম, মসজিদ ২ঃ১)। এতদসত্ত্বেও মহানবী (সা.) ঐতিহ্যবাহী কা’বার উপাসনালয়ের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি যখন মদীনায় হিজরত করেন, তখন সেখানেও সালাত আদায় করার জন্য মসজিদ নির্মাণ করেন। উপরিল্লিখিত হাদীসের আলোকে এ কথা বলা যায় যে, মুসলিম জাতির জন্য সমস্ত পৃথিবী মসজিদস্বরূপ। মসজিদ মুসলমানদের ইবাদত, তালিম, দাওয়াত, প্রচার ও ইশাআতের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। অতএব গোটা বিশ্বই মুসলমানের দাওয়াত ও প্রচার ক্ষেত্র। মুসলমানের দাওয়াত চলবে বিশ্বের সর্বত্র। কারণ সমগ্র পৃথিবীটাই তার কর্মক্ষেত্র। তবুও যে জায়গা বা ঘর নিয়মিত সিজদা ও ইবাদতের জন্য সুনির্ধারিত হয়ে গেছে, তার মর্যাদা অতুলনীয় ; পবিত্র কাবা শরীফ, মদীনার মসজিদে নববী ও জেরুজালেমের বায়তুল মোকাদ্দাসের পর এসব ইবাদতগাহের স্থান। এজন্য বলা হয় মসজিদে অযথা কথা বললে চল্লিশ বছরের ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়। পবিত্র মাহে রমজানে আমরা যেন ইবাদত-বন্দেগীতে একতা ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে মসজিদকে প্রধান ও প্রিয়তম স্থান হিসেবে গ্রহণ করি।
×