ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘরে ঘরে জুতোর কারখানা বার্নিশের গন্ধ ॥ বদলে গেছে গ্রামের চিত্র

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১১ জুলাই ২০১৫

ঘরে ঘরে জুতোর কারখানা বার্নিশের গন্ধ ॥ বদলে গেছে গ্রামের চিত্র

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ ছোট ছোট টিনের ঘরে কারিগরদের নিরলস পরিশ্রম। কোন দিকে তাকানোর সময় নেই। আর ক’দিন বাদেই ঈদ। হাতে অর্ডার অনুযায়ী সরবরাহের জন্য মালামাল তৈরির প্রতিযোগিতা। তাই সবাই ব্যস্ত নিজেদের কাজে। ঘরের কোনে কোনে এখন এমনই ব্যস্ত সময় কাটছে রাজশাহীর চারঘাটের পাদুকাপল্লী হিসেবে খ্যাত কালুহাটি গ্রামে। কালুহাটি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার নিমপাড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা এখন বদলে গেছে পাদুকা শিল্পের সঙ্গে। শান্ত ও অপেক্ষাকৃত ছায়াঢাকা এ গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে এখন জুতা-স্যান্ডেলের কারখানা। কুটির শিল্পের আদলে গড়ে উঠেছে এসব কারখানা। এ কারখানার সুবাদেই কয়েক বছরের মধ্যে বদলে গেছে অভাবী এ গ্রামের চেহারা। এখন এ গ্রামে বলতে গেলে তেমন আর বেকার নেই কেউ। গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশত কারখানা। এখানে কাজ করছেন পরিবারের সবাই। ছেলে মেয়ে থেকে শুরু করে গৃহবধূরাও যুক্ত জুতা-স্যান্ডেল তৈরির কাজে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে এ কারখানায় কাজ করে তাদের হাত খরচের টাকা উপার্জন করছে। কিছু কিছু পরিবারের মেয়েরা কারখানা থেকে ফরমায়েশ নিয়ে নিজেদের বাড়িতে বসেই স্যান্ডেল তৈরির কাজ করছে। গ্রামের এ স্যান্ডেলের কারখানাকে কেন্দ্র করে মোড়ক তৈরি করেও অনেক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে। সব মিলিয়ে গ্রামের প্রায় অর্ধশত পরিবার কারখানা করে নিজেরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। আর তাতে তিন থেকে চারশ’ শ্রমিকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে এ গ্রামে। আশপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকে শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকার যুবকরা এসে এখানে কাজ নিয়েছেন। সারাবছরই কাজ হয় এখানে। তবে ঈদ সামনে রেখে নুতন করে সেজেছে জুতা-স্যান্ডেল তৈরির গ্রাম কালুহাটি। নতুন স্যান্ডেল বাজারে সরবরাহ করতে সরব হয়ে উঠেছে গ্রামের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি গ্রামের নারী-পুরুষ সমানে তৈরি করছেন বিভিন্ন মডেলের স্যান্ডেল। এসব জুতা স্যান্ডেল কারখানার মালিকরা জানান, এখন ঈদের মৌসুম। তাই কারও দম ফেলার সময় নেই। রাত-দিন সমান তালে চলছে জুতা স্যান্ডেল তৈরির কাজ। রোজার শুরু থেকে কয়েক দফায় জুতা-স্যান্ডেল বাজারে দিলেও পরবর্তী অর্ডারগুলো দিতে ঘাম ঝরাচ্ছেন শ্রমিকরা। তারা তৈরি করে যাচ্ছেন বিভিন্ন মডেলের আর নানা আকারের জুতা-স্যান্ডেল। অনেকেই এ স্যান্ডেল-জুতা তৈরির পর ওয়ারেন্টি দিয়ে বাজারজাত করছেন। বর্তমানে এখানে তৈরি স্যান্ডেল-জুতা বিভাগীয় শহর রাজশাহীর স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে কুষ্টিয়া, নাটোর, ঈশ্বরদী, খুলনা, যশোর ও বগুড়া পাবনাসহ রাজধানী ঢাকায় বাজার দখল করেছে। কারখানা শোরুমেও বিক্রি হচ্ছে জুতা- স্যান্ডেল। বর্তমানে কালুহাটির গ্রামের ৩৭টি কারখানার তৈরি হচ্ছে জুতা স্যান্ডেল। এখান থেকে উত্তারঞ্চলের বেশির ভাগ জেলাতে যাচ্ছে কালুহাটি গ্রামের জুতা-স্যান্ডেল। এতে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন বলে জানালেন জুতা-স্যান্ডেল কারখানার মালিকরা। গ্রামে গড়ে ওঠা জুতা-স্যান্ডেল কারখানা মালিকদের নিয়ে গঠিত কমিটির সভাপতি আব্দুল মান্নান জানান, এ গ্রামে গড়ে ওঠা ৩৭টি কারখানায় তৈরি জুতা-স্যান্ডেলের সুনাম রয়েছে সারাদেশেই। গত বছর চারঘাট-বাঘার সাংসদ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এ গ্রামের শিল্পের প্রসার ঘটাতে স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ঋণের সেই টাকা হাতে পাওয়ায় কারখানা মালিকরা এ বছর রেকর্ড পরিমাণ জুতা স্যান্ডেল তৈরি করছেন। পেছনের কথা ॥ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় এক দশক পরেও এ কালুহাটি গ্রামের বেশির ভাগ পরিবার ছিল নিম্নআয়ের। ওই সময় গ্রামের অত্যন্ত অভাবী পরিবারের ১০Ñ১১ বছরের ছেলে আমিরুল ইসলাম আর বারিক ঢাকায় গিয়ে কাজ নেন একটি জুতা-স্যান্ডেলের কারখানায়। টানা ৯ বছর সেখানেই কাজ করেন। ১৯৮৫ সালের দিকে আমিরুলের মাথায় আসে, এ কাজ তারা গ্রামের মানুষকে শেখালে গ্রামের অভাব দূর করা সম্ভব। তিনি গ্রামে চলে আসেন কিন্তু তখনও তার একটি কারখানা করার মতো পুঁজি হয়নি। তিনি গ্রামের মানুষকে ব্যবসায়ের সম্ভাবনার কথা বোঝালেন। কিন্তু ব্যবসা চলবে কিনাÑ এ আশঙ্কায় কেউ এগিয়ে আসতে চায় না। এমন সময় এগিয়ে এলেন গ্রামের বেকার যুবক নওশাদ আলী সরকার। তিনি কারখানায় পুঁজির যোগান দিলেন। একটি ঘর নিয়ে তারা কারখানা শুরু করেন। শুরু হলো কাঁচামাল কিনে নিয়ে এসে জুতা-স্যান্ডেল তৈরি আর বাজারে বিক্রি। এভাবে দিনে দিনে ব্যবসার সম্ভাবনার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৫ কারখানায় ব্যস্ত কারিগর ॥ জেলার কালুহাটি গ্রাম থেকে এখন রাজশাহী নগরীতেও গড়ে উঠেছে জুতা-স্যান্ডেলের কারখানা। নগরের লক্ষীপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৫টি দোকান কাম শো-রুমে কাজ চলছে। মালিক কারিগর সবাই ব্যস্ত এখানেও। বছরের এ মৌসুমেই সবচেয়ে বেশি কাজ হয়। নগরীর নি¤œবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের জুতা-স্যান্ডেলের চাহিদা মেটায় এই মানুষগুলো।
×