ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ॥ শিল্প খাত

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ১০ জুলাই ২০১৫

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ॥ শিল্প খাত

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ বছর বাজেট প্রস্তাবনার শেষ পর্যায়ে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের আয়-ব্যয় বিবরণী বা বাজেট দুই খণ্ডে উপস্থাপিত করেছেন। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি একক সরকারবিশিষ্ট রাষ্ট্র হওয়ায় ৩ বছর আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের আয়-ব্যয় বিবরণী বিস্তারিতভাবে উপস্থাপনের দাবি আমি সংসদে উপস্থাপিত করেছিলাম। সেই দাবির অংশ পূরণক্রমে অর্থমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। দুটি খ-ে বিবৃত ‘রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের বাজেট ২০১৫-১৬’-তে সর্বমোট ৪৪টি অ-আর্থিক জনকর্পোরেশনসমূহের আয়-ব্যয় সংশ্লিষ্ট বিবরণাদি গ্রন্থিত হয়েছে। এসব কর্র্পোরেশনের মধ্যে ৬টি শিল্প, ৫টি বিদ্যুত, গ্যাস ও পানি, ৭টি পরিবহন ও যোগাযোগ, ৩টি বাণিজ্য, ২টি কৃষি ও মৎস্য, ৫টি নির্র্মাণ এবং ১৬টি সেবামূলক সেক্টরে বিদ্যমান। বক্ষ্যমাণ বিশ্লেষণে শিল্পক্ষেত্রে বিদ্যমান ৬টি কর্র্পোরেশনের বিবরণ ও উপাত্তাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পক্ষেত্রে ২০১৫-১৬ সালে ৪২৩৪.১৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে বলে বলা হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে এ বিনিয়োগের মাত্রা হয়েছিল ১৮৭৭.২৮ কোটি টাকা। এর অর্থ ২০১৪-১৫ সালের তুলনায় ২০১৫-১৬ সালে বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির হার হবে শতকরা ৫৫.২৮ ভাগ। পরিবহন ও যোগাযোগ সেক্টরে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি ১৯৪.৩৪ শতাংশের তুলনায় শিল্প খাতে বিনিয়োগের এই প্রক্ষেপিত মাত্রা কম। ২০০২-২০০৮ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ ছিল নিম্নতম। শিল্প সেক্টরে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত কর্পোরেশনের মধ্যে বস্ত্র শিল্প কর্পোরেশন অন্যতম। বস্ত্র শিল্প কর্পোরেশনের মালিকানায় ৮টি মিলের ১০টি শিল্প ইউনিট চালু আছে। আগের সরকারের বি-রাষ্ট্রীয়করণের নীতি অনুযায়ী এই কর্পোরেশনের ১৪টি মিল ব্যক্তি-মালিকানায় ও ৯টি মিল শ্রমিক-কর্মচারীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে এই কর্পোরেশনের মোট সম্পদের (ঋণ+সমমূলধন) পরিমাণ ছিল ৪৭৫৫ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে এই সম্পদের মাত্রা ৪৮০১ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এই সম্পদের বর্তমান ঋণ : সমমূলধন অনুপাত ৯১:৯। কর্পোরেশনের মালিকানাধীন প্রকৃত সম্পদাদির (জমি+কারখানা) বাজার মূল্য ঋণ ও সমমূলধনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বলে জানা গেছে। কর্পোরেশনের ২০১৪-১৫ সালের সংশোধিত ও ২০১৫-১৬ সালে প্রাক্কলিত বাজেটে যথাক্রমে ২৩.৯৭ কোটি টাকা এবং ২৪.৮২ কোটি টাকা নিট লোকসান হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। জোট সরকারের আমলে বাৎসরিক লোকসান এর চেয়ে বেশি হয়েছে বলে জানা গেছে। ২০১৪-১৫ সালের সংশোধিত এবং ২০১৫-১৬ সালের প্রাক্কলিত বাজেটে কর্পোরেশনের নীট ঘাটতির পরিমাণ যথাক্রমে ২৬.৪০ কোটি ও ৩৪.৫৬ কোটি টাকায় প্রাক্কলিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও ২০১৪-১৫ সালের সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী এই কর্র্পোরেশনে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ সালে এই বিনিয়োগ ১১ কোটি টাকা হবে বলে বলা হয়েছে। কর্পোরেশন আবগারি শুল্ক, সরকারী ঋণের সুদ, লাইসেন্স ফি ইত্যাদি বাবদ ২০১৪-১৫ সালে ২.১৭ কোটি এবং ২০১৫-১৬ সালে ২.৪৭ কোটি টাকা সরকারী কোষাগারে জমা করেছে বা করবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে ৭৬৭১টি মঞ্জুরিকৃত পদের বিপরীতে ৩৩৩৩ জন কর্মচারী ও শ্রমিক হিসেবে এই কর্পোরেশনে কাজ করবেন বলে স্থিরিকৃত হয়েছে। দেশে ব্যক্তি খাতে বস্ত্র শিল্প লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। লাভজনকতার নিরিখে ব্যক্তি খাতে নতুন ইউনিট বস্ত্র ও সংশ্লিষ্ট উপখাতে স্থাপন করার লক্ষণীয় চাহিদা দেখা গেছে। এই প্রেক্ষাপটে বস্ত্র শিল্প কর্পোরেশনকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার জন্য বস্তুনিষ্ঠ সমীক্ষা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে এই প্রয়োজন স্বীকার করে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার কোন প্রস্তাব স্থান পায়নি। এই কর্পোরেশন কর্তৃক বিরাষ্ট্রীয়কৃত ইউনিটসমূহের বিপরীতে পূর্ণ বিক্রয়মূল্য সব ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে বলে জানা যায়নি। এ তথ্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই প্রতিবেদনে স্থান পায়নি। ৭৮টি পাটকলসহ বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের যাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৭২ সালে। ১৯৭৮ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত এই কর্পোরেশনের ৪৩টি পাটকল থেকে পুঁজি প্রত্যাহার এবং এর আওতায় ২টি নতুন কার্পেট কারখানা ও দুটি পাটবহির্ভূত প্লান্ট স্থাপন করা হয়। এর বাইরে গালফা-হাবীব লিমিটেড নামে একটি যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থা হতে এই কর্পোরেশনে ন্যস্ত করা হয়। খালেদা জিয়ার জোট সরকারের আমলে পাইকারিহারে পুঁজি প্রত্যাহার বা বিরাষ্ট্রীয়করণ ঘটে। আদমজী পাটকল থেকে যথার্থ বিবেচনা ছাড়া পুঁজি প্রত্যাহার এই সময়েই ঘটে। বর্তমানে এই কর্পোরেশনের আওতায় ৩টি পাটবহির্ভূত প্লান্টসহ ২৭টি মিল বিদ্যমান। পাটকল কর্পোরেশনের প্রধান উৎপাদন দ্রব্য হচ্ছে হেসিয়ান (চট), সেকিং (বস্তা), সিবিসি (কার্পেটতলী) ও ইয়ার্ন (সুতা)। তিনটি পাটবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানে ফাইবার গ্লাসভিত্তিক পণ্য, টিউব ও পাটকলের খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপন্ন করা হয়। ৩০ জুন ২০১৫ সালে পাটকল কর্পোরেশনের মোট সম্পদের (ঋণ+সমমূলধন) পরিমাণ ছিল ৪৮০২.৭৬ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে এই সম্পদের পরিমাণ ৫৫৭০.৯৬ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। কর্পোরেশনের মালিকানাধীন প্রকৃত সম্পদাদির (জমি+কারখানা) বাজার মূল্য এর চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে বলে ওয়াকিফহাল মহলের ধারণা। ২০১৪-১৫ সালে আমদানি শুল্ক, মূসক, রফতানি কর ইত্যাদি বাবদ এই কর্পোরেশন সরকারী কোষাগারে ৩১.৩১ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০১৫-১৬ সালে এই জমার পরিমাণ ৪০.৪৩ কোটি টাকা হবে। ২০১৩-১৪ সালে এই কর্পোরেশনের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৪৫৩৩৮। ২০১৫ সালে এই জনবল ৪৫৮৩৭ জনে দাঁড়াবে বলে হিসাব করা হয়েছে। ২০১৩-১৪ সালে এই কর্পোরেশনের পরিচালন লোকসান হয় ৪৩৫.৩২ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ সালে পরিচালন লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬৬.৩১ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে কর্পোরেশনের নীট লোকসানের পরিমাণ কমে ৪০৩.৭০ কোটি টাকা হবে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে কর্পোরেশনের তহবিল ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫৭.৫৮ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে তহবিল উদ্বৃত্তের পরিমাণ ৮৩.৭৬ কোটি টাকা হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। বিশ্ব বাজারে পাটের চাহিদা কমে যাওয়া এবং দেশে পাটের উৎপাদন ব্যয় বাড়া ও ফলত (কাঁচা) পাটের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে পাটকল কর্পোরেশনে লোকসান হচ্ছে বলে অন্যান্য প্রতিবেদনে বিদিত হয়েছে। পাটকলসমূহের লোকসান কমানো ও পুনর্বাসনের জন্য ১৯৮০-এর দশকের বিশ্বব্যাংক প্রণীত সুপারিশমালা ফলদায়ক হয়নি। বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের আওতায় বর্তমানে ৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শুরুতে এর আওতায় দেয়া ৬৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে পুঁজি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে এই কর্পোরেশনের মোট সম্পদের (সমমূলধন ও ঋণ) পরিমাণ ২৯১৯ কোটি টাকা হিসাব করা হয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে এই কর্পোরেশনের মোট সম্পদের পরিমাণ ৩৩৭১.২ কোটি টাকা হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। কর্পোরেশনের মালিকানাধীন প্রকৃত সম্পদের (জমি+কারখানা) মূল্য এর চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে। এই কর্পোরেশন শুল্ক, কর ইত্যাদি বাবদ ২০১৪-১৫ সালে ২২৬ কোটি টাকা সরকারী কোষাগারে জমা দিয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে সরকারী কোষাগারে তেমনি ৩২৩.২ কোটি টাকা জমা হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এটা উল্লিখিত হয়নি। ২০১৪-১৫ সালে এই কর্পোরেশনের মোট বিক্রয় রাজস্ব ৭৬৩ কোটি টাকা হয়েছে বলে বিদিত হয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে এর পরিমাণ প্রায় ১০০৭ কোটি টাকা দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে এই কর্পোরেশনের পরিচালন মুনাফা ৮৪ কোটি টাকা হয় বলে বিদিত হয়েছে। একই সালে নীট মুনাফা হয়েছে ৫৮.৩৪ কোটি টাকা। বিনিয়োগকৃত সম্পদের বিপরীতে এই লাভ বা ফিরতি শতকরা ১.৭৩ ভাগের চেয়ে বেশি না। আগামী বছরে এই অংকের পরিমাণ ৭৩.৩৮ কোটি টাকা হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। উল্লিখিত বিনিয়োগের বিপরীতে এই ফিরতির হারও সন্তোষজনক নয়। বর্তমানে এই কর্পোরেশনের লোকবল ২১৮৭ জন। ২০১৬ সালে এই লোকবল ২৪৫৭ জনে দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এই কর্পোরেশন পুঁজি প্রত্যাহারকরণের প্রক্রিয়ায় সব পাওনা বা বিক্রয় মূল্য আদায় করতে পেরেছে বলে জানা যায়নি। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের কর্তৃত্বাধীনে এখন ২০টি শিল্প ইউনিট বিদ্যমান। শুরুতে এই কর্পোরেশনের আওতায় ৬৯টি ইউনিট ছিল। এদের থেকে ৪৭টি ইউনিটের পুঁজি প্রত্যাহার করে সেসব ব্যক্তি মালিকানায় দেয়া হয়েছে। পুঁজি প্রত্যাহারের সিংহভাগ ঘটেছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত জোট সরকারের সময়। যে ২০টি শিল্প ইউনিট এই কর্পোরেশনের আওতায় বর্তমানে আছে তার মধ্যে ১৫টি ইউনিট চিনি উৎপাদনে, ১টি মৎস্য প্রক্রিয়াকরণে ও ১টি প্রকৌশলীয় ক্ষেত্রে নিয়োজিত এবং ৩টি ইউনিট অচল অবস্থায় রয়েছে। ৫টি চিনিকলের অধীনে প্রায় ১৬ হাজার একর সংবলিত আখ চাষের জমি রয়েছে। কর্পোরেশনের প্রকৃত সম্পদ (জমি+কারখানা) বাজার মূল্যে বহুগুণ বেশি হবে। ২০১৪-১৫ সালে এই কর্পোরেশনের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২২৩৯ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে এই সম্পদ (ঋণ ও সমমূলধন) ২২৫৩ কোটি টাকা হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। কর্পোরেশনের প্রকৃত সম্পদ (জমি+কারখানা) বাজার মূল্যে বহুগুণ বেশি হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই প্রতিবেদনে এটা উল্লিখিত হয়নি। ২০১৪-১৫ সালে এ কর্পোরেশনের পরিচালন লোকসান হয় ৩৫৪ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে এ লোকসান ৩০ কোটি টাকায় নেমে আসবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে এর নীট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৫২৩ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে নীট লোকসান ৪৩৩ কোটি টাকায় নেমে আসবে বলে বলা হয়েছে। যে কোন বিবেচনায় বিনিয়োগকৃত মূলধনের বিপরীতে এই মাত্রার ফিরতি গ্রহণীয় নয়। এই কর্পোরেশন ২০১৪-১৫ সালে শুল্ক, কর ইত্যাদি বাবদ সরকারী কোষাগারে ৯১.৯২ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে সরকারী কোষাগারে দেয় টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ১১০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ সালে এই কর্পোরেশনের জনবল ছিল ১৫৮২৪। ২০১৫-১৬ সালে এই জনবল ১৬১৮৯ জনে বাড়বে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। কর্পোরেশনের বিরাষ্ট্রীয়কৃত ইউনিটসমূহের বিপরীতে পূর্ণ মূল্য আদায় হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। বিরাষ্ট্রীয়করণের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল কিনা তাও বলা মুশকিল। বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন চালু শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৩টি। প্রথমদিকে এর নিয়ন্ত্রণাধীন ৮৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। ইতোমধ্যে ৭০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ইতোমধ্যে উত্থাপিত হয়েছে। এ ধরনের হস্তান্তর সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ঘটেছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত জোট সরকারের সময়। একই সময়ে এ কর্পোরেশনের ৫টি নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান যথা : (১) ইনসুলেটর ও সেনিটারি ওয়ার ফ্যাক্টরি (২) পলাশ সার কারখানা (৩) চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কোম্পানি (৪) যমুনা সার কোম্পানি ও (৫) ঢাকা লেদার কমপ্লেকস প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের ৩০ জুন এ সংস্থার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০৪৬১.৯ কোটি টাকা । এ সম্পদের শতকরা ৭৬ ভাগ ঋণ এবং ২৪ ভাগ সমমূলধন অবয়বে যোগান হয়েছে। ৩০ জুন ২০১৫ সালে এর সম্পদের পরিমাণ ১৩৯৪৯ কোটি টাকা দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে, কর্পোরেশনের প্রকৃত সম্পদের বাজার মূল্য বহুগুণ বেশি হবে। ২০১৪-১৫ সালে শুল্ক, কর ইত্যাদি বাবদ এ কর্পোরেশন ৩০৮ কোটি টাকা সরকারী কোষাগারে জমা দিয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে এই জমার পরিমাণ ৩৪৪ কোটি টাকা দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে এ কর্পোরেশনের পরিচালন লোকসান দাঁড়িয়েছে ১১০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ সালে লোকসান হয়েছে ৪৫ কোটি টাকারও বেশি। ২০১৩-১৪ সালে সংস্থাটির নীট মুনাফা হয়েছিল ৯৩.৬৯ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে নীট মুনাফার পরিমাণ ৩৪৪.১২ কোটি টাকা হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। বিনিয়োগের বিপরীতে এ ধরনের ফিরতি সামান্য। ২০১৩-১৪ সালে কর্পোরেশনের নীট মুনাফা হয়েছিল ৯৩.৬৯ কোটি টাকা। ওই সালের তুলনায় ২০১৪-১৫ সালে কেন নীট লোকসান হলো তার কোন গ্রহণযোগ্য কারণ জানা যায়নি। ২০১৫-১৬ সালে এ কর্পোরেশনের পরিচালন মুনাফা ৩৩৬ কোটি টাকা হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে। ব্যক্তিমালিকানায় প্রদত্ত শিল্প ইউনিটগুলো থেকে সকল ক্ষেত্রে পূর্ণ মূল্য আদায় করা হয়নি। বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের আওতায় বর্তমানে ৭টি শিল্প ইউনিট ও ১৭টি রাবার বাগান বিদ্যমান। এসব রাবার বাগান থেকে উৎপাদিত রাবার দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৬৫ ভাগ পূরণ করে আসছে। শিল্প খাতে কর্পোরেশনের ৭টি শিল্প ইউনিট চালু রয়েছে এবং ২টি নতুন ইউনিট স্থাপনের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের ৩০ জুন কর্পোরেশনের মোট সম্পদ (ঋণ+সমমূলধন) ৩৬০.৬৬ কোটি টাকায় হিসাবকৃত হয়েছে। ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ৩৮০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। কর্পোরেশনের মালিকানাধীন মোট প্রাকৃতিক সম্পদের (জমি+কারখানা) বাজার মূল্য এর চেয়ে বহুগুণ বেশি। ২০১৪-১৫ সালে কর্পোরেশনটির নীট মুনাফা ১১.৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে এর পরিমাণ ১৫.৮৩ কোটি টাকা হবে বলে বলা হয়েছে। বিনিয়োগের বিপরীতে লাভ বা ফিরতির এই অংক শতকরা ৮.৩৩ ভাগ। শিল্প খাতের সকল রাষ্ট্রীয় কর্পোরেশনের তুলনায় এ ফিরতির হার সবচেয়ে বেশি। এ কর্পোরেশন শুল্ক কর এবং সরকারী ঋণ পরিশোধন ও লভ্যাংশ বাবদ ২০১৪-১৫ সালে সরকারী কোষাগারে ১২.৫৬ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে এ জমার পরিমাণ ১৫.২২ কোটি টাকায় উঠবে বলে হিসাব করা হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে এ কর্পোরেশনের জনবল ছিল ৩১৩২ জন। ২০১৫-১৬ সালে এ সংখ্যা ৩৪৩২ জন হবে বলে বলা হয়েছে। এবারকার সরকারের বাজেটের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সেক্টরের উপরোক্ত ৬টি কর্পোরেশন সম্পর্কিত আয়-ব্যয় সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি পর্যালোচনা করলে কতিপয় বিষয়ে সুস্পষ্ট দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। এক. ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের ফলশ্রুতি হিসেবে শিল্প সেক্টরে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে যে সারথির ভূমিকা পালন প্রত্যাশিত ছিল তা এসব শিল্প ইউনিট পালন করতে সমর্থ হয়নি। বর্তমানে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে বা জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান প্রায় ৩১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের শিল্প উৎপাদনে অবদান রাষ্ট্র খাতের শিল্পের অবদানের চাইতে অনেক বেশি। এই ধারা অব্যাহত থাকবে। বস্তুত সমকালে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প দিয়ে ব্যক্তি খাতের শিল্প বিকল্পায়িত করার কোন সম্ভাবনা নেই। দুই. রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাত থেকে পুঁজি প্রত্যাহারকৃত শিল্প ইউনিটের বিপরীতে বিভিন্ন কর্পোরেশন বা সরকারের যা পাওনা ছিল তা সর্বাংশে সকল ক্ষেত্রে আদায় করা হয়নি বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে যথা প্রয়োজন প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে পুঁজি প্রত্যাহার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বিষয়ক প্রশ্নাদির উত্তর জাতির কাছে উপস্থাপনীয়। যারা এক্ষেত্রে কারচুপি বা অবহেলা করেছে তারা জনগণের সঙ্গে বেইমানী করেছে বলে তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় আইনী পদক্ষেপ নেয়া ন্যায়সঙ্গত হবে। তিন. রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কর্পোরেশনে সরকারের বিনিয়োগের বিপরীতে আহরিত লভ্যাংশ খুবই কম। একই ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিনিয়োগ সাধারণভাবে যে লভ্যাংশ অর্জন করছে তার তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ইউনিটসমূহ কর্তৃক আহরিত লভ্যাংশ নিম্নতম। পরিচালন নিপুণতা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা গভীরভাবে পর্যালোচনা করে এক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার পরিধি যথেষ্ট বিস্তৃত। চার. আর্থিক ব্যবস্থাপনার সূত্র অনুযায়ী অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ইউনিটের মূলধন কাঠামো পরিবর্তন করা প্রয়োজন। যেসব ইউনিটের ক্ষেত্রে সার্বিক মূলধনের মধ্যে ঋণ-মূলধন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে আছে সেসব ইউনিটের ক্ষেত্রে ঋণ-মূলধনের লাগসই অংশ সুষ্ঠু হিসাবের সূত্র অনুযায়ী সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সমমূলধনে রূপান্তরিত করা প্রয়োজন। এরূপ রূপান্তরকরণের পর ঋণের বিপরীতে সুদের পরির্বতে প্রদানীয় সমমূলধনের বিপরীতে আহরণীয় লভ্যাংশ বাড়ানোর জন্য সরকারের তৎপর হওয়া আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাঞ্ছনীয় হবে বলে মনে হয়। পাঁচ. কতিপয় শিল্প ইউনিটের ক্ষেত্রে তাদের সরবরাহ ও বিক্রয় প্রণালীতে ১৯৭৫-৯৬ এবং ২০০২-২০০৮ এ দুই কালে সৃষ্ট কায়েমী স্বার্থের উপসর্গ ও উপকরণসমূহ দৃঢ়হস্তে নিরুৎসাহিত ও দমন করা সঙ্গত হবে। এ লক্ষ্যে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃক নির্বাচিতভাবে কৃতী-নিরিখ (চবৎভড়ৎসধহপব ধঁফরঃ) পরিচালন উত্তম হবে। একই সাথে যেসব শিল্প ইউনিট অচল রয়েছে এবং যাদের অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই সেসব ক্ষেত্রে যথা প্রয়োজন বিদ্যমান জনবল যুক্তিকরণ করা এবং মূলধন যন্ত্রপাতির লাভজনক হস্তান্তরের কার্যক্রম হাতে নেয়া যুক্তিযুক্ত হবে। ছয়. যেসব শিল্প ইউনিটের প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ কিংবা পরিবর্তনশীল বাজারের নিরিখে উৎপাদন বিচিত্রকরণ প্রয়োজন সেসব ক্ষেত্রে দ্রুত যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ইউনিটসমূহ যদি সংশ্লিষ্ট খাতে নতুনতর প্রযুক্তি প্রবর্তন ও ব্যবহারে সারথির ভূমিকা পালন করে তাহলে ব্যক্তি খাতের শিল্পসমূহ তা অনুসরণ করবে এবং সার্বিকভাবে শিল্প বিনিয়োগ ও উৎপাদন অধিকতর ফলপ্রসূ হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের এই ঈপ্সিত ভূমিকার প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের মনোযোগ দেয়া বিধেয়। এই প্রেক্ষিতে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতি প্রধানমন্ত্রী যে আহ্বান জানিয়েছেন সে আহ্বানে যথাযথ সাড়া দেয়া রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পক্ষেত্রে সময়ের দাবি হিসেবে গ্রহণ ও অনুসরণ করতে হবে। লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা
×