ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেপরোয়া বাসের চাপায় প্রাণ গেল স্কুলছাত্র ফাহিমের

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৯ জুলাই ২০১৫

বেপরোয়া বাসের চাপায় প্রাণ গেল স্কুলছাত্র ফাহিমের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঈদের আনন্দ বিষাদে পরিণত হলো। নানা-নানি আর মামা-মামির ঈদের উপহার নেয়া হলো না। ঢাকায় নানার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই বেপরোয়া গতির বাসের চাপায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ফাহিম আহমেদ। শোকে পাথর গোটা পরিবার। আর কোনদিনই ঢাকায় আসবেন না বলে চিৎকার দিয়েই মূর্ছা গেলেন ফাহিমের মা। বাসের ধাক্কায় ফাহিমের রক্তে পিচ ঢালা কালো রাস্তা মুহূর্তেই লাল হয়ে যায়। কচি শরীর ফেঁটে ভেতরের কলিজা বের হয়ে রাস্তায় পড়ে। এমন দৃশ্য দেখে শত শত মানুষ উত্তেজিত হয়ে একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর অপর বাসটি ভাংচুর করে। প্রায় এক ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে রাখে জনতা। পরে অতিরিক্ত পুলিশসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে রাজধানীর ধানম-িতে আনোয়ার খান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সামনে মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটে। নিহত ফাহিম গাজীপুরের শ্রীপুর থানাধীন পলাতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিল। তার পিতার নাম জাহাঙ্গীর আলম পলাশ (৪২)। বাড়ি গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানাধীন ডুমনী গ্রামে। তিনি শ্রীপুর বাজারের চা দোকানি। মা ঝর্ণা বেগম (৩৬)। গৃহিণী। দুই ছেলে। বড় ছেলে পাভেল আহমেদ (১৬)। রাজধানীর হাতিরপুলের ইস্টার্ন প্লাজার একটি দোকানের বিক্রয় কর্মী। ফাহিমের নানার বাড়ি গণকটুলী বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এক নম্বর ফটকের কাছে। ২০/২১/সি নম্বর নানার নিজস্ব বাড়িতেই যাচ্ছিল ফাহিম। ফাহিমের মা ঝর্ণা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতি বছরই ঈদে ঢাকায় যাই। বাবার বাড়ি ঢাকায় হওয়ায় এবং বড় ছেলে ঢাকায় কাজ করায় আসতে হয়। এতে বড় ছেলেকে দেখা, বাবার বাড়িতে বেড়ানো এবং কেনাকাটা সবই হয়। এবারও ফাহিমের নানা-নানি, মামা-মামিরা যথারীতি ঢাকায় আসতে বলে। বুধবার সকালেই ফাহিমকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হই। গাজীপুর থেকে আজিমপুরগামী ২৭ নম্বর ভিআইপি পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসে ঢাকায় আসছিলাম। আমাদের নামার কথা ছিল আজিমপুর বাসস্টেশনে। কিন্তু বাসটি আনোয়ার খান মেডিক্যাল কলেজের সামনে এসে নষ্ট হয়ে যায়। বাসের হেলপার যাত্রীদের ভিআইপি পরিবহনেরই আরেকটি বাসে তুলে দেয়ার জন্য চেষ্টা করছিলেন। আমরাও রাস্তার পাশেই অপেক্ষা করছিলাম। ছোট্ট ফাহিম নষ্ট হওয়া বাসটির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এর পরের দৃশ্য বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ফাহিমের মা। ফাহিমের বড় ভাই পাভেল বলছিল, নানার বাড়িতে থেকেই আমি ঢাকায় চাকরি করি। ঈদে বেতন বোনাস পেয়েছি। মা ও ছোট ভাইকে ঈদে নতুন জামা কাপড় কিনে দেব। এ জন্য তাদের ঢাকায় আসতে বলি। এছাড়া প্রতিবছরই নানা-নানি, মামা-মামিরা ঈদে আমাদের নতুন জামা কাপড় কিনে দেয়। এ জন্য প্রত্যেক বছরই আগে আমাকে নিয়ে মা ঢাকায় নানার বাড়িতে বেড়াতে আসত। এখন আমি ঢাকায় চাকরি করায় ছোট ভাই ফাহিমকে নিয়ে আসে। আদরের ছোট ভাইকে আর কোনদিনই নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতে পারব না। আদর করতে পারব না। ভাই বলতে আমার আর কেউ রইল না। বলেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে হাউমাউ করে কাঁদছিল। ফাহিমের লাশ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নষ্ট বাসটির সামনে দাঁড়িয়ে আরেকটি বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা ফাহিমকে বেপরোয়া গতির ট্রান্সসিলভা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস সজোরে ধাক্কা দেয়। মুহূতেই ফাহিম রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। রাস্তা রক্তে ভিজে যায়। ফাহিমের বুক ফেঁটে কলিজা বেরিয়ে রাস্তায় পড়ে। ফাহিম আর তার মাসহ আশপাশের মানুষ চিৎকার দিলে শত শত মানুষ জড়ো হয়ে যায়। ফাহিমের মায়ের গগন বিদারী আর্তনাদে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে যায়। জড়ো হওয়া জনতা উত্তেজিত হয়ে বাস দুইটিতে ভাংচুর চালাতে থাকে। বাস দুইটির হেলপাররা দ্রুত ভিড়ের মধ্যে মিশে পালিয়ে যায়। উত্তেজিত জনতা ফাহিম ও তার মাকে বহনকারী গাজীপুর থেকে আজিমপুরগামী ২৭ নম্বর ভিআইপি পরিবহনের যাত্রীবাহী ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৭৫৪১ নম্বর বাসটি ভাংচুরের পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফায়ার সার্ভিসের দুইটি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে বলে জানান, ফায়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জনকণ্ঠকে জানান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উত্তেজিত জনতা ট্রান্সসিলভা পরিবহনের অপর বাসটিও ভাংচুর করে। ট্রান্সসিলভা পরিবহনের বাসটি ভাংচুরকালে পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়। পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে উত্তেজিত জনতা বাসটিতে আগুন দেয়া থেকে বিরত থাকেন। এমন ঘটনায় প্রায় এক ঘণ্টা ওই রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। ঈদে কেনাকাটা করতে আসা মানুষদের ভোগান্তি ছিল চরমে। ধানম-ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরে আযম মিয়া জনকণ্ঠকে জানান, দুই চালকসহ বাস দুইটি জব্দ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। তবে কোন চালকই হত্যার দায় স্বীকার করেনি। একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে।
×