ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অভিজিতের ঘাতকরা এখনও দেশেই আত্মগোপনে

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৮ জুলাই ২০১৫

অভিজিতের ঘাতকরা এখনও দেশেই আত্মগোপনে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে বহুল আলোচিত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও সাম্প্রদায়িকবিরোধী লেখক প্রকৌশলী ড. অভিজিত রায় হত্যা মামলা। হত্যাকা-ের সঙ্গে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত। টিমের সাত সদস্যকে ইতোমধ্যেই শনাক্ত করা হয়েছে। হত্যাকারীদের বয়স ত্রিশ বছরের মধ্যে। যারা এখনও বাংলাদেশেই আত্মগোপনে রয়েছে। হত্যাকারীদের অনেকেরই ছবিও পেয়েছে ডিবি পুলিশ। শুধু গ্রেফতারের অপেক্ষা। এরপরই বেরিয়ে আসবে অভিজিত রায় হত্যার প্রকৃত রহস্য। বাংলাদেশে আসার পর চার থেকে অন্তত পাঁচ বার অভিজিতকে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছিল খুনীরা। সুবিধাজনক জায়গা না পেয়ে সেসব মিশন ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত প্রচ- ঝুঁকি নিয়েই শত শত মানুষের ভিড়েই খুবই দ্রুততার সঙ্গে দুইজন চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটায়। হত্যাকারীদের ছয়জনই ঢাকার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের। এদের কেউ কেউ এখনও ছাত্র। আবার কারও কারও লেখাপড়া সদ্য শেষ হয়েছে। একজন সদ্য পাস করা চিকিৎসক। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের কাছেই অভিজিত রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বাধা দিতে গিয়ে অভিজিত রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল চাপাতির কোপে কেটে পড়ে যায়। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। এ ঘটনায় জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করে। মামলা তদন্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এফবিআইয়ের একটি দল ঢাকায় আসে। তারা ডিবি পুলিশকে তদন্তে সহায়তা করে। ঘটনা তদন্তে সংগৃহীত প্রয়োজনীয় আলামতের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহবাগ মডেল থানায় অভিজিত রায়ের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. অজয় কুমার রায়ের অজ্ঞাত খুনীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মঙ্গলবার ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, অভিজিত রায় হত্যার পর তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার সঙ্গে বেশ কয়েক দফা কথা হয়েছে। তিনি হত্যাকারীদের বেশভুষা ও বয়স সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। কিন্তু তেমন কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। প্রযুক্তির ব্যবহার করে হত্যাকা-ে জড়িত সাতজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। যারা হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত তারা খুবই প্রশিক্ষিত। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনী তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। এমনকি হত্যাকারী সাতজনের মধ্যে অনেকের ছবিও রয়েছে তাদের কাছে। ছবি ছাড়াও অন্যান্য তথ্য পাওয়া গেছে। হত্যাকারীদের নামও পাওয়া গেছে। তবে নামগুলো প্রকৃত বা ছদ্মনামও হতে পারে। হত্যাকারীরা এদেশেই আত্মগোপনে রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। হত্যাকারীদের মধ্যে দুইজন সরাসরি চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটায়। অন্য হত্যাকারীরা আশপাশেই ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাতজনের কাছেই ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলে ডিবির ধারণা। তবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলে বিপত্তি দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকায় হত্যাকারীরা হয়ত চাপাতি ব্যবহার করেছে। তিনি আরও জানান, অভিজিত রায় বাংলাদেশে আসার পরেই চার থেকে পাঁচবার হত্যার টার্গেট নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সুবিধাজনক জায়গা না হওয়ায় সেসব মিশন ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত প্রচ- ঝুঁকি নিয়েই ভিড়ের মধ্যেই অভিজিত রায়কে হত্যা করা হয়। হত্যাকারী হিসেবে শনাক্ত হওয়া সাতজনই সদ্য নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে তারা এক প্রকার নিশ্চিত। ধারণা করা হচ্ছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাত সদস্যের সমন্বয়ে সিøপার সেলটি গঠিত। হত্যাকারী হিসেবে সাতজনই শনাক্ত হয়েছে। যারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। এ জন্যই হত্যার পর আনসার বাংলা সেভেন নামে অভিজিত রায়কে হত্যার দায় স্বীকার করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে টুইট করা হয়ে থাকতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত তদন্তে অভিজিত রায় হত্যার ঘটনায় শফিউর রহমান ফারাবী ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারসীম মান্নানের সরাসরি জড়িত থাকার কোন তথ্য মেলেনি। তবে অভিজিতের হত্যাকারীরা গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত বিষয়টি সম্পর্কে সুস্পষ্ট করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। কারণ গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে ফারাবী, ফারসীম মান্নান বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানীর নাম চলেও আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে এখনই সুনিশ্চিত করে কোন কিছুই বলা যাচ্ছে না। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, যাদের প্ররোচনায় হত্যাকারীরা ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করে, তাদেরই প্ররোচনায়ই অভিজিত রায়কেও হত্যার ঘটনাটি ঘটতে পারে। হেফাজতে ইসলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৮৪ জন ব্লগারের তালিকা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। সে তালিকায় নিহত ব্লগার ছাড়াও অনেক ব্লগারই রয়েছেন। ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবক (ভলান্টিয়ার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। ৫ মে’র আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বিশেষ জরুরী বৈঠকে হেফাজতে ইসলামের কর্মকা-কে সমর্থন করা হয়। সদ্য নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা জসীমুদ্দিন রাহমানীও নৈতিকভাবে এবং প্রকাশ্যে হেফাজতে ইসলামকে সমর্থন করেন। ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের হত্যাকা-ের সঙ্গে উগ্র মৌলবাদী, স্বাধীনতাবিরোধী এবং একটি বিশেষ ইসলামী দলের যোগসাজশ রয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বহির্বিশ্বে আলোচনায় আসার জন্য উগ্র মৌলবাদী ও জঙ্গী সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে এ ধরনের হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটানো হতে পারে।
×