ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জয়বাংলা ছেড়ে কই যামু

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ৮ জুলাই ২০১৫

জয়বাংলা ছেড়ে কই যামু

তাহমিন হক ববি, ছিটমহল থেকে ॥ স্বামী-স্ত্রীর মধ্য লঙ্কাকা-। দেশ বেছে নেয়া প্রশ্নে স্বামী ফরহাদ হোসেন সপরিবারে ভারতীয় নাগরিক হতে নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করতে চায়। বাদ সেধে বসলেন স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগম ও বিধবা মা জয়গুন বেওয়া। সঙ্গে ছিল ফরহাদ হোসেনের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। এ নিয়ে তাদের প্রচ- তর্কবিতর্ক। তারা কোন সিদ্ধান্তেই আসতে পারলেন না। বিধবা মা জয়গুন বেওয়া বললেন, তাঁর স্বামী জাফর আলী ১৯৭৩ সালে মারা গেছেন। স্বামীর কবর ছেড়ে কই যামু। বাকি জীবনটা স্বামীর কবর ধইরা জয় বাংলার দেশে থাকবার চাই। ফরহাদ হোসেনের স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, জয়বাংলা শুনতেও ভাল লাগে- বলতেও ভাল লাগে। তাই এই দেশের (বাংলাদেশ) মায়া ত্যাগ করতে চাই না। ফরহাদ হোসেনের বড় ছেলে আলিমুজ্জামান (২৩) বললেন আমি বিয়ে করেছি ছিটমহলের বাইরে বাংলাদেশের মেয়েকে। ভারতে গিয়ে কী করব। স্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে জয়বাংলায় থাকতে চাই। এদিকে মা, স্ত্রী ও বড় ছেলের কথার বিপরীতে ফরহাদ হোসেন বলছিলেন আমার অনেক শক্র। প্রতিপক্ষদের অত্যাচার সহ্য হয় না। তাই ভারতে চলে যেতে চাই। ফরহাদ হোসেনের দ্বিতীয় পুত্র আখতারুজ্জামান (১৬) ও মেয়ে আফরোজা আক্তার (৭) কোন কথা বলছিল না। তারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিল আর শুনছিল বাবা-মা- দাদি আর বড় ভাইয়ের কথাগুলো। মাঝে মাঝে তারা হেসেও উঠছিল। ছিটমহলের জনগণনার দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার ওই পরিবারের এ ঘটনাটি ছিল নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের মধ্যে ভারতীয় ২৮ নম্বর বড়খানকার ছিটমহলের জনগণনার ক্যাম্পে। ক্যাম্পে উপস্থিত সকলে বললেন এটা আপনাদের পারিবারিক বিষয়। বাড়িতে গিয়ে ঠা-া মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে ক্যাম্পে এসে নাম নিবন্ধন করবেন। তখন আপনাদের পরিবারের একটাই সিদ্ধান্ত ফর্মে লিপিবদ্ধ করা হবে। এ সময় ফরহাদ হোসেনের স্ত্রী বললেন আমার স্বামীর মাথা নষ্ট। কী বলতে কী বলে ঠিক নাই। আমাদের কোন শক্র নেই। জন্ম থেকেই বাংলাদেশের ভেতরের এই ছিটমহলে বসবাস করছি। জয়বাংলায় থাকতে চাই। এরপর পরিবারটি বাড়ি ফিরে চলে যায়। এ দিন ওই পরিবারটি জনগণনায় নিবন্ধন করেনি। তারা বাড়িতে গিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে নিবন্ধন করতে আসবেন বলে জানান। জনগণনার দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার অভ্যন্তরে ভারতীয় চারটি ছিটমহলে ২১টি পরিবার নিবন্ধন করেছেন। তারা কেউ ভারতীয় নাগরিক হতে চাননি। এদের মধ্যে কথা হয় ৩১ নম্বর ছিটমহলের বাসিন্দা মৃত সাবেত আলীর পুত্র মহিমুদ্দিন (৮০) ও তার স্ত্রী আহিয়া বেগমের (৭০) সঙ্গে। তারা বলেন, আমাদের দুই মেয়ে তাদের বিয়ে দিয়েছি ছিটমহলের বাইরে বাংলাদেশে। ছিটের ভেতর আমাদের যা জমিজমা আছে তা মানুষের দ্বারা আবাদ করে সংসার চালাই। এখন আমরা বুড়াবুড়ি দুইজন ভারতে গিয়ে কী করব। বাকি জীবনটা জয়বাংলার দেশের নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকতে চাই। একই ছিটমহলের মৃত সামছুদ্দিনের পুত্র বাবুল হোসেন (৩২) জানায়, মা-বাবা দুইজনেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের কবর ছিটমহলের ভেতরেই আছে। তিনি বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী মোসলেমা বেগম ও দুই সন্তান নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকতে চাই। এই ছিটমহলের মৃত তছির উদ্দিনের পুত্র গুলজার হোসেন (৪০) মৃত মকবুল হোসেনের পুত্র তরিকুল ইসলাম (৪৫) জানান, ভারতে গিয়ে কী করব তাই বাংলাদেশের নাগরিক হতে নিবন্ধন করেছি। প্রথম দিনের ন্যায় দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার নীলফামারীর চারটি ছিটমহলে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে জনগণনা অনুষ্ঠিত হয় সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। গত সোমবার নীলফামারীর ৪টি ছিটমহলের মধ্যে জনগণনার প্রথম দিন দুইটি ছিটমহলে নিবন্ধন হয়েছিল এর মধ্যে ২৮ নম্বর ছিটমহলের ১৫টি পরিবারের ৭০ সদস্যের ও ৩১ নম্বর ছিটমহলে ১৭টি পরিবার ৯৪ জন সদস্যের। দ্বিতীয় দিনের জনগণনায় বিকেল ৪টা পর্যন্ত ডিমলা উপজেলার চারটি ছিটমহলে ২১টি পরিবার নিবন্ধন করেন। এর মধ্যে ২৮ নম্বর বড়খানকাবাড়ি ছিটমহলে ৪টি পরিবারের ১৬ জন সদস্য, ২৯ নম্বর বড়খানকা খারিজা গীতালদহ ছিটমহলে ৬ পরিবারের ২৮ সদস্য, ৩০ নম্বর বড়খানকা গীতালদহ ছিটমহলে ২ পরিবারের ৭ সদস্য ও ৩১ নম্বর নগর জিগাবাড়ী ছিটমহলে ৯টি পরিবারের ৪৬ সদস্য। জনগণনার জরিপ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন ভারতের জয়দেব কুমার, সনজিব বসাক, অমরেশ পাল ও বাংলাদেশের আজিজুল ইসলাম আসাদুজ্জামান জুয়েল ও এমদাদুল হক। প্রতিটি নিবন্ধনে সময় লাগছে ৩০ মিনিট করে। এদিন জনগণনার ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার দিলোয়ার বখ্ত। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নীলফামারী জেলা প্রশাসক জাকীর হোসেন, ডিমলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম, টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন, খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথন, গয়াবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইবনে ফয়সাল মুন। উল্লেখ যে, গত ৬ জুলাই থেকে ভারত ও বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলে একযোগে জনগণনা শুরু হয়েছে। ছিটমহলের মধ্যে ভারতের কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি ৫১টি ও বাংলাদেশের নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়ে ১১১টি রয়েছে। জনগণনায় বাংলাদেশে ভারতীয় ৫০টি জরিপকারী দল ও ভারতে বাংলাদেশের ২৫টি জরিপকারী দল আগামী ১৬ জুলাই পর্যন্ত জনগণনার কাজ করবেন। আর এই কাজে প্রতি এলাকার ডিসি /ডিএম/ পুলিশ প্রশাসন তদারকি করছে।
×