ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গোলক মজুমদার মুক্তিযুদ্ধের এক কারিগর

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ৮ জুলাই ২০১৫

গোলক মজুমদার মুক্তিযুদ্ধের এক কারিগর

পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল এবং বিএসএফের আইজি গোলকবিহারী মজুমদার দীর্ঘ রোগভোগের পর সোমবার কলকাতায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তাঁর দুই কন্যা বর্তমান। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আইজি গোলক মজুমদারের নাম সমার্থক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা সে দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনবাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পি-িতে পাঠিয়ে দেয় তখন বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আত্মগোপন করেন। শেখ মুজিব জানতেন, তাঁকে গ্রেফতার করে হত্যা করা হলে তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর মতো দলের অন্য নেতারাও একই পরিণতির সম্মুখীন হবেন। ২৫ মার্চের পর থেকেই তাঁরা বাসা বদল করে পাক সেনাবাহিনী ও পুলিশের চোখে ধুলো দিতে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতেন। কিন্তু তাঁরা জানতেন, এভাবে লুকিয়ে থেকে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই নেতৃত্বের নিরাপত্তার জন্য খুবই চিন্তান্বিত ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী চাইছিলেন, এই নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে বা ভারতে আনা হোক। এই মর্মে শ্রীমতী গান্ধী বিএসএফের প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল জেএফ রুস্তমজিকে একটি নির্দেশও দেন। রুস্তমজি সেই বার্তা পশ্চিমবঙ্গে বিএসএফের তদানীন্তন আইজি গোলকবিহারী মজুমদারকে জানান। একই সঙ্গে দায়িত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির এসব নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের কলকাতায় আনার ব্যবস্থা করার জন্য। সেইমতো কাজও শুরু হয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তখনও ঢাকার বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছিল না। বাইরের জেলাগুলো তখনও মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। গোলক মজুমদার বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে ঢুকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মাধ্যমে দলের গা-ঢাকা দেয়া প্রথম সারির নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই বছরেরই এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে নদীয়া-কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদ ও তাঁর দলীয় সঙ্গী ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে বিএসএফের বিশেষ এসকর্ট দিয়ে কলকাতার রাসেল স্ট্রিটের অসম হাউসের অতিথিশালায় এনে তোলেন। তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আরও অনেক দলীয় নেতাকর্মী ছিলেন। অসম হাউসে রুস্তমজি তাজউদ্দিন আহমদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। কলকাতা তখন নকশাল আতঙ্কে কাঁপছে। খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্ট রাত সাড়ে ৯-১০টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। গোলক মজুমদার যখন তাজউদ্দিন ও ব্যারিস্টার আমিরুলকে অসম হাউসে আনলেন তখন ঘড়ির কাঁটা এগারোটার কাছাকাছি। অসম হাউসের বোর্ডারদের জন্য তৈরি করা খাবার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। গোলক মজুমদারের মাথায় হাত। প্রায় বিশজনের জন্য খাবার জোগাড় করা সেই রাতে প্রায় অসম্ভব ছিল। রুস্তমজি থেকে থেকে গোলক মজুমদারকে বলছেন, ‘গোলক উন লোগো কে লিয়ে খানে কা কুছ বন্দোবস্ত করো। ‘ঞধুঁফফরহ রং ফবধফ ঃরৎবফ. ঐব হববফং ধ মড়ড়ফ হরমযঃ’ং ংষববঢ় নবভড়ৎব বসঢ়ষধহরহম ভড়ৎ উবষষযর বধৎষু ঃড়সড়ৎৎড়ি সড়ৎহরহম.’ গোলক মজুমদার নিজের আধিকারিকদের কাছ থেকে খবর পাচ্ছেন, এত রাতে এতজনের খাবারের ব্যবস্থা করা অসম্ভব। আর তা শুনে তিনি নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছেন। শেষমেশ তাঁর বিশেষ বন্ধু নীহার চক্রবর্তীকে ফোন করে অনুরোধ করলেন, ‘তোমার তো বাবুর্চি আছে? বিশজনের জন্য পরোটা আর কাবাব তৈরি করে অসম হাউসে পাঠিয়ে দাও যত শীঘ্র সম্ভব। আর আমার মুখ রক্ষে কর।’ নীহার চক্রবর্তীকে গোলক মজুমদার আরও বললেন, ‘ঢাকা থেকে এক বিশেষ ভিভিআইপি এসেছেন। তাঁর সঙ্গে আরও অনেকে। তাঁদের জন্যই এই খাবার। নীহার চক্রবর্তীকে ভিভিআইপির নাম বললেন না গোলক মজুমদার। শুধু বললেন, ‘ঢাকা থেকে যে ভিভিআইপি এসেছেন এ কথা ঘুনাক্ষরেও কেউ যেন না জানে।’ অতিথিপরায়ণ নীহার মজুমদারের রাসেল স্ট্রিটের ফ্ল্যাটের ভাঁড়ারে সব সময় সুখাদ্য মজুত থাকত। তিনি এক ঘণ্টার মধ্যে পরোটা ও কাবাব তৈরি করে সেদিন গোলক মজুমদারের মুখ রক্ষা করেছিলেন। পরদিন ভোর ৪টা নাগাদ রুস্তমজি ও তাজউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে গোলক মজুমদার বিএসএফের বিশেষ বিমানে দিল্লী রওনা হন। সেখানে তাজউদ্দিনের প্রথম সাক্ষাত হয় শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে। শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশের রাজনীতিকরা ভারতের কাছ থেকে ঠিক কি সাহায্য চায় তা জানতে চান। সেই বৈঠকে রুস্তমজি ও গোলক মজুমদারও উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে নীহার চক্রবর্তীকে নিজের সঙ্গী করেছিলেন গোলক মজুমদার। নীহার চক্রবর্তীও তাঁর বন্ধু গোলকের জন্য এমন অনেক অসাধ্যসাধন করেছিলেন যা অনেকেরই অজানা। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আমবাগানে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের দিন ধার্য হয়। তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকা, যশোর ও কুমিল্লা সেনাছাউনি থেকে বেরিয়ে জেলাগুলোকেও তাদের কর্তৃত্বে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সেই প্রেক্ষাপটে মেহেরপুরের আমবাগানে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর নির্দেশে গোলক মজুমদারের ওপর দায়িত্ব পড়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করার। যেহেতু ওই অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে বাংলাদেশের প্রথম সারির নেতারা উপস্থিত থেকে শপথ নেবেন, সেইজন্য অনুষ্ঠানটি যাতে নির্বিঘেœ সম্পন্ন হয় তার সব দায়-দায়িত্ব গোলক মজুমদারের ওপরই ন্যস্ত হয়। সেই সময় কলকাতা থেকে এক বিরাট গাড়ির কনভয় করে বাংলাদেশের নেতাদের নদীয়ার তেহট্ট সীমান্ত দিয়ে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আমবাগানে (যা পরে মুজিবনগর বলে নামাঙ্কিত হয়) নিয়ে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল। কারণ বাংলাদেশের নেতাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ৩০-৩৫টি গাড়ির প্রয়োজন ছিল। নীহার চক্রবর্তীকে ৩৫টি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ করলেন গোলক মজুমদার। কারণ বিএসএফ যদি গাড়ির ব্যবস্থা করে তাহলে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটির কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কারণ তখন পাকিস্তানী গুপ্তচর চক্র কলকাতায় অত্যন্ত সক্রিয়। বিশেষ করে শহরের সাংবাদিক মহলে। এমনকি সেই সময় চার সাংবাদিক পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য আটকও হয়েছিলেন। কলকাতায় তখন প্রাইভেট ট্যাক্সির চল ছিল না। নীহার চক্রবর্তী ৩৫টি গাড়ি জোগাড় করলেন। কিন্তু গাড়িগুলো কাদের নিয়ে কোথায় বা কখন যাবে তা সংশ্লিষ্ট গাড়ির চালকদের জানানো নিষেধ ছিল। যার ফলে চালকদের বেশ কয়েকজন শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেন। তাদের বাদ দিয়ে আবার নতুন গাড়ি জোগাড় করেন নীহার চক্রবর্তী। ১৭ এপ্রিল ভোর ৫টায় গাড়ির সারি যখন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনদের নিয়ে কলকাতা ছাড়ল শহরবাসী তখন গভীর নিদ্রায়। কনভয়টির সামনে, পেছনে ও আশপাশে ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিএসএফের একটি বাহিনী মোতায়েন ছিল।’ এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন গোলক মজুমদার স্বয়ং। গাড়ির বহরটি যাতে রাস্তায় আচমকা কোন আক্রমণের লক্ষ্য না হয় তার জন্য সাদা পোশাকের বিএসএফের জওয়ানরা মোতায়েন ছিলেন। আমবাগানকে বিমান হামলা থেকে সুরক্ষিত করার জন্য গোলক মজুমদার চারদিকে বিমান বিধ্বংসী কামানের ‘নেস্ট’ বসিয়েছিলেন। কারণ সেই সময় পাক সামরিক ও বিমানবাহিনী পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের দিকে আক্রমণাত্মকভাবে ধেয়ে আসছিল। বিমান বিধ্বংসী কামানগুলোকে গাছের আড়ালে রাখা হয়েছিল। আর বিএসএফের জওয়ানরা ভারি অস্ত্রশস্ত্রসহ আমবাগানটিকে ঘিরে রেখেছিল পাকবাহিনী অতর্কিতে হামলা চালালে তা প্রতিহত করার জন্য। বলতে দ্বিধা নেই, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান কোন অঘটন ছাড়াই শান্তিতে সম্পন্ন হয় এবং অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সে দেশের মাটিতে ভূমিষ্ঠ হলো। পুরো কৃতিত্বটাই ছিল গোলক মজুমদারের। সেই রাতে গোলক মজুমদার যখন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানদের নিয়ে কলকাতায় ফিরলেন অপেক্ষারত রুস্তমজি তখন তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ডবষষ ফড়হব এড়ষড়শ, ঈড়হমৎধঃঁষধঃরড়হং. গৎং. এধহফযর রং ঐধঢ়ঢ়ু.’ শ্রীমতী গান্ধীও গোলক মজুমদারকে ফোনে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ‘ন্যাপ’ নেতা মওলানা ভাসানীকেও কলকাতায় আনার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল গোলক মজুমদারের ওপর। সেটাও তিনি সুচারুভাবে ও নির্বিঘেœই সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের নেতাদের শুধু ভারতে আনা নয়, তাঁদের ও পরিবারের থাকা-খাওয়াসহ নিরাপত্তার দায়িত্বও তিনি নিজের হাতেই সামলেছেন। আবার খোন্দকার মুশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বা মাহবুব আলম চাষীর মতো নেতা-আমলা, যারা মুক্তিযুদ্ধে বাগড়া দেয়ার জন্য পাকিস্তান ও আমেরিকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তাঁদের ওপরও তিনি কড়া নজরদারি চালিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপুঞ্জে বাংলাদেশকে নিয়ে আলোচনায় প্রতিনিধি হিসেবে খোন্দকার মুশতাকের নাম তাঁর বিরোধিতার কারণেই বাদ পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য শ্রীমতী গান্ধী গোলক মজুমদারকে ‘পরম বিশিষ্ট সেবা মেডেল’-এ ভূষিত করেছিলেন। এই পদকটি সাধারণত সেনাবাহিনীর সদস্যদের অসীম সাহসিকতার জন্য প্রদান করা হয়। কিন্তু গোলক মজুমদার ছিলেন প্রথম অসামরিক আধিকারিক যিনি এই সম্মান পান। শেখ হাসিনার বাংলাদেশ সরকারও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা দেয়। লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক ও দৈনিক স্টেটসম্যানের (বাংলা) সম্পাদক
×