ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সেই পরিবারটির ওপর ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি ছিল

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ৭ জুলাই ২০১৫

সেই পরিবারটির ওপর ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি ছিল

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ ব্রিটেনের লুটন শহরে বসবাসকারী সিলেটের একটি পরিবারের ১২ সদস্যের আইএসে যোগদানের বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। বাংলাদেশে বেড়াতে এসে ব্রিটেনে ফিরে যাবার পথে তুরস্কে যাত্রাবিরতি করার পর সেখান থেকে তারা সিরিয়া চলে যায়। লুটন শহরে বসবাসকারী আব্দুল মান্নানের পরিবারের ওপর ব্রিটেন পুলিশের নজরদারি ছিল। বছরখানেক আগে ওই পরিবারের সদস্য রাজিয়া খানমকে ব্রিটিশ পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। পাঁচ দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর মা মিনারা খাতুনের জিম্মায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ২১ বছর বয়সী রাজিয়া খানম নিষিদ্ধ ইসলামী গোষ্ঠী ‘আল-মোহাজিরুনের’ সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবার বাংলাদেশে আসার পথে ১০ এপ্রিল প্রথমে তুরস্কে যাত্রাবিরতি (ট্রানজিট) করতে চেয়েছিলেন ওই পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু, হিথ্রো বিমানবন্দরে রাজিয়া খানমের আচরণে সন্দেহ হলে তাকে ব্যাপক তল্লাশি করতে গিয়ে প্রায় সাত ঘণ্টা বিলম্ব হয়। চেকিংয়ে বিলম্বের কারণে তাদের নির্ধারিত ফ্লাইটও বাতিল হয়। অনেকটা আইনী কড়া নজরদারির মধ্যেই আব্দুল মান্নানের পরিবার হিথ্রো বিমানবন্দর ত্যাগ করে। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মান্নানের পরিবারের সদস্যরা হচ্ছেনÑ তার স্ত্রী মিনারা খাতুন (৫৩), মেয়ে রাজিয়া খানম (২১), ছেলে মোহাম্মদ জায়েদ হুসেইন (২৫), মোহাম্মদ তৌফিক হুসেইন (১৯), মোহাম্মদ আবুল কাশেম সাকার (৩১) ও তার স্ত্রী সাইদা খানম (২৭), মোহাম্মদ সালেহ হুসেইন (২৬) ও তার স্ত্রী রোশনারা বেগম (২৪) এবং এ দম্পতির তিন সন্তান যাদের বয়স এক থেকে ১১ বছর। ১২ সদস্যের ওই পরিবারটি লুটনে একই বাসায় বসবাস করতেন। প্রবাসী আব্দুল মান্নান পরিবারসহ সিরিয়া পাড়ি জমানোর সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর দেশে-বিদেশে তার আত্মীয় পরিজনরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। পুলিশের নজরদারি আর জিজ্ঞাসাবাদের কারণে তারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছেন। ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও গ্রামের বাড়িতে আব্দুল মন্নানের দুই ভাই বসবাস করেন। প্রশাসনের লোকজন, মিডিয়াকর্মী এবং সেই সঙ্গে কৌতূহলী মানুষের নিয়মিত আনাগোনা এখন আব্দুল মান্নানের বাড়িতে। এতে আব্দুল মান্নানের ভাই আব্দুল লতিফ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। গত ১১ এপ্রিল পুরো পরিবারকে নিয়ে দেশে এসেছিলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুল মান্নান। এ সময় ফেঞ্চুগঞ্জের নিজ বাড়িতে এক মাস অবস্থান করেন তারা। বাংলাদেশে অবস্থানকালীন সময়ে আব্দুল মান্নানের মেয়ে রাজিয়া খানমের (২১) অস্বাভাবিক আচরণ প্রত্যক্ষ করেছেন তার চাচা আব্দুল লতিফ। রাজিয়ার প্ররোচণায়ই পুরো পরিবার আইএসে যোগ দিতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। আব্দুল লতিফ জানান, ছুটি কাটাতে বাংলাদেশে আসার পর রাজিয়াসহ ভাতিজিরা ঘর থেকে বেরুলেই পর্দা করে বের হতো। এমনকি হাতে হ্যান্ডগ্লাভসও পরত তারা। বাড়ির লোকদের সঙ্গে তাদের চলাফেরার মিল ছিল না। দেশে থাকাকালীন সময়ে রাজিয়ার আচরণ বাড়াবাড়ি রকমের কট্টর ছিল বলে জানান আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, রাজিয়া গরমের মধ্যেও যেভাবে পুরো শরীর ঢেকে রাখত এবং সবাইকে পুরো পর্দা করতে বলত, তা কিছুটা অস্বস্তিকর মনে হতো। রাজিয়ার প্ররোচনায়ই পরিবারটি এ পথে এগুতে উৎসাহী হয়েছে বলেই তার ধারণা। ‘ইসলামী খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে নামা আইএসে যোগ দিতে যুক্তরাজ্য থেকে অন্তত ৪২ জন ইতোপূর্বে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। এর মধ্যে লুটনের একজন রয়েছেন। আইএস সংশ্লিষ্টতার জন্য লুটনের আরেক নারীকে কারাগারে যেতে হয়েছে। তবে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কোন পরিবারের আইএসে যোগ দেয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আব্দুল মান্নানের মেয়ে রাজিয়া দুই বছরের বেশি সময় ধরে আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। পর্যায়ক্রমে রাজিয়া আইএসে যোগ দিতে পরিবারের লোকদের উৎসাহী করে তোলে। বাংলাদেশে পাড়ি জমানোর পূর্বে তারা সিরিয়া যাবার প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। লন্ডন থেকে সরাসরি সিরিয়া পাড়ি জমানোর বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে ভেবেই তারা প্রথমে বাংলাদেশে আসার ব্যবস্থা করেন। গত ১১ এপ্রিল টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তারা বাংলাদেশে আসেন। দেশে এক মাস অবস্থান করার পর তারা ১১ মে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের রিটার্ন (ফিরতি) ফ্লাইটে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকার হযরত শাহজালাল (র) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে নামার পর তারা সেখানে দু’দিন অবস্থান করেন। এরপর সেখান থেকে তারা উধাও হয়ে যান। লন্ডনে ফেরত না যাওয়ায় ১৪ মে তার বড় ভাতিজা সেলিম যুক্তরাজ্য পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন। এমন তথ্য পেয়ে সেখানকার পুলিশও বিষয়টি তদন্ত করে। পুলিশ এ নিয়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত আব্দুল মান্নানের প্রথমপক্ষের সন্তানদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করে। পুলিশ মান্নানের পরিবারের সদস্যদের গ্রুপ ছবি সংগ্রহ করে। পুলিশ পরিবারের সদস্যদের মিডিয়ার মুখোমুখী হওয়ার মানসিক প্রস্তুতিও নিতে বলে। মিডিয়ায় বিষয়টি যে কোনভাবে প্রকাশিত হয়ে যেতে পারেÑ এ আশঙ্কায় যুক্তরাজ্য পুলিশ বিষয়টি ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমকে সরবরাহ করে বলে ভাতিজার বরাত দিয়ে আব্দুল লতিফ জানান।
×