ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রী, এইসব শুনতে ভাল লাগে না

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ৭ জুলাই ২০১৫

প্রধানমন্ত্রী, এইসব শুনতে ভাল লাগে না

প্রধানমন্ত্রী, জানি এই সব ঘটনা, দুর্নীতি বা সোনালী ব্যাংকের বড় কর্তাদের দুর্নীতি করা সত্ত্বেও দলের কোন নেতার, সন্দেহ নেই বড় নেতা হবেন, চাপে মামলা থেকে রক্ষা করে রাখা আপনাকেও অসন্তুষ্ট করেছে। অর্থমন্ত্রী দুদককে ওই অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে, আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নির্দেশ দিতে পারছেন না বলে তাঁকে ক্ষুব্ধ মন্তব্য করতে হয়Ñএর চাইতে দুঃখজনক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্য অবমাননাকর আর কি হতে পারে! তবু তার কথায় মনে হলো অনেক দলীয় নেতার অনুরোধ উপেক্ষা করে অর্থমন্ত্রী দু’জন দুর্নীতিবাজ ব্যাংকারকে গ্রেফতার ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পেরেছেন। একটি বিষয়ে সরকারদলীয়দের সতর্ক থাকতে হবে যে, জনগণ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারকে খালেদা-তারেক-নিজামী-মুজাহিদের সরকার থেকে একেবারেই ভিন্ন রকম চরিত্রে দেখতে চায়। অপরাধ, দুর্নীতি করেছে প্রমাণ পেলে দু’চারজন গ্রেফতার হবে, আবার অন্য একজন, দু’জন দলীয় বড় নেতার আত্মীয়-বন্ধু বলে গ্রেফতার হবে না, এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইনের শাসনের বরখেলাপ তো অবশ্যই। আপনিও এটি চান না বলেই জানি। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার অনেক কিছু আপনার এই দেশপ্রেমিক সরকার পূরণ করেছে। কিন্তু তারপরও জনগণ আরও অনেক কিছু চায় এবং অনেক কিছু চায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সেসব আশা পূরণ করবে এ সরকার, এটি তারা বিশ্বাস করে। এর বড় কারণ, তারা দেখছে শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবীবান্ধব এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বর্তমান সরকারই চুয়াল্লিশ বছর পর ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের অসম্পাদিত, কিন্তু ত্রিশ লাখ শহীদের স্বজনদের প্রাপ্য ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার শুরু করেছে, যা আর কোন দল করতে সক্ষম হয়নি; বরং তারা যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে মিত্রতা করেছে। দ্বিতীয়ত, কোন নেতা ‘পল্লীবন্ধু’ নাম নিতে পারলেও কৃষকবন্ধু, শ্রমিকবন্ধু আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন দল বা বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ছাড়া কৃষক-শ্রমিক-মুক্তিযোদ্ধার বন্ধু হতে পারেনি। অন্য সরকারগুলো দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণও করতে পারেনি, করবার ইচ্ছা, পদক্ষেপও গ্রহণ করেনি। সেজন্য কৃষক চায় তার উৎপাদিত আখ থেকে যে চিনি হয় তা যেন বাজারে বিক্রি হয়। বিদেশ থেকে সাদা চিনি আমদানি করে পুষ্টিযুক্ত দেশের লাল চিনি গুদামে নষ্ট হবেÑ সত্যি এ আর নিতে পারছি না। কৃষক আখচাষী এবং মিলের শ্রমিক ও কর্মকর্তারা কিভাবে এ অন্যায়টি গ্রহণ করবে? কেনইবা করবে? দলীয় ও ভিন্ন দলীয় আমদানিকারক ব্যবসায়ী রাজনীতিকদের যে পণ্য দেশে উৎপাদিত বাজার না পেয়ে গুদামে নষ্ট হয় সে পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে কৃষক, মিল শ্রমিক, কর্মকর্তার জীবিকা ধ্বংস করে কেন? কেন তারা বছরের পর বছর এই একই পণ্য আমদানি করে দেশের চিনি শিল্পকে ধ্বংস করছে? বাণিজ্যমন্ত্রীকে অবশ্যই দেশের উৎপাদিত পণ্যের বাজার পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁর বন্ধু- ট্রেডারদের দেশে কম আছে এমন পণ্য আমদানি করতে বলুন। প্রতি বছর চিনি নিয়ে কৃষকের প্রতি মশকরা আর আমাদের বরদাশত হয় না। আমি সেই ’৮৩ সালে ইংল্যান্ডে, এডিনবরায় লাল বড় বড় টুকরা চিনি ব্যবহার হতে দেখেছি। অথচ আমার দেশের লাল চিনি বাজারে আনা হচ্ছে না! কৃষি দফতরের দোকান থেকে আমি দেশী লাল চিনি কিনি; কিন্তু বেশিরভাগ ক্রেতা তা করে না। গুদামে এ চিনি গলে যাবে, চিনি দিয়ে শ্রমিকের মজুরি দেয়া হবেÑ এ অসভ্যতা বাণিজ্যমন্ত্রীকে বন্ধ করতে হবে এবং তা এখনই। একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সবার উপকার হয়। আগোরা, মীনাবাজার, স্বপ্ন-এসব চেইন শপে দেশী চিনিও রাখার নির্দেশ দিলে লাল চিনি বাজার পাবে। এরপর বলতে হয় ‘গম’ আমদানি নিয়ে সরকার প্রায় পদ্মা সেতুর মতোই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। গম দেশে যথেষ্ট উৎপন্ন হয়। তারপরও আমদানি যদি করতে হয় তাহলে নমুনা পরীক্ষা করে তাও গুণগতমান নিশ্চিত করে না আনা হলে যা হওয়ার তা এখন ঘটছে। এখন ডিজিটাল যুগ শুধু নয়, এখন মিডিয়া সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে। সেজন্য মন্ত্রী, আমলা, জনগণ- সবাই দেখছে গমগুলো কীটদষ্ট। ছোট দানা হলে ক্ষতি ছিল না। এখন তো আবার এক ট্রেডার সূর্যমুখী তেলে মিশ্রিত কোকেন নামক নেশাদ্রব্য আমদানি করেছে! এ ঘটনায় ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার মতোই আকস্মিকভাবে ধরা পড়েছে। তাদেরকে সম্ভবত ইচ্ছা থাকলেও রক্ষা করা আর সম্ভব হবে না। দেশ-বিদেশ জুড়ে হৈ চৈ পড়ে গেছে। আবার সূর্যমুখী তেলে মিশ্রিত কোকেন শনাক্তকরণে বিশেষজ্ঞ নাকি দেশে নেই। বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আসছে। সত্যিই কি এই শনাক্তকরণ যন্ত্র ও বিশেষজ্ঞ আমাদের দেশে নেই? কোকেন তো বহু পুরনো নেশাবস্তু। তবে সবচাইতে গুরুতর এবং অগ্রহণযোগ্য তথ্য হলো, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশী ধনীদের (লুটেরা নয় কি?) অর্থ জমা রাখার হার বৃদ্ধি! ভারত সরকার সুইস ব্যাংকে ভারতীয় এ্যাকাউন্টধারীদের নামের তালিকা চেয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও শূন্য সুদে সুইস ব্যাংকে ‘ধনসম্পদ’ জমাকারীদের নামের তালিকা ও টাকার অঙ্কের পরিমাণ জানতে চাইতে পারে। কমপক্ষে নামগুলো মিডিয়ায় প্রকাশ পাওয়াও মানিলন্ডারকারীর জন্য এক ধরনের শাস্তি হবে। এরকম একটা ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেÑ ধনীরা, অবশ্যই দুর্নীতিবাজ, ধন ভালবাসে আর দরিদ্ররা দেশ ভালবাসে। সুইস ব্যাংকে অর্থ সঞ্চিত রেখেছে যারা নিশ্চয় তাদের অর্ধেকের বেশি ব্যবসায়ী বা তথাকথিত ট্রেডার আমদানি-রফতানিকারক, অপর অংশ ধনী-দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক। এদের প্রায় সবার পরিবার, সন্তান বিদেশের নাগরিক, সেখানেই পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করছে- এতে তো সন্দেহ নেই। এদের অনেকের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে এরা খাঁটি বাঙালী বা বাংলাদেশী নয়। এরা মনে-প্রাণে বিদেশী। ধরে নেয়া যায়, এদের সন্তানরা, পরবর্তী প্রজন্ম ‘বাঙালী’ হবে না, কেউ কেউ বাংলা কথা বলতে পারলেও পড়তে বা লিখতে পারে না। সুতরাং বাংলাদেশ তার সেই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠা কৃষক, শ্রমিক, বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করা তরুণ-তরুণীদের দেশপ্রেম ও বাঙালীর ভাষা এবং সংস্কৃতি চর্চায় নিবেদিতদের অবদানেই ভবিষ্যতেও অগ্রগতির পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। প্রসঙ্গত একটা কথা স্মরণে পড়ছে। শুনেছি পাশ্চাত্যে, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্জিত সম্পত্তি ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর রাষ্ট্রের মালিকানায় চলে যায়। তার সন্তানরা ওই সম্পত্তি লাভ করে না। এ নিয়ম এখনও আছে কিনা কোথাও জানা নেই। কিন্তু এ থেকে আমরা একটা দুর্নীতি হ্রাসের যথার্থ নির্দেশনা লাভ করি। এটা তো বলা বাহুল্য যে, কোন ব্যক্তি যদি জানে যে, বসবাসের বাড়ি এবং সুনির্দিষ্ট একটি অঙ্কের বাইরে অতিরিক্ত বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, ব্যবসা ইত্যাদি তার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চলে যাবে তাহলে সেসব ব্যক্তি আর যাই হোক সন্তানদের জন্য ‘বেহেশতী ধনদৌলত’ অর্জন করার জন্য বে-আইনী পথ ব্যবহারে অনুৎসাহী হবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ‘কুমুদিনী ট্রাস্ট’ বা যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রো সফ্টওয়ার স্রষ্টার ‘বিল গেটস ট্রাস্ট ফান্ড’ তৈরির কথা স্মরণ করতে পারি। এর পাশে যদি আমরা অর্থমন্ত্রীর হতাশাপূর্ণ বক্তব্য স্মরণ করি তাহলে দেখি, আমাদের ধরা পড়া দুর্নীতিবাজদের রক্ষার্থে সরকারী ক্ষমতাশালী ব্যক্তি চাপ প্রয়োগ করে তাকে আইনের হাত থেকে রক্ষা করছে। আবার দেখছি বাঙালী শিক্ষিত ধনী মুসলমান স্কুল-হাসপাতাল তৈরি না করে প্রাচীনপন্থী মাদ্রাসা-মসজিদ তৈরিতে এখনও বন্দী। এদের কেউ ’৭১-এর শহীদ দানবীর আর পি সাহা হয়ে আধুনিক শিক্ষার স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যসেবার হাসাপাতাল তৈরিতে এগিয়ে আসবে আরও কত প্রজন্ম পর কে জানে! বর্তমানে দেখা যাচ্ছে কে কার চেয়ে বেশি মুসলমান- এমন একটি প্রতিযোগিতা চলছে। সেজন্য অফিসে, হাসপাতালে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজে, এমনকি রাজপথে নামাজের স্থান সৃষ্টি হয়েছে। নাতিশীতোষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ায় চুল ও ত্বকের মারাত্মক ক্ষতিকর হিজাব, মধ্যপ্রাচীয় আলখাল্লায় আবৃত নারীদের মধ্যে বাঙালী নারী তো প্রায় হারিয়েই গেছে! ধর্মের ভুল, জঙ্গী ব্যাখ্যা দিয়ে আধুনিক তরুণ-তরুণীদের এমনভাবে ভীত করা হচ্ছে যে, তাদের পক্ষে মানবিক হওয়াই যে ইসলামসহ সব ধর্মের মূল তা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। মান্য করা এবং ভাল, সৎ মানুষ হওয়ার শিক্ষা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দিয়ে কট্টর জিহাদীরা ধর্মের নামে অভেদ্য বলয়ের মতো সৃষ্টি করেছে। যার ফলে অন্ধ বিশ্বাসীদের জন্ম হচ্ছে। উদার মুক্তমনা অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের জন্ম ও বিস্তারকে পরিকল্পিতভাবে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। সেই আমাদের বাবা, নানা-চাচাদের শিখা গোষ্ঠী, এমনকি বেগম রোকেয়ার অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের নামে চাপিয়ে দেয়া কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা স্মরণ করলে অবাক না হয়ে পারা যায় না এই ভেবে যে এ যুগের তরুণ-তরুণীরা কি ততখানি আধুনিক চিন্তার ধারক, বাহক হতে পেরেছে? দুর্নীতি প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হবেÑ ২০০৬-এ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ‘বর্বর যুগ’ শেষ হলে খালেদা জিয়া পরিবার প্রায় আড়াই শ’ থেকে তিন শ’ স্যুটকেস-ট্রাঙ্ক সৌদি আরবে নিয়ে রেখে এসেছিল। সেগুলোর ভেতরে লাখ লাখ ডলার থাকার গুজব সে সময় মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছিল। তাছাড়া লণ্ডনে তারেকের বিলাসী জীবন, মালয়েশিয়ায় কোকোর পরিবারের নয়-দশ বছরের ব্যয় নির্বাহ কিভাবে হয় তা তর্কাতীত নয়। এগুলো কি জানা যায়? তাছাড়া ২০১৩-এর ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব ও ২০১৪-এর পেট্রোলবোমায় দগ্ধ করে মানুষ মারার জন্য খালেদা জিয়ার বিচার শুরু না হলে সুশাসন, ন্যায়বিচার সুদূর পরাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রী একদিকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তেমনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে, জঙ্গীবাদীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী। সুতরাং দলীয় হোক, ভিন দলীয় হোক, দুর্নীতিবাজদের বিচার যেমন করতে হবে, তেমনি জঙ্গী-জেহাদী দল জামায়াত, হেফাজতকে নিষিদ্ধ করে তাদের আলবদরীয় রীতি অনুসরণে প্রগতিশীল, মুক্তমনাদের তালিকা করে বিচারের নামে জঙ্গীদের হাতে খুন হতে দেয়ার ধৃষ্টতার কারণে, দেশ ধ্বংসের কারণে বিচার করতে হবে। বলা বাহুল্য, ২০১৩-এর দেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমের দায় হেফাজতের নেতারা কিছুতেই এড়াতে পারে না। দ্রুত তাদের, খালেদা জিয়াকে বিচারে সোপর্দ করে দেশকে, দেশপ্রেমিকদের দেশের প্রকৃত শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এইসব অগ্রহণযোগ্য তথ্য শুনতে, এইসব না হওয়া বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে আর ভাল লাগে না। লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক
×