ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঈদ সামনে রেখে প্রতিদিনই কম বেশি সোনা আনছেন যাত্রীরা

ব্যাগেজ রুল না জানায় বিমানযাত্রীরা সোনা নিয়ে পড়ছেন বিপাকে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৬ জুলাই ২০১৫

ব্যাগেজ রুল না জানায় বিমানযাত্রীরা সোনা নিয়ে পড়ছেন বিপাকে

আজাদ সুলায়মান ॥ সারা বছরই ব্যাগেজ রুলে কম-বেশি সোনা আনছেন যাত্রীরা। ঈদে সেটার পরিমাণ বাড়ে। ঈদ-উল-ফিতর সামনে রেখে এখন প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক যাত্রী আসছেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে। বিশেষ করে সৌদি আরব ও দুবাই থেকে আগত যাত্রীদের শতকরা আশি ভাগেরও বেশি ব্যাগেজ রুলে কম-বেশি সোনা আনছেন। যে কোন যাত্রীই বৈধভাবে সোনার বার বা সোনার অলঙ্কার সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু কোন্ সোনায় কত ট্যাক্স শুধু এটা না জানার কারণেই বিমানবন্দরে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে জটিলতা। শুল্ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায়ই যাত্রীর দেখা দিচ্ছে তর্ক-বিতর্ক। কেউ কেউ আবার না জেনে সোনা এনে, গুনছেন বিপুল পরিমাণ মাসুল। শুল্ক বিভাগের মতে, সোনার আমদানি নিষিদ্ধ না হলেও অবাধ নয়। সরকার সময়ের প্রয়োজনে আমদানি নীতি কখনও কখনও পরিবর্তন ও সংশোধন করে থাকে। বর্তমান নীতিমালা ৫ জুন ২০১৪ হতে প্রবর্তিত। সর্বশেষ চলতি বাজেট যেটা ৩০ জুন পাস হয়েছে, তাতেও আগের নীতিমালাই বহাল রাখা হয়েছে। শুল্ক বিভাগের মতে, বিবাহ, উৎসব, পুজো-পার্বণে সোনার ব্যবহার নিত্যদিন বেড়েই চলেছে। সোনার মান, বৈচিত্র্যময় ডিজাইন এবং মূল্য কিছুটা কম হওয়াতে অনেকেই বিদেশ থেকে ফেরার পথে প্রিয়জনের জন্য সোনার অলঙ্কার সঙ্গে আনতে পছন্দ করেন। কিন্তু বিরূপ প্রচার, ট্যাক্স বা শুল্ক সম্বন্ধে ঠিক ধারণা না থাকা এবং বিমানবন্দরে প্রতারণা ও হয়রানি এড়াতে অনেকেই শুল্ক ফাঁকি দিয়েই আনার চেষ্টা করছেন। বেশিরভাগই ফাঁকি দিতে সক্ষমও হচ্ছেন। কারণ ব্যাগেজ রুলে শতকরা পাঁচ ভাগ যাত্রীর লাগেজ চেক করা হয়। যদি বিশেষ কোন আগাম ও সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া পাইকারি সবার লাগেজ চেক করা হয় না। এ সুযোগেই পার পেয়ে যাচ্ছে লাগেজে সোনা আনার যাত্রীরা। শুল্ক বিভাগের মতে, সোনা অলঙ্কার ও স্বর্ণবার বা স্বর্ণপি- উভয় প্রকারে বৈধভাবে আমদানি করা যায়। বর্তমান ব্যাগেজ রুল অনুযায়ী একজন যাত্রী ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালঙ্কার বৈধভাবে বিনা শুল্কে সঙ্গে আনতে পারবেন। পূর্বে এটি ২০০ গ্রাম ছিল। ১০০ গ্রাম অর্থাৎ প্রায় ৯ ভরি (১ ভরি = ১১.৬৬৪ গ্রাম) । যাত্রী ২ জন হলে ১৮ ভরি। কোন ট্যাক্স লাগবে না। তবে শর্ত হলো যে, এক প্রকার অলঙ্কার যেমন চুড়ি বা ব্রেসলেট, চেন, আংটি বা যে কোন একটি আইটেম ১২টির বেশি আনা যাবে না। কিন্তু বিপত্তি বাধে এই পরিমাণের অতিরিক্ত হলে। কোন যাত্রী ১০০ গ্রামের অতিরিক্ত অলঙ্কার আনলে ওই অতিরিক্ত প্রতিগ্রাম স্বর্ণের জন্য ১৫০০ টাকা হারে প্রতি ১০০ গ্রামের জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। স্বর্ণবার বা স্বর্ণপি- আমদানি ট্যাক্স ॥ স্বর্ণবার আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য নয়। বিদেশ থেকে ফেরার পথে আপনি চাইলে সোনার অলঙ্কারের পাশাপাশি সোনার বার নিয়ে আসতে পারেন। স্বর্ণবার সাধারণত ১০০ গ্রাম, ২০০ গ্রাম বা ১ কেজি হতে পারে। কখনও কখনও ১১৭ গ্রাম বা তার গুণিতক হয়ে থাকে। শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে একজন যাত্রী ২০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণবার সঙ্গে আনতে পারেন। অলঙ্কারের মতো স্বর্ণবার আমদানির কোন পরিমাণ শুল্কমুক্ত বা ফ্রি নাই। ১০০ গ্রাম সোনার বারের শুল্ক প্রায় ২৭,০০০ টাকা । ২০০ গ্রাম হলে ৫৫,০০০ টাকা। এই পরিমাণ গ্রামে ওজন হিসেবেÑ সংখ্যা হিসেবে নয়। যাত্রী ২ জন হলে মোট ৪০০ গ্রাম এর ২টি বা ৪টি বার আনতেই পারেন। তবে বিপত্তি বাধবে আইনের এই লক্ষণরেখা অতিক্রম করলে। যেমন ১১৭ গ্রাম ওজনের ২টি বার হলে এর মোট পরিমাণ ২৩৪ গ্রাম যা আমদানি নিষিদ্ধ। সেটি চোরাচালান পর্যায়ে পড়ে এবং সেক্ষেত্রে যাত্রী অপরাধী। অতিরিক্ত পরিমাণ স্বর্ণবার ডিএম (ডিটেনশন মেমো) করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আটক করবে। পরে শুনানি করে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ মোহাম্মদ ফরহাদ সোনা নিয়ে নানা জটিলতা এড়াতে যাত্রীদের সর্বক্ষণিক তথ্যাদি সরবরাহ ও পরামর্শ দিচ্ছেন। এ জন্য বিমানবন্দরে তিনি সর্বক্ষণিক একটি হট লাইন চালু করেছেন। +৮৮০১৮৬৬৫৪৪৪৪৪Ñএই নম্বরে ইচ্ছে করলে দেশ-বিদেশের যে কোন যাত্রী ফোন করে জেনে নিতে পারেন প্রয়োজনীয় সব প্রশ্নের উত্তর। এ সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ মোহাম্মদ ফরহাদ জনকণ্ঠকে বলেন, আটককৃত স্বর্ণ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ হেফাজত করে এবং আইনানুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। প্রযোজ্যক্ষেত্রে মামলাটি বিমানবন্দর থানার মাধ্যমে নিয়মিত আদালতে দায়ের করা হয়। আদালতের আদেশমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কাস্টমস আইনটি মোবাইল কোর্ট আইনের আওতাভুক্ত না হওয়ায় স্বর্ণ আটক বা চোরাচালান সংক্রান্ত কোন মামলা বিমানবন্দর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দায়ের করা হয় না বা সেখান থেকে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। তিনি বলেন, অতিরিক্ত সোনার বার ডিএম করে আটক রাখা হলেও সেগুলো বহনকারীর ভাগ্যে কিন্তু জেল-জরিমানা জুটতে পারে। যাত্রীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সামান্য অর্থের লোভে বা অন্য কারও প্ররোচনায় এই অন্যায় কাজটি থেকে বিরত থাকুন। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন। নির্ধারিত পরিমাণ ট্যাক্স পরিশোধ করুন। সন্দেহ ও হয়রানি এড়াতে স্বর্ণক্রয়ের মূল রসিদ সঙ্গে রাখুন। আপনার সঙ্গে শুল্ক পরিশোধযোগ্য অর্থাৎ ১০০ গ্রামের বেশি স্বর্ণালঙ্কার বা ২০০ গ্রাম পর্যন্ত সোনার বার থাকলে বিমানবন্দরে পৌঁছে ব্যাগেজ ঘোষণা ফরমে (ব্যাগেজ ডিক্লিয়ারেশন ফরম) তা উল্লেখপূর্বক কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। ব্যাগেজ ঘোষণা ফরমসহ রেড চ্যানেলে কর্মরত কাস্টমস কর্মকর্তাকে ঘোষণা দিয়ে বলতে হবে যে, ‘আমার কাছে এই পরিমাণ স্বর্ণ আছে। আমি তার জন্য নির্ধারিত ট্যাক্স দিতে চাই।’ ঘোষণা ফরমে উল্লেখ না করলে বা রেড চ্যানেলে কাস্টমস কর্মকর্তাকে অবহিত না করলে যদি সার্চ করে বিভিন্ন লুক্কায়িত স্থান থেকে স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়, তবে বৈধ পরিমাণ স্বর্ণও অবৈধ হতে পারে। চোরাচালানের বিভিন্ন কলাকৌশলের আশ্রয় না নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শরীরের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে বা বিনা ঘোষণায় ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে নানা অবৈধ পদ্ধতি অনুসরণ করে স্বর্ণ আমদানি বা সঙ্গে রেখে আইন ভঙ্গ করবেন না। ট্যাক্স পরিশোধ করা হলে কাস্টমস কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত চালান কপি সঙ্গে রাখুন। পরবর্তীতে চেক করা হলে চালান কপি বৈধতা প্রমাণ করবে। চোরাচালান একটি অপরাধ। এটি বিমানবন্দর তথা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে। অলঙ্কার ও বার একত্রে আনতে কী করবেন ॥ যদি কেউ সোনার গয়না এবং সোনার বার একত্রে আনতে চায়, সে ক্ষেত্রে কী ঘটে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় বিমানবন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট ও শুল্ক কর্মকর্তাদের। এ সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ মোহাম্মদ ফরহাদ জানান, সোনা আমদানির জন্য মনে রাখতে হবে সোনার অলঙ্কার বা গয়না, সোনার বার বা পি- দুটি আলাদা পণ্য। একটির সঙ্গে অপরটির কোন সম্পর্ক বা শুল্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব নেই। আপনি চাইলে দুটি পণ্যই আনতে পারেন। প্রথম পণ্য সোনার গয়না আনার ক্ষেত্রে কোন সীমা ব্যাগে রুলে নেই। তবে শুল্ক ছাড় আছে। ১০০ গ্রাম পর্যন্ত বিনা শুল্কে আনতে পারবেন। এর অতিরিক্ত ১ গ্রামের জন্য ১,৫০০ টাকা ট্যাক্স দিতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয় পণ্য সোনার বার বা পি- আমদানির কোন শুল্ক ছাড় নেই। কিন্তু সীমা আছে। ১০০ গ্রাম সোনার বার প্রায় ২৭,০০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম সোনার বার বিদেশ হতে আগত একজন যাত্রী প্রায় ৫৫,০০০ টাকা ট্যাক্স দিয়ে আনতে পারবেন। ব্যাগেজ রুলে সোনা আনার বিষয়ে যাত্রীদের সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ট্যাক্স আপনার পণ্যের বৈধতা দেয়। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবেন না। বিমানবন্দরে কারও সঙ্গে অবৈধ লেনদেন করবেন না। কারও মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে কান দেবেন না। হয়রানি এড়াতে স্বর্ণক্রয়ের রসিদ সঙ্গে রাখুন। আপনার আনা পণ্য শুল্কযুক্ত বা ট্যাক্সেবল হলে ব্যাগেজ ঘোষণা ফরমে ক্রমিক ১০ এ ‘হ্যাঁ’ অংশ টিক দিতে হয় এবং রেড চ্যানেলে শুল্ক কর্মকর্তাকে অবহিত করতে হয়। ট্যাক্সেবল (শুল্কপরিশোধ যোগ্য) না হলে ঘোষণা ফরমে ক্রমিক ১০ এ ‘না’ অংশে টিক দিতে হতে হবে। গ্রীন চ্যানেলে কোন শুল্ক কর্মকর্তা জানতে চাইলে যাত্রীকে বলতে হবে ‘আমার কাছে পরিমাণ সোনার গয়না আছে যা ট্যাক্সেবল না। কেউ কেউ সামান্য কিছু টাকার লোভে অন্যের দেয়া পণ্য বহন করেন। তাদের বহনকারী বা ক্যারিয়ার বলা হয়। সামান্য অর্থের লোভে অন্যের ক্যারিয়ার হয়ে আইন অমান্য করবেন না। এতে আপনার নিজের ক্যারিয়ার ধ্বংস হতে পারে। এতে আপনি পরিবার বা সমাজের চোখে অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। অন্যের দেয়া কোন প্যাকেট বা ব্যাগ সঙ্গে আনার পূর্বে নিশ্চিত হয়ে নিন। চেক ব্যাগেজ বা বুকিং দেয়া ব্যাগেজে স্বর্ণ আনবেন না। আনলে বুকিংয়ের সময় রসিদসহ বিমান কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। অন্যথায় হারিয়ে গেলে ক্ষতিপূরণ পাবেন না। আনচেক ব্যাগেজ বা হাত ব্যাগ বা হ্যান্ড ক্যারিজে স্বর্ণ বা মূল্যবান পণ্য বহন করাই সবচেয়ে নিরাপদ। যদি কখনও কোন প্রেক্ষিতে হাত ব্যাগেজও বুকিংয়ে দিতে হয় সে ক্ষেত্রে হাত ব্যাগ থেকে স্বর্ণ বের করে পার্স বা পকেটে রাখাই নিরাপদ। জানা যায়, বর্তমান ব্যাগেজ নীতিমালা অর্থাৎ যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা-২০১২ সালে প্রণীত। তবে এটি ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে সংশোধন করা হয়েছে। যদি ২০১৫-১৬ সালের বাজেটেও ব্যাগেজ রুলে সোনা আনার নীতিমালা সেই আগের মতোই অপরিবর্তিত। তবে ব্যাগেজ রুলের বাইরে অতিরিক্ত বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বাণিজ্যিক পরিমাণে স্বর্ণ আনা যায়। কনসাইনমেন্ট করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের অনুমতি সাপেক্ষে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে সোনা আমদানি করা যায়। শুল্ক বিভাগ জানায়, বিমানবন্দরে এসে ট্যাক্স প্রদানের মতো পর্যাপ্ত টাকা সঙ্গে না থাকলেও কোন সমস্যা নেই। এ ক্ষেত্রে যাত্রীকে কাস্টমস কর্মকর্তাকে ঘোষণা দিয়ে বলতে হবে ‘আমার এই পণ্যটি ডিটেনশন মেমো (ডিএম) করে রেখে দিন। আমি পরে এসে ট্যাক্স দিয়ে নিয়ে যাব।’ এভাবে রেখে কিন্তু হাওয়া হয়ে যাবেন না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ট্যাক্স দিয়ে নিয়ে যান। যথাসময়ে না নিলে পণ্যটি নিলাম হয়ে যেতে পারে।
×