ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজনীতিকরা বিচার বিভাগ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলে ব্যবস্থা ॥ প্রধান বিচারপতি

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৬ জুলাই ২০১৫

রাজনীতিকরা বিচার বিভাগ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলে ব্যবস্থা ॥ প্রধান বিচারপতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যদি বিচার বিভাগ নিয়ে অযাচিত মানহানিকর বক্তব্য দেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা। তিনি আরও বলেছেন, বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে রাজনীতিবিদদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। বিচার বিভাগ এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচার বিভাগের হাত এত খাটো না, যে এ ধরনের অহেতুক বক্তব্য সব সময় হজম করতে হবে। রবিবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিন শুনানিকালে তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি এ মন্তব্য করেন। এদিকে ফখরুলের জামিন শুনানিতে প্রধান বিচারপতি কি মন্তব্য করেছেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান বিচারপতি খুব অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে সবার প্রতি সমান বিচার, সমান আচরণ করে যাচ্ছেন। তারপরও কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিচার বিভাগ নিয়ে যে সমস্ত বিরূপ মন্তব্য করেন সেগুলো খুবই দুঃখজনক এবং কোন আদেশ যখন তাদের বিরুদ্ধে যায় তখন তারা এ সমস্ত মন্তব্য করা শুরু করেন। এটি নিয়ে প্রধান বিচারপতি আদালতের পক্ষ থেকে খুব উষ্মা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রবিবার শুনানি চলাকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এক পর্যায়ে বলেন, আপনাদের স্মরণ করে দিতে চাই, যখন কোন সিটিং মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যায় তখন বলে দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলের কারও বিরুদ্ধে গেলে বিচার বিভাগ সম্পর্কে কথা বলেন। এ সময় খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আপনারা সর্বোচ্চ আদালত সর্ংবিধানের অভিভাবক। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রীমকোর্ট স্বাধীন বলেই আপনি এখানে এসে কথা বলতে পারছেন। নিম্ন আদালত স্বাধীন। কোন রকম রাজনৈতিক বক্তব্য দেবেন না। কোন অফিসারের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে তৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কোন বিচারপতির বিরুদ্ধে সামান্যতম অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। আমি কোন রাগ ঢাক রাখি না। প্রধান বিচারপতি কি মন্তব্য করেছেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রধান বিচারপতি যেটা বলেছেন বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে সবার প্রতি সমান আচরণ তারা করে যাচ্ছেন’। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তারপরও রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকা কেউ কেউ বিচার বিভাগ নিয়ে যে সমস্ত বিরূপ মন্তব্য করেন তা খুবই দুঃখজনক। কোন আদেশ যখন তাদের বিরুদ্ধে যায় তখন তারা এ সমস্ত মন্তব্য শুরু করেন। এমন কথা বলে প্রধান বিচারপতি আদালতের পক্ষ থেকে উষ্মা এবং অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন’। এ্যাটর্র্নি জেনারেলের কথায়, ‘প্রধান বিচারপতি বলেছেন তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে যখনই কোন আদালত ও বিচারক সমন্ধে কোন রকম অভিযোগ এসেছে সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নিয়েছেন’। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘শুনানিতে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলতে চেয়েছেন নিম্ন আদালতের বিচারকরা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারছেন না। প্রধান বিচারপতি এটাকে ভিত্তিহীন বলেছেন। বলেছেন এটা ঠিক না। বরঞ্চ মাসদার হোসেন মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিভাগ সুপ্রীমকোর্টের অধীনে। এ সমস্ত অহেতুক মন্তব্য থেকে বিরত থাকতে সব মহলকে তিনি অনুরোধ করেছেন। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখা সবার দায়িত্ব। রাজনৈতিক নানা রকম নেতৃত্ব যে দলে থাকুক না কেন বিচার বিভাগকে সমস্ত বিতর্কের উর্ধে রাখা উচিত। বিচার বিভাগের হাত অনেক লম্বা প্রধান বিচারপতির এমন মন্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি যেটা বলতে চেয়েছেন, যে বিচার বিভাগ সমন্ধে যদি এই অযাচিত মানহানিকর নানা রকম বক্তব্য দেয়া হয় সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগ তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থ নিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না। বিচার বিভাগের হাত এত খাটো না এ ধরনের অহেতুক বক্তব্য সব সময় হজম করবেন’। এদিকে রবিবার আদালত থেকে বের হওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বিচার বিভাগ সমন্ধে প্রথমে আমাদের প্রধান বিচারপতি বললেন, যে বিচার বিভাগ স্বাধীন না, বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রিত বিচার বিভাগের ব্যাপারে এ ধরনের মন্তব্য করার সময় আপনাদের সতর্ক মতামত দেয়া উচিত’। ‘আমি বললাম নিম্ন আদালত কাগজ-কলমে সংবিধানে স্বাধীন থাকলেও নিম্ন আদালত স্বাধীন না। সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। তখন প্রধান বিচারপতি বললেন, আমি অভিযোগ কেন্দ্র খুলেছি। আমি ওয়েবসাইট রেখেছি। আমি বলেছিলাম ১১০০ বিচারক সারাদেশে বসে তারা কে কি করেন, তার পারফরমেন্স এখানে বসে জনবলের অভাবে ডিজিটাল পদ্ধতির অভাবে প্রধান বিচারপতির পক্ষে জানা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে নিম্ন আদালতে রাজনৈতিক প্রচারে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘আমরা প্রথমে বলেছি আপনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আপনার বিভিন্ন বক্তব্য দেখে আমরা আশাবাদী। মনে রাখতে হবে বিচার বিভাগের অতীত ইতিহাস ভাল না। গণতন্ত্র রক্ষায় বিচার বিভাগের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়নি। সে কারণে অতীতে অনেক ঘটনা ঘটেছে। তার ফলে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণœ হয়েছে। কিন্তু আমরা আশাবাদী আপনি আসার পরে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। পরিবর্তনের হাওয়া চলতে থাকবে। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করবে’। অন্যদিকে নাশকতার অভিযোগে করা তিন মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের বিষয়ে আগামী ৮ জুলাই রায় দেবেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। রবিবার সকালে আবেদনের শুনানি নিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এছাড়া মির্জা ফখরুলের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করে একইদিন আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। নাশকতার অভিযোগে গত ৪ ও ৬ জানুয়ারি রাজধানীর পল্টন থানায় মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে এই তিনটি মামলা করা হয়। এসব মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন না পেয়ে ফখরুল হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। তার আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ২১ জুন হাইকোর্ট এই তিন মামলায় ফখরুলের অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করেন। গত সোমবার সুপ্রীমকোর্টের চেম্বার বিচারপতির কাছে রাষ্ট্রপক্ষ ফখরুলের জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করলে শুনানি শেষে চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আবেদনটি আপীল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। হরতাল-অবরোধে নাশকতার কাজে উস্কানি, প্ররোচনা ও পরিকল্পনার অভিযোগে রাজধানীর পল্টন ও মতিঝিল থানায় পুলিশের করা তিন মামলায় মির্জা ফখরুলকে জামিন দেয় হাইকোর্ট, যা বহাল রাখে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগও।
×