ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাকিস্তানে শিক্ষার পাঠ্যসূচীতে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ৬ জুলাই ২০১৫

পাকিস্তানে শিক্ষার পাঠ্যসূচীতে  বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে

পাকিস্তানে সম্প্রতি তিন-তিনটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে গেল যা পাকিস্তান তত্ত্বের অন্তরাত্মাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। প্রথমটি ঘটে গত ১৬ ডিসেম্বর পেশোয়ারের একটি সামরিক স্কুলে। সেখানে আল কায়েদার হানায় ১৫০-এর বেশি ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা হতাহত হন। আল কায়েদা এই নারকীয় হত্যাকা-ের দায় গ্রহণ করে বিবৃতি দিয়ে বলেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ওয়াজিরিস্তানে সন্ত্রাসী নিধনের নামে যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তার প্রতিশোধ নিতেই তাদের এই নৃশংস আক্রমণ। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে করাচির প্রাণকেন্দ্রে এক জনবহুল রাস্তায়। ওই সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন দেশের প্রখ্যাত মহিলা মানবাধিকারকর্মী চল্লিশোর্ধ সাবিন মাহমুদ, যিনি পাকিস্তানের বিদ্রোহ জর্জরিত বালুচিস্তান প্রদেশে ২২ হাজার নিখোঁজ মানুষের হয়ে আন্দোলন করে পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করে প্রচুর চাপে রেখেছিলেন। তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে করাচির উপকণ্ঠে সাফুর গোথে। যেখানে ৪৭ জন ইসমাইলীকে অমুসলিম আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানী সুন্নিরা বাসের মধ্যে হত্যা করে। এই তিন জঘন্য হত্যাকা- পাকিস্তানের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের বিবেককে এমনভাবে নাড়া দেয় যে, তারা এখন কঠিন আত্মসমীক্ষায় মগ্ন। পাকিস্তানী মিডিয়া, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এবং বড় বড় শহরের সভা-সমিতিতে এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে, যার সদুত্তর কারও কাছেই পাওয়া যাচ্ছে না। সঠিক কারণগুলো খুঁজে বের করতে তারা অন্ধের মতো হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে সবাই একমত, তা হলো আগামী দিনে পাকিস্তান এক দারুণ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে চলেছে। কানাডাপ্রবাসী পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবী রাহিল রাজা সম্প্রতি পাকিস্তানে এসেছিলেন সে দেশে যেসব হিংসাত্মক কা-কারখানা ঘটছে তার কারণ অনুসন্ধানে। তিনি কানাডায় ফিরে গিয়ে তাঁর ব্লগে দেশের বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে এক আকুতিভরা আবেদনে জানিয়েছেন, ‘পাকিস্তান এমন এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে চলেছে সে সম্বন্ধে খোদার ওয়াস্তে দেশের মানুষকে সচেতন করুন।’ তাঁর আরও হুঁশিয়ারি, ‘পাকিস্তানের সমূহ বিপদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ একেবারেই অজ্ঞ। তাদের এখনই ঘুম না ভাঙলে খুব দেরি হয়ে যাবে। তখন আর কিছুই করার থাকবে না।’ তিনি ব্লগে মিনতির সুরে লিখেছেন, ‘খোদার ওয়াস্তে কিছু করুন।’ খেদ ও দুঃখের ভাষায় তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানে এমন কোন সংস্থা বা সংগঠন নেই যা হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস রাখে। দেশের বিচার ও শুভবুদ্ধির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যার জন্য আগামী দিনে পাকিস্তানকে চড়া মাসুল দিতে হবে।’ রাহিল রাজা ‘ঞযবরৎ ঔরযধফ ঘড়ঃ গু ঔরযধফ’ বইটি লিখে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘দেশের রাজনীতিক ও উচ্চকোটির মানুষই পাকিস্তানের বর্তমান চরম হতাশাজনক পরিস্থিতির জন্য দায়ী। কিন্তু দেশের এই করুণ অবস্থার জন্য তাদের কিছুই যায় আসে না। কারণ অবস্থা বেগতিক দেখলেই তারা বিদেশে পাড়ি জমায়। যেখানে বিশাল অর্থভা-ার ও সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তুলেছে তারা। আর নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য সবসময়ই ভারতের দিকে তাদের আঙ্গুল উদ্যত। কিন্তু এখন সারা বিশ্ব তাদের দিকে আঙ্গুল তাক করায় তারা চরম অসহায় বোধ করছে।’ বর্তমানে পাকিস্তানের মিডিয়া, সভা-সমিতি ও ব্লগে এমন সব মতামত প্রকাশ পাচ্ছে যা পাকিস্তান স্থাপনের পর ছাপার অক্ষরে কোনদিন প্রকাশ পায়নি বা প্রকাশ্যে কেউ বলার সাহসও দেখাননি। ভারত, ধর্মনিরপেক্ষতা, উদারবাদী চিন্তাভাবনা, হিন্দু, খ্রীস্টান, শিখ, পার্সি, শিয়া, আহমেদিয়া ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ঘিরে এসব মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। বক্তব্যে যেসব বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে তা থেকে বোঝা যায়, শিক্ষিত ও সমাজের চিন্তাভাবনায় একটা নজিরবিহীন পরিবর্তন আসছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। এসব মতামতের সবচেয়ে সদর্থক দিক হলো সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, বর্তমান পাকিস্তানে যেসব নারকীয় কা- ঘটছে তার বীজ লুকিয়ে আছে দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষাপদ্ধতি এবং দেশের সামাজিক-ধার্মিক আচার-ব্যবহারে। কিন্তু সকলের বক্তব্যের যে মূল সুর তা হলো, ধর্মান্ধতা যখন ধর্মকে ছাপিয়ে যায় তখন পাকিস্তানের মতো সব অভাবনীয় কর্মকা- ঘটতে বাধ্য। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, কিছুদিন আগে পাঞ্জাবের গবর্নর সালমান তাসির নিজের দেহরক্ষীর দ্বারা নিহত হন। সেই ঘটনাকে শিক্ষিত পাকিস্তানীদের নিন্দা বা ধিক্কার জানাতে দেখা যায়নি। বরং এই ঘটনাকে পুরোমাত্রায় সমর্থন করে তারা। এমনকি হত্যাকারীকে ‘সাহসী ও সাচ্চা মুসলমান’ হিসেবে বাহবা দেয় এবং তাসিরের দেহ কবরস্থ না করতে দেয়ার জন্য ইমামদের খেপিয়ে তাঁর জানাজা বয়কটের আহ্বান জানায়। এই ঘটনাক্রম থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পাকিস্তানের শিক্ষিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশের মনস্তত্ত্বে এখনও এক ভয়ঙ্কর গলদ জাঁকিয়ে বসে আছে। তাসিরের অপরাধ ছিল, তিনি দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থে ব্লাসফেমি আইনের সংশোধন চেয়েছিলেন। তিনি এমন এক আইন প্রণয়নের কথা ভাবছিলেন যা দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু ও খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে ব্লাসফেমির মামলার হাত থেকে রেহাই দেবে। কিন্তু কট্টরপন্থীরা এতে খেপে যায়। তাঁর এই সংস্কারবাদী মনোভাবে দেশের সংখ্যালঘু বিষয়কমন্ত্রী সালমান ভাট্টিরও সায় ছিল। ফলে দু’জনেই নিশানা হয়ে যান সংস্কারবিরোধী জেহাদীদের। কিন্তু এই উগ্র ভাবধারা রাতারাতি গজিয়ে ওঠেনি। সরকার ও রাষ্ট্রনীতির বদান্যতাতেই এই সংস্কারবিরোধী ভাবধারা লালিত-পালিত হয়েছে। পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশ নির্দ্বিধায় স্বীকার করছে এই উগ্র ধর্মীয় ভাবধারার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দ্বিজাতিতত্ত্ব যা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকে থেকে থেকেই জাগিয়ে তোলে। এর প্রতিফলন ঘটে নানা ধরনের নৃশংস কর্মকা-ে। দেশের প্রথিতযশা বিদ্বজ্জনরা এর জন্য দুষছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো ও প্রাক্তন সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউল হককে। এই দু’জনই দেশের সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে আরও গভীর, দীর্ঘায়িত ও বিস্তৃত করেছেন তাঁদের রাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে। জুলফিকার আলি ভুট্টো যেমন একদিকে আহমেদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করেন, তেমনি অন্যদিকে জিয়াউল হক বিধর্মী ও মুসলিম গোষ্ঠীবৈরিতাকে শিক্ষার পাঠ্যক্রমের অঙ্গ করে মুসলমানদের মনে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করেন। এই ব্যাপারে পাকিস্তানের এক প্রথিতযশা বিদ্বজ্জন লিখেছেন, করদাতাদের পয়সায় সরকারী ও বেসরকারী স্কুল এবং কলেজে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর যে ধরনের ধর্মীয় মগজধোলাই চলছে তা রীতিমতো বিপজ্জনক। বিশেষ করে ব্লাসফেমি আইনকে আরও কঠোরভাবে কার্যকর করার প্রেক্ষিতে। যদিও ব্লাসফেমি কি বা কাকে বলে এবং সেই সংক্রান্ত আইন সম্বন্ধে ছাত্রছাত্রীদের বিন্দুমাত্র ধ্যান ধারণা নেই। এই বিদ্বজ্জনদের মতে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ করে স্কুলস্তরে শিক্ষার পাঠ্যক্রমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে এমন সব ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে দেশের সংখ্যালঘুরাই শুধু নয়, মুসলিম সমাজের অন্য গোষ্ঠীগুলোও নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এমনকি তারা মানসিকভাবেও বিপন্নবোধ করছে। এর ফলে হিংসা, পারস্পরিক অবিশ্বাস দেশকে গ্রাস করছে। এক আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থার সমীক্ষায় প্রকাশ, পাকিস্তানে প্রাথমিক স্তর থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তকের ২৫টি অধ্যায় আছে, যার বিষয়বস্তু হচ্ছে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ। কিন্তু দেশভাগের সময় পাঞ্জাব, সিন্ধুপ্রদেশের স্কুল ও কলেজের পাঠ্যপুস্তকে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে কোন বিদ্বেষমূলক অধ্যায়ের উপস্থিতি ছিল না। শিক্ষকরাও ক্লাসে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে কোন রকম বিদ্বেষ ভাবনা প্রচার করতেন না। পাকিস্তানের শিক্ষিত রাজনীতিকদের এক বিরাট অংশ বিধর্মী ও স্বধর্মী সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এখনও এমন সব বিদ্বেষপূর্ণ ভাবধারা পোষণ করেন যা তাদের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়ে হিংসাত্মক কর্মকা-ে মদদ যোগায়। পাকিস্তান ক্রিকেটের প্রাক্তন অধিনায়ক এবং অক্সফোর্ডের স্নাতক ইমরান খান হলেন এই প্রজাতির রাজনীতিকদের জ্বলন্ত প্রমাণ। তিনি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল তেহরিক-এ ইনসাফের প্রধান। তাঁর নির্দেশে সীমান্তবর্তী এক প্রদেশে, যেখানে তাঁর দল প্রাদেশিক সরকার পরিচালনা করে, সেখানকার সরকারী স্কুলে জেহাদের উপকারিতা সম্বন্ধে একটি অধ্যায় পাঠ্যক্রমে ফিরিয়ে এনেছে। এটি পূর্ববর্তী বামপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পরিচালিত প্রাদেশিক সরকার বাদ দিয়েছিল। ইমরান ও তাঁর দলের নেতাদের যুক্তি হলো, জেহাদ ইসলামী দর্শন ও ভাবধারার অঙ্গ এবং তা মুসলিমদের পাঠ্যসূচী থেকে বাদ দেয়া চরম অনৈতিক কাজ। তাদের মতে, মুসলিমদের জেহাদী মানস ও মেজাজে ভাটা পড়েছিল বলেই ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং ব্রিটিশ রাজ্যের সূচনা হয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যার পাশাপাশি এমন সব কথাও বলা হচ্ছে যা সাধারণ পাকিস্তানীরা শুনতে অভ্যস্ত নয়। যেমন মুসলিম মৌলবাদের হোতা হলেন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব। তাঁর সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও বিদ্বেষমূলক রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক নীতিকে পাকিস্তান আজও আঁকড়ে ধরে রয়েছে। কয়েকজন তো প্রকাশ্য সভায় বলছেন, যতদিন না এই বিদ্বেষ ও বৈষম্যের নীতির অবসান ঘটছে এবং বহুত্ববাদের ধ্যান-ধারণা পাকিস্তানে কার্যকর হচ্ছে, ততদিন দেশটি যে তিমিরে আছে সেই তিমিরেই পড়ে থাকবে। সব ধর্মাবলম্বীরা রাষ্ট্রের কাছে সমমর্যাদা না পেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। সেটা না হলে পাকিস্তান ক্রমশই হিংসা, অস্থিরতা আর অনুন্নয়নের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে। ওই বিদ্বজ্জন উদাহরণ স্বরূপ পাকিস্তানের একমাত্র নোবেলজয়ী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আবদুস সালামের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। ড. সালাম আহমেদিয়া হওয়ায় তাঁর সমাধিফলকে মুসলিম শব্দটা সরকার ও আদালতের নির্দেশে মুছে দেয়া হয়। এমনকি নবম শ্রেণীর ভৌতবিজ্ঞান পুস্তকে তাঁকে বিধর্মী ও তাঁর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রচুর গালমন্দ করা হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্রে তাঁর অবদানের কোন উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই তিনি কিভাবে শ’য়ে শ’য়ে পাকিস্তানী আণবিক বিজ্ঞানী ও গণিতবিদদের পশ্চিমের বিভিন্ন উন্নত পরমাণু গবেষণাগারে পাঠিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক মানের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে সাহায্য করেন। আর এক বুদ্ধিজীবী লিখেছেন, শুধু সালামই নন, পাকিস্তানের আরও অনেক কৃতী সন্তান স্বেচ্ছায় দেশান্তরিত হন যখন তারা বুঝতে পারেন যে, দেশের রাজনীতিকরা পাকিস্তানকে তার সব নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে এক কট্টর ওয়াহাবিবাদের হাতে তুলে দিচ্ছে জেহাদের লক্ষ্যপূরণের স্বার্থে। আহমেদিয়াদের প্রতি সরকারের বঞ্চনা ও বিমাতৃসুলভ আচরণের প্রতিবাদে আবদুস সালাম দেশান্তরী হন ১৯৭৭ সালে এবং সেই ধারা আজও অব্যাহত। অন্য এক বুদ্ধিজীবী তাঁর নিবন্ধে দেশে বিধর্মীদের প্রতি বিদ্বেষের বাতাবরণের একটা উদাহরণ দিয়েছেন। লাহোরের একটি নামী-দামী ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, কিছুকাল আগে সেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান এবং অন্যান্য অমুসলিম ধর্মশিক্ষার ক্লাস চালু করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে স্কুল কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। কারণ এর মাধ্যমে কোন কোন স্কুলের মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে সহনশীলতার মনোভাব গড়ে উঠত। কিন্তু এই খবর লাহোরের এক প্রভাবশালী উর্দু টিভি চ্যানেল বিকৃতভাবে প্রচার করে। যার ফলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে নানা হুমকি-ধমকির সম্মুখীন হতে হয়। বাধ্য হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ এই ধর্মশিক্ষার ক্লাস বন্ধ করে দেয়। যদিও পাক সুপ্রীমকোর্ট তাদের এক সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে মতপ্রকাশ করেছে, যাতে দেশের সংবিধানে উদারবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে কোনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। পাকিস্তানে বিধর্মীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও বৈরিতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেশের প্রথম সারির পরমাণু বিজ্ঞানী এবং গণিতশাস্ত্রের মহাপ-িত ড. পারভেজ হুদবয় দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকেই দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, পাকিস্তানের শিক্ষক ও ছাত্ররা যতদিন মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকবেন ততদিন দেশে মুক্তচিন্তা ও অবাধ যুক্তিপূর্ণ মতামত প্রকাশ সম্ভব নয়। এমনকি স্কুল-কলেজে পাস করা ছাত্রছাত্রীদেরও বিদ্যাবুদ্ধি বা চিন্তার উন্মেষ ঘটবে না। হুদবয়ের আরও বক্তব্য, ধর্মশিক্ষাকে পাঠ্যসূচীতে যতদিন অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেয়া হবে এবং গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষাকে ততোধিক গুরুত্বহীন করে রাখা হবে, ততদিন পাকিস্তানীরা সব হিংসাত্মক কর্মকা-ের মধ্যে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর ভূত খুঁজে পাবে। কারণ পাকিস্তানীদের অভ্যাস হয়ে গেছে, সবকিছুতেই বিদেশী ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করা। পাকিস্তানীদের মনস্তত্ত্ব বিচার করে হুদবয় বলেছেন, তাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে যুক্তির দ্বারা বিচার করার ক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। যার জন্য তারা কোন ব্যাপারেই যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। এই অক্ষমতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হুদবয় লিখেছেন, দেশের শিক্ষানীতিতে যুক্তিবাদকে এতটাই গুরুত্বহীন করে দেয়া হয়েছে, যার ফলে গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পেছনের সারিতে চলে গেছে। যার পরিণতিতে দেশে গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষার মান ক্রমশই নিম্নগামী এবং এই দুই শিক্ষায় পাকিস্তানীদের আগ্রহ ক্রমশই স্তিমিত হয়ে আসছে। হুদবয় দুঃখ প্রকাশ করে আরও লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও গণিত শিক্ষার মান এতটাই করুণ যে, অধ্যাপকরাও অধ্যাপনার কাজে সম্পূর্ণ অযোগ্য। গণিতশাস্ত্রের মূল কথা হলো, প্রতিটি পদে যুক্তি অনুযায়ী এগিয়ে সমাধানসহ উপসংহার টানা। যে অধ্যাপক যুক্তির দ্বারা ও সঠিক সংজ্ঞার সাহায্যে গণিত শাস্ত্রের সমস্যার সমাধানে দক্ষ নন এবং গোজামিলের ওপর নির্ভরশীল, তিনি ছাত্রদের কাছে বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে লজ্জাকর অবস্থার মধ্যে পড়তে বাধ্য। এর পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্তি ও সংজ্ঞার কোন বালাই নেই। শিক্ষক ক্লাসে যা সত্য বলে ছাত্রদের শেখান এবং ধর্মপুস্তকে যা সত্য বলে বর্ণিত হয়েছে, তা মুখস্থ করে ক্লাসে এসে উগরে দিলেই শিক্ষকদের কোন ঝামেলায় পড়তে হয় না। যার জন্য ধর্মশিক্ষার প্রতি পাকিস্তানী শিক্ষকদের এত দরদ। গণিত শিক্ষার মতো যুক্তির মাধ্যমে কোন প্রশ্নের সমাধান করার ঝামেলা নেই, নেই কোন কল্পনা বা অনুমানকে নস্যাত করার চ্যালেঞ্জ বা কোন তত্ত্বের যথার্থ নিরূপণের আগ্রহ। যে কারণে পাকিস্তানীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা সমাধানে কোন যুক্তির ধার ধারে না। ফলে দেশে ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ তত্ত্ব সাধারণ পাকিস্তানীদের প্রভাবিত করে রেখেছে। আর পাকিস্তানের কে বন্ধু বা কে শত্রু তা বিচার করার ক্ষমতাও তারা হারিয়েছে। ফলে যেসব গণহত্যার জন্য পাকিস্তান তালেবান দায় স্বীকার করে, সেসব কা-কেও দেশের সামরিক বাহিনীর কর্তারা ‘ভারতের কাজ’ বলে প্রচার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। হুদবয় আরও লিখেছেন, তর্কের খাতিরে যদিও বা মেনে নিই যে, ভারতের ‘র’ পাকিস্তানে ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞের ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়েছে, তবুও আমায় বলতে হয় ভারতের ‘র’-এর অন্তর্ঘাতের চেয়ে পাকিস্তানের পক্ষে তার শিক্ষানীতি অনেক বেশি ভয়ঙ্কর, মারাত্মক ও বিধ্বংসী। কারণ এই শিক্ষানীতি দেশের এক এক গোষ্ঠীকে ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে দেশকে মারাত্মকভাবে বিভাজিত করে রেখেছে। এক সময় এই মানসিকতারই প্রতিফলন ঘটেছিল সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীতে হিন্দুদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। যদিও ২০০০ সালের পর সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। কিন্তু হিন্দুরা এখনও ধর্মভিত্তিক বৈষম্যের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সম্প্রতি অশোক কুমার নামে এক হিন্দু সেনাজওয়ান ওয়াজিরিস্তানে তালেবানদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চলাকালীন অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেন। এই বলিদানে সেনাকর্তারা তাঁকে ‘তমঘা-ই-সুজাত’ পদকে ভূষিত করলেও সেনাকর্তারা তাঁকে শহীদ বলে মর্যাদা দিতে রাজি হননি। কারণ সেনাকর্তাদের মতে, শহীদ আখ্যা শুধু বীর মুসলিম যোদ্ধাদের জন্যই সংরক্ষিত। হুদবয় আরও লিখেছেন, ধর্মীয় শিক্ষাকে পাঠ্যসূচীতে এতটাই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে যে, সরকারী স্কুলে দশম শ্রেণীর গণিত ক্লাসে অঙ্কের বদলে শিক্ষকরা ইসলামিয়াত পড়ান। এমনকি অমুসলিম ছাত্রছাত্রীদেরও তা পড়তে বাধ্য করা হয়। এই ধারা শুধু একটি-দুটি স্কুলেই সীমাবদ্ধ নয়, এর ব্যাপ্তি বলা যায় প্রায় পাকিস্তানজুড়ে। ধর্মশিক্ষা যেহেতু মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল, তাই স্কুলের শিক্ষকরা ধর্মশিক্ষাকে পাঠ্যসূচীতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। যাতে ক্লাসে এসে ছাত্রছাত্রীরা গড় গড় করে তাদের ধর্মীয় পাঠ উগরে দিতে পারে এবং শিক্ষকদের কোন বিব্রতকর প্রশ্নের মুখে পড়তে না হয়। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হুদবয় লিখেছেন, পাকিস্তানের লোকদের সব ধরনের সমস্যাকে ‘ভারতের ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’ দিয়ে চাপা দেয়ার চেষ্টা হয়। আসল কারণকে অস্বীকার করে উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা হয়। যে কারণে কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে যুক্তি বিচারের পথ না ধরে সোজাসুজি গোলাগুলি ও হিংসার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। হুদবয়ের আরও আপেক্ষ, পাকিস্তানী টিভি চ্যানেলগুলোতে যে ধরনের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়, তার মান দেখলে বোঝা যায় দেশের মানুষের চিন্তাভাবনার কি ভয়াবহ অবনমন ঘটেছে। পরিবর্তনের এই চিন্তা-ভাবনা শিক্ষিত সমাজের এক ক্ষুদ্রাংশের মধ্যেই সীমিত। বিশাল অশিক্ষিত জনসাধারণের চিন্তাভাবনায় এই পরিবর্তনের কোন ছাপই পড়েনি। যার ফলে আজও সংখ্যালঘুদের জোর করে ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করা হয়। তাদের মন্দির-গির্জা-গুরুদ্বারের ওপর হামলা চালিয়ে তা দখল করে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। অন্য এক নামী-দামী পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবী লিখেছেন, যে সাম্প্রদায়িক দানবকে আটষট্টি বছর আগে পাকিস্তান স্থাপনের সময় বোতল থেকে মুক্ত করা হয়েছিল, মুসলিমদের হেফাজতের লক্ষ্যে সেই দানব ইতোমধ্যে সরকারী ও রাজনৈতিক মদদে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে অতিকায় রূপ নিয়েছে, যাকে পুনরায় বোতলবন্দী করা অসম্ভব। অন্য আর এক বুদ্ধিজীবী অপকটে স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানে এমন কেউ নেই যে এই উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক ষাঁড়কে শান্ত করে বাগে আনতে পারে। কারণ ওই ষাঁড়টি এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে তাকে বাগে আনা খুবই কঠিন কাজ। হুদবয়ের মতে, গলদে ভরা শিক্ষানীতির জন্যই সন্ত্রাসবাদ আর একই সঙ্গে দেশের মানুষের সহ্যের সীমারেখাও অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সেই সঙ্গে একই অনুপাতে তাদের বিজ্ঞানমনস্কতা ও দূরদৃষ্টি হ্রাস পেয়েছে দারুণভাবে। যার ফলে দেশের শিল্প বিকাশ, শিল্পোৎপাদন, চলচ্চিত্র শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি এবং শেয়ারবাজার অনুন্নতই রয়ে গেল। এই ক্ষেত্রগুলোই হলো যে কোন দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি। এই নিরিখে পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি ছোট দেশের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। মাদ্রাসাকে প্রথাগত শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা হলেও মাদ্রাসা শিক্ষার মানের কোনও উন্নয়ন ঘটেনি। তাই মাদ্রাসা থেকে পাওয়া হাফেস-ই-সায়েন্স ও হাফেজ-ই-ম্যাথস ডিগ্রীগুলো একেবারেই মূল্যহীন। চাকরির বাজারে এই ডিগ্রীর কোন চাহিদা নেই বা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো কোন মাপকাঠিও নয়। লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌতবিজ্ঞানের এই অধ্যাপকের মত, শিক্ষানীতির আমূল সংস্কার আনলেই পাকিস্তানকে এখন যেমন অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে হচ্ছে, তা আর করতে হবে না। বরং শিক্ষাসংস্কারই এমন এক পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটাতে পারে যার সম্বন্ধে পাকিস্তানীদের কোন ধারণাই নেই। কিন্তু সেটা দেশের নীতিনির্ধারক ও আম পাকিস্তানীরা বুঝেও বুঝতে চাইছেন না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক ও দৈনিক স্টেটসম্যানের (বাংলা) সম্পাদক
×