ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে ওরা;###;সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম প্রকল্পকে স্থায়ী কর্মসূচীতে রূপান্তর ॥ তিন বছরে বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় সাত গুণ

ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত দুস্থদের পাশে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৪ জুলাই ২০১৫

ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত দুস্থদের পাশে সরকার

আনোয়ার রোজেন ॥ আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন নাজমা আক্তার (৩৭)। কিডনির জটিল রোগ নাজমাকে নিয়ে যাচ্ছিল নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। চিকিৎসা করাবেন সে সামর্থ্য কই! তাই সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার উত্তর খিলগ্রামের অসহায় এই বিধবার দিন কাটছিল মৃত্যুর প্রহর গুনে। তবে আজীবন সংগ্রামী এই নারীকে এত সহজে হার মানতে দেয়নি সরকার। নাজমাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে নিয়েছে কার্যকর উদ্যোগ। তার চিকিৎসার প্রাথমিক ব্যয় মেটাতে আর্থিক সহায়তা হিসেবে দিয়েছে ৫০ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে সরকারী হাসপাতালের যাবতীয় চিকিৎসা সুবিধাও দেয়া হয়েছে বিনামূল্যে। নাজমা এখন অনেকটা সুস্থ। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন তিনি। শুধু নাজমা নয়, সারা দেশের ২ হাজার ৫৫৩ জন ক্যান্সার, কিডনি এবং লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত গরিব রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের বাঁচার নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে বর্তমান সরকার। সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় গত দুই বছরে এসব রোগীর চিকিৎসার জন্য রাজস্ব খাত থেকে ১২ কোটি ৮২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। তিন বছরে এই খাতে বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় সাত গুণ। নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়িয়ে ২০ কোটি টাকা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসহায় মানুষের ব্যয়বহুল চিকিৎসার ভার বহনে সরকারের সহায়তা নিঃসন্দেহে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি। এটি বর্তমান সরকারের গণমুখী কার্যক্রমেরও পরিচয় বহন করে। জানা গেছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম দুস্থ অসহায় রোগীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। সারাদেশে ৮৪টি হাসপাতালে বর্তমানে এ কর্মসূচী পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু ক্যান্সার, কিডনি এবং লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত গরিব রোগীদের সহায়তার জন্য কোন কার্যক্রম আগে ছিল না। প্রতিবছর দেশে প্রায় ৩ লাখ মানুষ এসব রোগে মারা যায় এবং ৩ লাখেরও বেশি মানুষ ক্যান্সার, কিডনি এবং লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব রোগের চিকিৎসাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই অর্থের অভাবে ক্যান্সার, কিডনি এবং লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। তেমনি তার পরিবারও চিকিৎসার ব্যয় বহন করে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘সাপোর্ট সার্ভিসেস ফর ভালনারেবল গ্রুপ’ (এসএসভিজি) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২০১১ সাল থেকে ক্যান্সার, কিডনি এবং লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত গরিব রোগীদের এককালীন ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে আসছিল। গরিব রোগীদের কল্যাণে পরিচালিত এ কার্যক্রম সকল পর্যায়ে প্রশংসিত হয়। প্রকল্পের সাফল্য বিবেচনায় নিয়ে সরকার এ কার্যক্রম স্থায়ী কর্মসূচীতে রূপদানের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই লক্ষ্যে ২০১৩ সালে এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়। এসব রোগে আক্রান্ত গরিব রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান, রোগীর পরিবারের ব্যয়ভার বহনে সহায়তা করা এবং রোগীকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সহায়তা করা-এই তিনটি বিষয় ঠিক করা হয় কর্মসূচীর উদ্দেশ্য হিসেবে। এরপর ২০১৩-‘১৪ অর্থবছর থেকে রাজস্ব খাতের আওতায় প্রথমবারের মতো সরকার এ সকল অসহায় ক্যান্সার, কিডনি এবং লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত গরিব রোগীদের এককালীন ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। সূত্র জানিয়েছে, কর্মসূচীর বাস্তবায়ন কার্যক্রম সন্তোষজনক হওয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে বরাদ্দের পরিমাণ। তিন বছরে বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় সাত গুণ। ২০১৩-‘১৪ অর্থবছরে এ কর্মসূচীর জন্য বরাদ্দ ছিল ২ কোটি ৮২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। ২০১৪-‘১৫ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়িয়ে ১০ কোটি টাকা করা হয়। ২০১৫-‘১৬ নতুন অর্থবছরে এ কর্মসূচীর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২০ কোটি টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুরু থেকে কর্মসূচী বাস্তবায়নে যাবতীয় প্রক্রিয়া অত্যন্ত দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে বিতর্কহীনভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। প্রকৃত দুস্থ ও প্রকৃত রোগী যাতে আর্থিক সহায়তা পান সেজন্য একাধিক পর্যায়ে দ্রুততার সঙ্গে আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়। ক্যান্সার, কিডনি এবং লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত গরিব রোগীদের শনাক্ত করে সমাজসেবা অধিদফতরের জনবল, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সুধীজনের সহযোগিতায় এ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসরণ করে প্রকৃত দুস্থ ও অসহায় ব্যক্তিদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়। প্রকৃত দুস্থ রোগী চিহ্নিত করতে সংশ্লিষ্ট রোগীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করা হয়। আর্থিক অসচ্ছলতা বিবেচনায় শিশু, নিঃস্ব, উদ্বাস্তু ও ভূমিহীনরা (বসতভিটা বাদে অনুর্ধ দশমিক ৫০ একর জমির মালিক) ক্রমানুসারে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। আর সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় অগ্রাধিকার দেয়া হয় বয়োজ্যেষ্ঠ, বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা, বিপতœীক, নিঃসন্তান এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের (ক্রমানুসারে)। রোগের যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট রোগীকে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্র, রোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ও টেস্ট রিপোর্ট জমা দিতে হয়। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে যাচাই-বাছাই শেষে সমাজসেবা অধিফতরের ৯ সদস্যবিশিষ্ট বাস্তবায়ন কমিটি আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির যোগ্য দাবিদারদের চূড়ান্তভাবে মনোনীত করেন। এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন কমিটিতে থাকা স্বাস্থ্য অধিদফতর মনোনীত সংশ্লিষ্ট রোগ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ের তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগের মাত্রা নির্ধারণ করেন। এরা হলেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মোঃ মাহবুবুর রহমান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস এ্যান্ড ইউরোলজির (এনআইকেডিইউ) সহযোগী অধ্যাপক ডা. দিলীপ কুমার রায় এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হেপাটোলজি বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ। সমাজসেবা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, কর্মসূচী শুরুর বছর (২০১৩-‘১৪ অর্থবছর) দেশের ৬৪ জেলা থেকে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি রোগী আর্থিক সহায়তার জন্য আবেদন করেন। সবচেয়ে বেশি আবেদনপত্র আসে সিলেট থেকে (৩৬টি)। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ আবেদনপত্র আসে খুলনা ও কুষ্টিয়া জেলা থেকে যথাক্রমে ২৮ ও ২৭টি। সবচেয়ে কমসংখ্যক আবেদনপত্র আসে শরীয়তপুর থেকে (মাত্র একটি)। আবেদনকারীদের সংখ্যার অনুপাত ও বরাদ্দ অর্থ বিবেচনায় নিয়ে সেবছর ৫৬১ জন চূড়ান্ত মনোনয়ন পান। তাদের প্রত্যেককে এককালীন ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়। এর পরের বছর (২০১৪-‘১৫ অর্থবছর) কর্মসূচীতে বরাদ্দের পরিমাণ ও রোগীদের আবেদনপত্রের সংখ্যা- দুটোই বাড়ে। সবচেয়ে বেশি আবেদনপত্র আসে সিলেট থেকে (৩০৯টি)। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ আবেদনপত্র আসে খুলনা ও কুষ্টিয়া জেলা থেকেÑ যথাক্রমে ২৩৬ ও ২৩৩টি। আর সবচেয়ে কমসংখ্যক আবেদনপত্র আসে রাঙামাটি থেকে (মাত্র একটি)। মোট চারটি কিস্তিতে ৪ হাজার ৪৪৬টি আবেদনের বিপরীতে ১ হাজার ৯৯২ জন রোগীর মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়। তাদের প্রত্যেকে আর্থিক সহায়তা হিসেবে পান এককালীন ৫০ হাজার টাকা। অসহায় এসব রোগীর চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর ক্ষেত্রে এই টাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন ও লড়াই করার সাহস জুগিয়েছে। আর্থিক সহায়তাপ্রাপ্ত নরসিংদীর বাসিন্দা ষাটোর্ধ মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘গলায় ক্যান্সার ধরছে- এইটা শুইনাই হাল ছাইড়া দিছিলাম। চিকিৎসার এত টাকা কই পামু, কেডায় দিবো! তয় সরকার এক লগে (এক সঙ্গে) ৫০ হাজার টাকা দেওনে মনে বল পাই। এখন আর মরণরে ডরাই না।’ রোগীদের আবেদনপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সঙ্গে যুক্ত জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মোঃ মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারের উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। রোগের ধরন অনুযায়ী ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যয়ে তারতম্য হয়। প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে অনেক রোগীই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। তাই আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বিবেচনার চেয়ে সেটা দিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রসঙ্গে কর্মসূচীর পরিচালক ও সমাজসেবা অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোঃ সাব্বির ইমাম জনকণ্ঠকে বলেন, চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার। তাই রোগের ধরন অনুযায়ী গরিব রোগীদের জন্য যথাসাধ্য উন্নত চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করাই কর্মসূচীর লক্ষ্য। আর্থিক সহায়তার জন্য আবেদনকারীদের শতকরা ৭০ ভাগই ক্যান্সার রোগী। আর বাকি ২৩ ভাগ কিডনি ও ৭ ভাগ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। তিনটি রোগের প্রত্যেকটির চিকিৎসাই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই আগামীতে এধরনের প্রত্যেক রোগীর জন্য আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ন্যূনতম ১ লাখ টাকা করার চিন্তা ভাবনা চলছে।
×