ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উজানের ঢলে ফুঁসে উঠেছে তিস্তা

তিস্তাপাড়ের ২৫ গ্রাম ও চর লণ্ড ভণ্ড ॥ বিপন্ন লাখো মানুষ

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ৩ জুলাই ২০১৫

তিস্তাপাড়ের ২৫ গ্রাম ও চর লণ্ড ভণ্ড ॥ বিপন্ন লাখো মানুষ

তাহমিন হক ববি, তিস্তা ব্যারাজ থেকে ॥ গর্জে ওঠা তিস্তার রুদ্রমূর্তিতে নদীর অববাহিকার লাখো মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। উজানের ঢলের বানে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন চর ও গ্রামের বসতিসহ চাষের জমি। তিস্তাপাড় কাঁপিয়ে তুলে ভয়ঙ্কর শব্দে তীব্র বেগে ছুটে চলছে উজানের ঢলের পানি। বিধ্বস্ত করেছে যৌথবাঁধ, মাটির চারটি ক্রস বাঁধ। হুমকির মুখে পড়েছে তিস্তার ডান তীর বাঁধ। সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড ফিউজ। সেখানে লালঝা-া উড়ছে। এ ছাড়া নড়বড়ে করে দিয়েছে ঘরবাড়ি। গাছপালা ঘরবাড়ি গবাদি পশুও ভেসে যাচ্ছে নদীর স্রোতের সঙ্গে। সবজির ক্ষেত যেমন তলায়, তেমনই বাসিন্দাদের অন্যতম জীবিকা মাছচাষের পুকুরেও নদীর পানি ঢুকেছে। চাষের মাছ বাইরে বেরিয়ে লোকসানের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বুধবারের মতো বৃহস্পতিবারেও ভারত ও বাংলাদেশ অংশের তিস্তা অববাহিকায় রেড এ্যালার্ট অব্যাহত রেখেছে উভয় দেশের সংশ্লিষ্টরা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া ডিভিশনের বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, বুধবার দুপুর ১২টা থেকে তিস্তা বিপদসীমায় চলে গিয়ে সন্ধ্যা ৬টায় ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলে বৃহস্পতিবার সকালে সেটি আরও ১৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়। যা সকাল ৬টা থেকে তিস্তার পানি নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৪০) ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ল-ভ- হয়ে গেছে তিস্তাপাড়ের ২৫টি গ্রাম ও চর। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তিস্তাপাড়ের মানুষের বুধবার রাত কাটে আতঙ্কে। কারও চোখে ঘুম ছিল না। ঘরবাড়ি ছেড়ে সকলেই আশ্রয় নেয় তিস্তার ডান তীর বাঁধ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেড ক্রসের তথ্য কেন্দ্রে। আতঙ্কের দৃষ্টি কেবল নদীর দিকেই তাদের। ঘরবাড়ি ছাড়া পরিবারগুলো অসহায়ের মতো ছিন্নমূলে পরিণত হয়েছে। ছোটখাতা গ্রাম, পূর্বছাতনাই গ্রাম, বানপাড়া, ডালিয়াপাড়া, একতার চর, বাঘের চর, ভাষানীর চর, ছাতুনামার চর, ভে-াবাড়ি ল-ভ- হয়ে পড়েছে। টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চরখড়িবাড়ি গ্রামে বাংলাদেশ ভারতের যৌথ বাধসংলগ্ন মাটির বাঁধটির ১ হাজার মিটার বুধবার রাত ১০টায় বিধ্বস্ত হয়। বাঁধটি ভেঙ্গে গেলে পূর্ব খগিবাড়ী, চর খড়িবাড়ী, জিঞ্জিরপাড়ার সহস্রাধিক পরিবারের বসতভিটার কোমর থেকে হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায়। পশ্চিম বাইশপুকুরের বালির ও মাটির তিনটি ক্রস বাঁধ বিধ্বস্ত হলে সেখানকার ২৪৩ পরিবারের বসতভিটায় বন্যার পানি প্রবেশ করে। বন্যার পানি প্রবেশ করার ২০টি পুকুরের কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে এলাকাবাসী জানায়। পানিতে তলিয়ে থাকায় তিস্তা পাড়ে বসবাসরত মানুষরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। মানুষ পরিমাণ পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় রান্না অভাবে না খেয়ে রোজা পালন করছেন তারা। চরাচঞ্চল এবং নি¤œাঞ্চলের মানুষরা নিজ বাড়িঘর ছেড়ে দিন কাটাচ্ছেন রাস্তা কিংবা স্কুল অথবা বাঁধে। ঘরে থাকা ধান-চাল, আসবাবসহ গৃহপালিত পশু নিয়েও চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। ঘরবাড়ি ছেড়ে যেন যাযাবরের মতো দিনযাপন করতে হচ্ছে তিস্তাপাড়ের প্রায় দশ হাজার মানুষকে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক মোঃ জাকীর হোসেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার রেজাউল করিম ও জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম। বন্যা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পেলেও ফ্লাডবাইপাস ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যারেজের সব গেট (৪৪টি) খুলে রাখা হয়েছে। দফতরের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী নজরদারির মধ্যে রেখেছেন তিস্তা ব্যারেজসহ আশপাশ এলাকা। খালিশা চাপানি ইউনিয়নের পশ্চিম বাইশপুকুর গ্রামের মানুষজন বলেছেন আমরা ত্রাণ চাই না। আমাদের বাঁধ ও রাস্তা মেরামত করে দেন। ছোটখাতা গ্রামের মকবুল হোসেনের স্ত্রী জমিলা বেগম জানায়, রাতে প্রবল বন্যার কারণে তিস্তার বাঁধে আশ্রয় নিয়েছিলাম। নাওয়া-খাওয়া কারও নেই। ভোররাতে শুধু পানি খেয়ে রোজা দিচ্ছি। একই গ্রামের আব্দুল জলিলের স্ত্রী শাহিনা বেগম (২৫) জানান, বাড়িঘরে কোমর পানি থাকায় নলকূপ পানির নিচে ডুবে রয়েছে। একই গ্রামের নুর মোহাম্মদের পুত্র আয়নাল জানান, তিস্তার প্রবল স্রোতের কারণে কাঁচা পায়খানা ভেসে গেছে। শুকনো খাবারের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, বন্যার ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য ইউপি চেয়ারম্যানদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম বন্যাকবলিত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। নীলফামারীর জেলা প্রশাসক জাকীর হোসেন জানান, ডিমলা উপজেলার বন্যাকবলিত সাতটি ইউনিয়নের জন্য জরুরী ভিত্তিতে ৮ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। কেন এই উজানের ঢল ॥ নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায় গত মঙ্গলবার রাতে উজানের সিকিমে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ওই পানি পাহাড় হয়ে ভারতের গজলডোবা ব্যারাজে আঘাত হানে। যা বাড়তি পানি ধরে রাখতে পারছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে বুধবার বেলা ১১টায় ভারত কর্তৃপক্ষ গজলডোবা ব্যারাজের ৩৮টি গেট খুলে দেয়। ওই খুলে দেয়া গেট দিয়ে প্রায় দেড় লাখ কিউসেক পানি ছাড়া হয়। ফলে ভারতের অংশে তিস্তা বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বাংলাদেশে ধেয়ে আসে। বাংলাদেশের ডালিয়াস্থ তিস্তা ব্যারাজ থেকে উজানের ১২০ কিলোমিটার অদূরে ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ হতে এই পানি ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। সূত্র মতে, গজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে ধুধু বালুচর আর বর্ষা মৌসুমে ভয়ঙ্কর গর্জন। মোট ৩১৫ কিলোমিটার তিস্তার গতিপথ বর্তমান চলছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ি জেলা ও কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার কালিগঞ্জ জিরো পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ। এই জিরো পয়েন্ট থেকে তিস্তা ভাটির ১২৪ কিলোমিটার পথ প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্রে। উত্তরবঙ্গের নীলফামারীর ডালিয়ায় অবস্থিত দেশের তিস্তা ব্যারাজ থেকে উজানে নদীপথে ৬০ কিলোমিটার অদূরে ভারতের দো-মোহনী। আর দো-মোহনী থেকে ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারতের তিস্তার গজলডোবা ব্যারাজ। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে গজলডোবায় পানি আটকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। সেখানকার ব্যারাজ থেকে ১ লাখ ৪২ হাজার কিউসেক পানি ছাড়া হয়েছে। তাতে তিস্তায় পানি বেড়ে ভারতের দো-মোহনী পয়েন্ট বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপরে চলে দুপুর ১২টায়। ফলে তিস্তা ভয়ঙ্করভাবে গর্জে ওঠে। উজানের এই পানি ধেয়ে আসায় বাংলাদেশ অংশে তিস্তা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। সামনে যা কিছু পায় সব ল-ভ- করে দেয়। সূত্র মতে, শুষ্ক মৌসুমে পানি চেয়েও পাওয়া যায় না ভারতের কাছে। আর উজানের বন্যা সামলাতে সব পানি বর্ষার সময় বাংলাদেশের ওপর ঘুরিয়ে দেয়া হয়। আসলে এর সমাধান প্রয়োজন। স্টাফ রিপোর্টার রংপুর থেকে জানান, ভারতীয় উজানের ঢলে তিস্তায় পানি বৃদ্ধির কারণে রংপুরের দুটি উপজেলার প্রায় ২৫ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। আকস্মিক এই পানি বৃদ্ধির কারণে সেখানকার মানুষজন চরম ভোগান্তির মুখে পড়েছেন। গরু-ছাগল ও গৃহস্থালি জিনিসপত্র নিয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছেন তিস্তার বাঁধসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। উজানের ঢলের কারণে বুধবার সন্ধ্যা থেকেই তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টের পানি বিপদ সীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইতে থাকে। আর মধ্যরাতে নদী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ধেয়ে আসে এ অঞ্চলের গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া এলাকায়। মধ্যরাতে তিস্তায় আকস্মিকভাবে বেড়ে যায় পানি এবং তা ছড়িয়ে পড়ে গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়ার বিভিন্ন অংশে। গঙ্গাচড়া উপজেলার চর ইসলী, চর মুটুকপুর, বিনবিনিয়ার চর, কোলকোন্দসহ বিভিন্ন এলাকা এবং আলমবিদিতর ইউনিয়নের পাইকান, ব্যাংকপাড়া পীরেরহাটসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে।
×