ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেখে যেতে পারেননি দ্বীপ

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৩ জুলাই ২০১৫

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেখে যেতে পারেননি দ্বীপ

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘এই পথে আজ জীবন দিব, রক্তের বদলা ফাঁসি নেব।’ শাহবাগ আন্দোলনের প্রাক্কালে নিজ হাতে লেখা এ প্লেকার্ড হাতে রাস্তায় নেমে আসেন বুয়েটের ছাত্র আরিফ রায়হান দ্বীপ। রক্তের বদলে নয়, আইনী লড়াইয়েই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হচ্ছে। এমনকি ধারাবাহিকভাবে আইনী প্রক্রিয়ায় তা অব্যাহত আছে। তবে দেশের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া কোন একটি নরঘাতকের মৃত্যুও দেখে যাওয়া হয়নি দ্বীপের, বরং রক্ত দিতে হয়েছে তাকে। দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে গিয়ে ঝরেছে একটি তাজা প্রাণ, পরিবার হারিয়েছে তার সন্তান। এ নিয়ে বেশ আক্ষেপ তার সহযোদ্ধাদের! হেফাজত ইসলামের এক কর্মীর চাপাতির আঘাতে মৃত্যু হয় শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম পোস্টার রচয়িতা আরিফ রায়হান দ্বীপের। আর বৃহস্পতিবার ছিল তার দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী। প্রায় দু’বছর হলেও একবিন্দুর জন্যে হলেও সাহসী এ প্রজন্মযোদ্ধাকে ভুলতে পারেননি তার সহযোদ্ধারা। যুদ্ধাপরাধী মুক্ত বাংলাদেশে মুক্ত নিঃশ্বাস নেয়ার প্রবল তেষ্টায় উদগ্রীব তরুণ এ প্রজন্ম ভুলে যায়নি তার সহযোদ্ধাকে, শাহবাগের রাস্তায় সীমিত পরিসরে হলেও মোমবাতি প্রজ্বলন করে স্মরণ করেছে লড়াকু এক সৈনিককে। সহযোদ্ধাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্লগে দ্বীপকে স্মরণ করতেও ভুলেনি তারা। দ্বীপকে হারিয়ে তার পরিবার এখন অনেকটা অসহায়! বাবা ব্যবসা করলেও ওদিকে মন নেই তাঁর। সব সময় ছেলেকে নিয়ে কী যেন ভাবেন। সন্তান হারিয়ে মায়ের কি অবস্থা হয়, তা কলমের কালিতে তুলে আনা অসম্ভব! দ্বীপের মায়ের অবস্থাও একই! অনেক স্বপ্ন লালন করে পরিবারের দ্বিতীয় সন্তানকে পাঠিয়েছিলেন বুয়েটে, তবে তাকেও হারাতে হয়েছে। আর তার অন্যতম কারণ যুদ্ধাপরাধের বিচার। ছেলে জড়িয়ে যায় গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সঙ্গে। শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে। এছাড়াও রাজনীতিতে ছিলেন সক্রিয়। দ্বীপের বাবা শেখ আলী আজম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ছেলেকে বুয়েটে চান্স পাওয়াতে কতো কষ্ট করতে হয়েছে! অথচ আমার সমস্ত আশা-ভরসা ধুলোয় মিশে গেল। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার পর ভেবেছিলাম ছেলে পরিবারের হাল ধরবে। কিন্তু আজ আমি খুব অসহায়। এ অসহায়ত্ব একমাত্র বাবারাই বুঝবেন!’ এ অসহায়ত্ব শুধু বাবা আজম আলীর নয়, মা শাহানারা খানমও প্রায় ভেঙ্গে পড়েছেন। কাজকর্মে তার তেমন মন নেই। ছেলেকে স্মরণ করে এখন শুধু তার আশ্রয়স্থল একমাত্র কান্না। কন্না কিছুটা থামানো যেত যদি দ্বীপের হত্যাকরীর সঠিক বিচার পাওয়া যেত। তবে তাও পায়নি তার পরিবার। পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পরও হত্যাকারী হেফাজত কর্মী হাইকোর্টে রায়ের মাধ্যমে ছাড়া পেয়ে যান বলে জানেন দ্বীপের বাবা। তিনি বলেন, ‘শুনেছি আমার বাবাকে হত্যাকারী ওই ছেলেটি হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে যায়, তবে আমাদের খোঁজ নেয়া হয়নি। এটা কোনভাবে চিন্তাও করিনি। হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করার পরও হত্যাকরী কিভাবে ছাড়া পেল!’ তিনি আরও বলেন, ‘সবকিছুতো অকালে ঝরে গেল, আমার বাবা যেন তার বিচারটা পায়।’ সময়টা ২০১৩। উত্তাল শাহবাগ। শুরু হয় নানা চক্রান্ত, ধর্মের নামে হেফাজতে ইসলাম আঘাত হানতে থাকে একের পর এক। আর তাতেই হেফাজতের আঘাতে মৃত্যু হয় দ্বীপের। আক্রমণকারীর আঘাতে তিন মাস মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে জীবনযুদ্ধে হার মানেন শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম পোস্টার রচয়িতা বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আরিফ রায়হান দ্বীপ। ২০১৩ সালের ২ জুলাই রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আবস্থায় তার মৃত্যু হয়। অনেক স্বপ্ন নিয়ে বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতিতেও সক্রিয় তরুণ প্রজন্মের কা-ারী বুয়েট ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটিতেও স্থান করে নেয়। তবে সব আশায় গুড়েবালি ঢেলে দেয় একদল ধর্মব্যবসায়ীরা। ’১৩-এর ৯ এপ্রিল সকাল ১১ টায় নিজ ক্যাম্পাসের কাজী নজরুল ইসলাম হলের সামনে হেফাজত ইসলামের এক কর্মী চাপাতি দিয়ে তার ওপর হামলা চালায়। গুরুতর আহত দ্বীপকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হলেও পরে স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। আর সেখানেই তার মৃত্যু হয়, যেন একটি স্বপ্নের মৃত্যু! একজন প্রজন্মযোদ্ধার মৃত্যু। জানা যায়, আরিফ রায়হান দ্বীপ বুয়েটের রশিদ হলের ৩০২ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। হামলায় আক্রান্ত হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে ক্যাম্পাসে হেফাজতে ইসলামের নামধারী শিবিরের এক কর্মীকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেন তিনি। ওই ঘটনার পর থেকেই নানাভবে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিল। ধারণা করা হয়, এর জের ধরেই হেফাজতের ওই কর্মী দ্বীপের ওপর হামলা চালায়। তবে হামলার পর আর একটি কথা বলা হয়নি দ্বীপের। দ্বীপের ওপর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে গোয়েন্দা পুলিশ ওই বছরের ১৭ এপ্রিল মেজবাহ উদ্দীন মেজবাহ নামে বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রকে গ্রেফতার করে। আর ওই মেজবাহ পুলিশের কাছে দ্বীপের ওপর হামলার দায়ও স্বীকার করেন। তখনকার বেশ কয়েকটি খবরে বলা হয় পুলিশের কাছে মেজবাহ জানায়, দ্বীপ বুয়েটের একটি হলে ইমামকে হেফাজত ইসলাম সমর্থন করার কারণে কটূক্তি করেন। এর প্রতিশোধ নিতেই দ্বীপের ওপর হামলা চালান তিনি। বুয়েটের নিজস্ব তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দ্বীপের ওপর হামলার ঘটনায় মেজবাহ জড়িত থাকার বিষয় প্রমাণিত হওয়ায় বুয়েট প্রশাসন মেজবাহকে বহিষ্কার করে। তবে জানা গেছে পরবর্তী সময়ে মেজবাহ ছাড়া পেয়ে যায়। দ্বীপের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দ্বীপ স্মরণে আলোচনায় মুখর হয়ে উঠে। দ্বীপের আলোয় আলোকিত হয় ফেসবুকের নিউজফিড। ছাত্রনেতা জয়দেব নন্দী লিখেছেন, ‘প্রিয় দ্বীপ, তোর তীক্ষè আলো ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে; হয়ত সে আলোতে পুড়বে অন্ধকার, পুড়ে হোক ছারখার। ক্ষমা করিস ভাই।’ তরুণ সাংবাদিক নাজমুল শুভ তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আহ! দ্বীপ। তোমার রক্তকণিকা ধুয়ে দেবে সব ভবিষ্যতের অন্ধকার। আর কালের গর্ভে জ্বেলে যাবে আলোক বর্তিকা শতাব্দী থেকে শতাব্দী।’ হ্যাঁ দ্বীপদের আলো কোনকালেই নেভে, মৃত্যুর পর তা আরও জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে। শহীদ দ্বীপ স্মরণে শাহবাগে মোমবাতি প্রজ্বলন করে শাহবাগ আন্দোলন সমর্থকরা। ব্লগার এ্যান্ড অন লাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক (বোয়ান)-এর আয়োজনে বৃহস্পতিবার শাহবাগ জাতীয় যাদুঘরের সামনে এ আয়োজনে জড়ো হয় তার সহযোদ্ধারা। বোয়ানের সভাপতি অনিমেষ রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, দ্বীপকে স্মরণ করতে আমরা মোমবাতি প্রজ্বলন করেছি। সহযোদ্ধাকে আমরা স্মরণ রাখার চেষ্টা করেছি। তবে তার পরিবার যা হারিয়েছে, তা শোধ করার নয়। আর দ্বীপের বাবা শেখ আলী আজম জনকণ্ঠকে আরও বলেন, ছেলের জন্যে মসজিদে মিলাদের আয়োজন করেছি। আমার বাবা যেন অন্তত ওপারে সুখে থাকে। সবাই তার জন্যে দোয়া করবেন। ছেলের হত্যাকারীর সঠিক বিচার হোক।
×