ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হরতাল অবরোধে নাশকতা বিষয়ে সুপ্রীমকোর্ট

দায় হুকুমদাতার

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ৩ জুলাই ২০১৫

দায় হুকুমদাতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হরতাল-অবরোধের সময় যে নাশকতা হয় তার দায় আহ্বানকারীদের নিতে হবে। নেতৃত্বদানকারীরা কোনভাবেই দায় এড়াতে পারে না। বৃহস্পতিবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিন শুনানিতে সুপ্রীমকোর্ট এমন মন্তব্য করেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বাধীন আপীল বেঞ্চে মামলাটির শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গত ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা টানা তিন মাসের হরতাল অবরোধে প্রাণ হারিয়েছে দেড় শ’ জনেরও বেশি। আর এ ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছে অনেকে। এসব ঘটনায় দায়ের করা বেশ কয়েকটি মামলাতেই হুকুমের আসামি করা হয়েছে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে। এছাড়া বিএনপির বেশির ভাগ নেতাকর্মীই বিভিন্ন মামলার আসামি। শুনানিতে মির্জা ফখরুলের আইনজীবী ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেনকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, যেহেতু আপনারা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তার ফলে এই গাড়ি পোড়ানো হয়েছে, মানুষ মরেছে, সন্ত্রাসী কর্মকা- হয়েছে। অতএব এর দায়িত্ব আপনাদের নিতে হবে। জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, দেশনেত্রী (খালেদা জিয়া) বার বার বলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন হবে। আমাদের মহাসচিবের তরফ থেকেও এমন কোন বক্তব্য নেই যে, কোন রকম উসকানি দিয়েছেন। তার (ফখরুল) বিরুদ্ধে একমাত্র অভিযোগ, উসকানি দেয়া। রাষ্ট্রপক্ষও বলেছে, তার উসকানির কথা। বিষয়টি এখন বিচারে রয়েছে। বিচারে প্রমাণ হলে তখন দেখা যাবে। পরে প্রধান বিচারপতি বলেন, সব কিছুর পরেও আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা কখনই দায় এড়াতে পারে না। শুনানির পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ফখরুল সাহেব জামিনের দরখাস্ত দিয়েছিলেন। হাইকোর্ট তাকে জামিন দিয়েছেন। আমরা তার বিরুদ্ধে আপীল করেছি। আপীল বিভাগে শুনানি হয়েছে। শুনানিতে বলেছি, কোন রাজনৈতিক প্রোগ্রামের যদি ঘোষণা দেয়া হয় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে যদি ধংসাত্মক কাজ হয় বা কাউকে হত্যা করা হয়, সম্পত্তি ধ্বংস করা হয় সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে যারা আছেন তারা দায় থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন না। মাহবুবে আলম বলেন, এখানে পল্টন থানার তিনটি মামলা। একটা ৪ জানুয়ারি একটা ৫ জানুয়ারি, আরেকটা ৬ জানুয়ারি। অর্থাৎ একদিন পর পর তারা ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন। এ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হতো না যদি না রাজনৈতিক প্রোগ্রামগুলো দেয়া না হতো। কাজেই রাজনৈতিক প্রোগ্রাম দেয়ার ফলে যদি কোন রকম সম্পত্তি নষ্ট হয়, মানুষ মারা যায় এবং মানুষের ক্ষতি হয়, সেক্ষেত্রে এ ঘোষণা দেয়ার অন্তরালে প্রোগ্রাম দেয়ার পিছনে যাদের ভূমিকা বা নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি, দায়দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তাবে। এ কথাটা আমি আজ বলেছি। যারা কর্মসূচী ঘোষণা দেন তারা ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের দায় এড়াতে পারে না- প্রধান বিচারপতি কি এরকম কথা বলেছেন। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ এ কথা বলেছেন। ফৌজদারি কার্যবিধিতে এ রকম রয়েছে। এদিকে এ তিন মামলায় শুনানি শেষে আদেশের জন্য রবিবার দিন ধার্য করেছেন আপীল বিভাগ। এ তিন মামলায় জামিন বহাল থাকলে জামিনে মুক্তি পাবেন প্রায় ছয় মাস কারাবন্দী থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল। এদিকে, বিএনপি-জামায়াতের টানা তিন মাস হরতাল ও অবরোধের সময় চালানো নাশকতায় প্রাণ হারিয়েছে ১৫৩ জন। আর পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়েছে ৩শ’ জনেরও বেশি। এদের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে মোট ১৮১ জন ভর্তি হয়েছিলেন। এরমধ্যে ২২ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যান ১৪১ জন। এদের ২জন পুনরায় এসে এই হাসপাতালে ভর্তি হন। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে ৪১ জনের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া গেছে। বাকি ৯৫ জনই সাধারণ মানুষ। সর্বশেষ চাঁদপুরে ট্রাকে পেট্রোলবোমায় পুড়ে মারা গেছেন এক ট্রাকচালক। হামলার শিকার হয়ে দগ্ধ হওয়া ৩ জনের মধ্যে পরে ২ জন হাসাপতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আগুন ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে আড়াই সহস্রাধিক যানবাহনে। ৫ জানুয়ারি থেকে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় গত ৪ এপ্রিল পর্যন্ত পেট্রোলবোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৬৭ জন। পিকেটারদের ধাওয়া খেয়ে বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনায় মারা যান ১৯ জন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে মারা গেছেন পাঁচজন। ৯০ দিনের অবরোধ ও হরতালের মধ্যে সারা দেশে মোট ১ হাজার ৯৭০টি যানবাহনে আগুন দেয়া ও ভাংচুর করা হয়েছে। মোট ১৬ দফায় ৮০টি স্থানে রেলে নাশকতা হয়েছে। ৬ দফায় নৌযানে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে ভস্মীভূত গাড়ি মালিকদের মধ্যে ৮২৩ জন সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন। এখন পর্যন্ত ১৫৬ জন মালিক ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছেন। বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৩৫ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। সারা দেশে এসব নাশকতার ঘটনায় মামলা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০। গুলশানে নিজের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে গত ৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়া লাগাতার অবরোধ ডাকার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রোলবোমা হামলা চালিয়ে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। এর মধ্যেই ২৩ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ীর কাঠের পুল এলাকায় গ্লোরি পরিবহনের একটি বাসে পেট্রোল বোমা ছোড়া হলে অগ্নিদগ্ধ ও আহত হন ৩০ জন। এর মধ্যে নূর আলম নামে এক ঠিকাদার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকার পেচান গ্রামের বাসিন্দা দুই সন্তানের জনক নূর আলম ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন। তার দেহের ৪৮ শতাংশ পুড়েছিল। এরপর ৬৯ জনকে আসামি করে দুটি মামলা করেন যাত্রাবাড়ী থানার এসআই কে এম নুরুজ্জামান, যাতে অবরোধ আহ্বানকারী বিএনপি চেয়ারপারসনকে করা হয় হুকুমের আসামি। এজাহারে বলা হয়, খালেদা জিয়া দেশব্যাপী অবরোধের ডাক দেন এবং সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত দেশে অচলাবস্থা নিশ্চিত করতে নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন। তার ওই নির্দেশেই আসামিরা বাসে নাশকতা ঘটায়। মামলায় আসামি করা হলেও বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া ও সেলিমা রহমানকে বাদ দিয়েই অভিযোগপত্র দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। অভিযোগপত্রে ৮১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এই মামলায় গ্রেফতার সোহাগ ও লিটন নামে দুজনের হাকিমের কাছে জবানবন্দী দেয়ার কথা উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, কারা কারা জড়িত, পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে ওই দুই আসামি। অবরোধ এবং সেই সঙ্গে বিএনপি জোটের হরতালে তিন মাসে নাশকতা ও সহিংসতায় দেড় শ’ জনের মৃত্যু হয়, যার অর্ধেকের বেশি মারা যান গাড়িতে অগ্নিসংযোগ কিংবা পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের কারণে। তখন বেশ কয়েকটি মামলায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হয়।
×