ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

লাখ লাখ মানুষের বাড়িঘর তলিয়ে গেছে

উজানের ঢলে রুদ্রমূর্তি তিস্তার ॥ দুই পাড়েই রেডএ্যালার্ট জারি

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ২ জুলাই ২০১৫

উজানের ঢলে রুদ্রমূর্তি তিস্তার ॥ দুই পাড়েই রেডএ্যালার্ট জারি

তাহমিন হক ববি, তিস্তা ব্যারাজ থেকে ॥ ভয়ঙ্কর রূপে গর্জে উঠেছে তিস্তা। প্রবল স্রোতে শোঁ শোঁ শব্দে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে তিস্তা অববাহিকার এলাকা কাঁপিয়ে তুলছে। বুধবার বিকেল থেকে শুরু হওয়া ভারী বর্ষণের সঙ্গে উজানের ভারতের দো-মোহনী পয়েন্ট থেকে তিস্তার ঢল বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বাংলাদেশে ধেয়ে আসতে থাকায় ভারত ও বাংলাদেশ অংশের তিস্তা অববাহিকায় রেড এ্যালার্ট জারি করেছে উভয় দেশের সংশ্লিষ্টরা। উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢলে সর্বশেষ বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৪০) ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল এবং পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে বলে জানায় ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। বন্যায় তিস্তা অববাহিকার লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। তিস্তার চর ও নিচু এলাকার ঘরবাড়ির ওপর দিয়ে বানের পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে দেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েও উজানের ঢল সামাল দেয়া যাচ্ছে না। এদিকে তিস্তার ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজের উত্তরে ফ্ল্যাড ফিউজ এলাকায় টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে লালঝান্ডা। উজানের তীব্র পানির প্রবাহে তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড ফিউজটি বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে ফ্লাড ফিউজের ওপর দিয়ে যানবাহনসহ সাধারণ মানুষের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চরম সতর্কাবস্থা করায় তিস্তা অববাহিকার বিভিন্ন চর গ্রামে বসবাস করা পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং সতর্কতায় তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলা প্রশাসনের পক্ষে ডিমলা, জলঢাকা, হাতীবান্ধা ও কালিগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাগণ, বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিগণ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীগণ তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছেন। সূত্র মতে বুধবার সকাল ছয়টা থেকে বাংলাদেশে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। দুপুর ১২টায় ভারতের দোমোহনী তিস্তার পয়েন্ট থেকে বাংলাদেশের ডালিয়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্ভাবাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়, দোমোহনী পয়েন্টে তিস্তা বিপদসীমার (৮৫ দশমিক ৯৬) ৫২ সেন্টিমিটার (৮৬ দশমিক ৪৭) ওপর দিয়ে বাংলাদেশে ধেয়ে যাচ্ছে এবং পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভারতের আগাম এই খবর তাৎক্ষণিকভাবে নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক কে অবগত করে দেয় ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড। নীলফামারীর জেলা প্রশাসক জাকীর হোসেন ও লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, উজান থেকে তিস্তা নদীতে ভয়াবহ ঢল ধেয়ে আসার খবরে তিস্তা অববাহিকার বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাগণসহ সকল ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিকে তিস্তার বিভিন্ন চর ও গ্রামে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে আনতে বলা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারী দফতরের কর্মকর্তা বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তা, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে তিস্তার পাড়ের দুর্গতদের সহায়তা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। ফলে তাৎক্ষণিভাবে তিস্তা অববাহিকায় মাইকযোগে প্রচার চালিয়ে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়। দুপুর দুইটা থেকে থেকে তিস্তা অববাহিকায় ভারী বর্ষণ শুরু হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়। ফলে তিস্তার ডান তীর বাঁধে যে সকল পরিবার গবাদী পশুসহ আশ্রয় নিয়েছিল তারা পড়ে বেকায়দায়। ফলে তিস্তা নদীর সংলগ্ন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিয়ে সেখানে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এদিকে উজানের ঢলের সেই পানি বিকেল ৩টা থেকে বাংলাদেশের নীলফামারী ডালিয়া পয়েন্টে প্রতি ঘণ্টায় বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৪০) ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাওয়ায় সন্ধ্যা ৬টায় তা বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সূত্র মতে উজান থেকে যে ঢল ধেয়ে আসছে তাতে বাংলাদেশে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে দেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েও উজানের ঢল সামাল দেয়া যাচ্ছে না। এলাকাবাসী জানায় উজানের প্রচ- ঢলের কারণে তিস্তা ব্যারাজের ২০ কিলোমিটার উজানে তিস্তা নদী দুটি চ্যানেলে রূপান্তর হয়েছে। মূল চ্যানেল কালিগঞ্জ জিরো পয়েন্ট ছাড়াও টেপাখড়িবাড়ির চরখড়িবাড়ি দিয়ে তিস্তা নতুন চ্যানেলে প্রবেশ করেছে। পাশাপাশি নদী বাম ও ডান তীরের বাঁধ ঘেঁষে প্রবাহ হওয়ায় বাঁধের হার্ডপয়েন্ট ঝুঁকির মুখে পড়েছে। তিস্তা ভয়ঙ্কর ঢলের কারণে নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার কয়েকটি উপজেলার লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তিস্তার বানের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হলো নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলা, লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জ উপজেলা। এসব উপজেলার বাইশপুকুরচর, কিসামত ছাতনাই, ঝাড়শিঙ্গেরশ্বর, বাঘেরচর, টাবুর চর, ভেন্ডাবাড়ি, ছাতুনামা, হলদিবাড়ী, একতারচর, ভাষানীরচর, পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, গয়াবাড়ি, খালিশাচাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী, কৈমারী ও লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা ও কালিগঞ্জ উপজেলার তিস্তা অববাহিকার গ্রামগুলোর কাঁচা ঘরবাড়ি বানের পানির তোড়ে ভেঙ্গে পড়ছে। ভাষানীরচরের সহিদুল ইসলাম ও কিছামত চরের জাহিদুল হক মুঠোফোনে জানান তাদের গ্রামের প্রতিটি পরিবারের ঘর এক কোমর পানির নিচে রয়েছে। ঘরের ভেতর দিয়ে মানুষ সমান স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান বলেন, তার এলাকার পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি বানের পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথন জানান, কিছামত ছাতনাই চরের ২শ’ পরিবারকে নৌকা যোগে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহীন বলেন, ভাষানীচরের সাড়ে তিনশ পরিবারকে নিরাপদে আনা হয়েছে। খালিশাচাঁপানী ইউনিয়নের পূর্ববাইশপুকুর গ্রামটি এখন স¤পূর্ণ পানির নিচে। এ গ্রামে দুইশ’ পরিবার পানিবন্দী থাকায় তাদের বাইশ পুকুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় দেয়া হয়েছে বলে জানান ইউপি চেয়ারম্যান সামছুল হুদা।
×