ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রাইভেট ভার্সিটির উৎসে কর হ্রাসের মধ্য দিয়ে পাস হলো অর্থবিল

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩০ জুন ২০১৫

প্রাইভেট ভার্সিটির উৎসে কর হ্রাসের মধ্য দিয়ে পাস হলো অর্থবিল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ন্যূনতম কর হার পরিবর্তন, রফতানি ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসে কর হ্রাস, ক্যান্সার ওষুধ তৈরির কাঁচামালের শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, সিগারেটের শুল্কস্তর পরিবর্তনসহ বেশকিছু পণ্যের কর হ্রাস-বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সোমবার জাতীয় সংসদে অর্থবিল ২০১৫ পাস হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পাসের প্রক্রিয়া শুরু হলো। আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের বাজেট পাস হবে। গত ৪ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট পেশকালে অর্থমন্ত্রী সারাদেশে ন্যূনতম করের হার চার হাজার টাকা নির্ধারণ করেছিলেন। শহর ও গ্রামাঞ্চলের জন্য অভিন্ন ন্যূনতম কর নির্ধারণ করায় সমালোচনায় মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী। তাই অর্থ বিল পাসের আগে অর্থমন্ত্রী ওই কর হার পরিবর্তন করেন। ন্যূনতম নতুন কর হার হলোÑ ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অবস্থানরত করদাতার জন্য ৫ হাজার টাকা, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাসকারী করদাতার জন্য ৪ হাজার টাকা এবং সিটি কর্পোরেশন ব্যতীত অন্যান্য এলাকায় অবস্থানরত করদাতার ক্ষেত্রে ৩ হাজার টাকা। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধক্রমে অর্থমন্ত্রী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের উৎসে কর হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করেন। পাশাপাশি তৈরি পোশাকসহ রফতানি পণ্যের উৎসে কর এক শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ করা হয়। সেই সঙ্গে জীবনরক্ষাকারী উপকরণ বিবেচনা করে ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ তৈরির কাঁচামালের শুল্ক হার সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেন অর্থমন্ত্রী। প্রত্যাহার করা হয়েছে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের প্রতিষেধক, ভেষজ ও হারবাল ওষুধের কাঁচামালের শুল্ক। অর্থবিল পাসকালে অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর ছয়টি পণ্যের শুল্ক ও কর হ্রাসের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে অর্থমন্ত্রী মৎস্য ও পোলট্রি শিল্পের আয় থেকে কর কাটার প্রস্তাব পুনর্বিন্যাস করেন। এক্ষেত্রে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত পোলট্রি ও মৎস্য শিল্পের আয় করমুক্ত করা হয়েছে। ২১ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে পাঁচ শতাংশ এবং ৩০ লাখ টাকার উর্ধে আয়ের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর ধার্য করা হয়েছে। কোন ভবন বা বাড়ি বা এর কোন ইউনিট নির্মাণকালে নির্মাণসামগ্রী বাকিতে কেনা হলে পরবর্তী বছরের মধ্যে তা পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছিল বাজেট প্রস্তাবে। তবে পাস হওয়া অর্থ বিলে বলা হয়েছে, অন্য সবার ক্ষেত্রে এক বছরের এ বাধ্যবাধকতা থাকলেও রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। বাজেটে মুহিত আন্তর্জাতিক শিক্ষা কারিকুলাম অনুসরণকারী ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের টিআইএন সনদ দাখিল করা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেছিলেন। পাস হওয়া অর্থবিলে বলা হয়েছে, কেবল সিটি কর্পোরেশন ও জেলা সদরের পৌর এলাকায় ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলে এ নিয়ম খাটবে। এতদিন চাল, চিনি, সয়াবিন তেল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর নেয়া না হলেও বাজেটে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে শুকনো মরিচ, তেলবীজ, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত ভোজ্যতেল, চাল, চালের খুদ, গম, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ২ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর প্রস্তাব করেন মুহিত। তবে ‘জনস্বার্থে’ অর্থবিলে তা আর রাখেননি অর্থমন্ত্রী। তিনি জানান, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান (মার্চেন্ট ব্যাংক ছাড়া) ৪০ শতাংশ হারে আয়কর দেবে। এছাড়া যেসব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, তাদের বেলায় এই কর হার হবে ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে নতুন ব্যাংক, অর্থাৎ যেসব বেসরকারী ব্যাংক ২০১৩ সালে নিবন্ধন নিয়েছে সেগুলোর কর হার ৪০ শতাংশই হবে। মোটরসাইকেল সংযোজন শিল্পের ক্ষেত্রেও অর্থমন্ত্রী ছাড় দিয়েছেন। এই শিল্পকে আগামী তিন বছর সুযোগ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে এই শিল্পের জন্য যন্ত্রাংশ আমদানির সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ রেখে সম্পূর্ণ তৈরি মোটরসাইকেল আমদানির শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ করা হয়েছে। তবে রংবিহীন যন্ত্রাংশ আমদানির বিধান অব্যাহত রাখা হয়েছে। ডিশ এ্যান্টেনার কেবল আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০ শতাংশ। বই আমদানিতে যে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক ছিল, তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থবিল পাসের আগের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শেষ হয়। বাজেটের ওপর দীর্ঘ আলোচনার সমাপ্তি ঘটান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময় তিনি বাজেট নিয়ে সংসদে ও সংসদের বাইরে আলোচনা ও সমালোচনার জবাব দেন। তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি যে ভিত্তির ওপর এসে দাঁড়িয়েছে তাতে আগামী অর্থবছরে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধির বেড়া ভাংতে পারব। এ জন্য আমরা বিনিয়োগ বাড়াব। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের গতি বাড়িয়ে বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারের পরিমাণ বৃদ্ধি করব। তিনি জানান, বর্তমানে পাইপলাইনে ৬০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক সাহায্য জমে গেছে। সেখান থেকে আগামী অর্থবছরে অন্তত ২০ শতাংশ ছাড় করার প্রত্যাশা করেন তিনি। অর্থমন্ত্রী বলেন, গত কয়েক বছর ধরে দেশে বেসরকারী বিনিয়োগ জিডিপির ২১-২২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল আছে। দেশের মানুষের মধ্যে উন্নয়নের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আমরা বেসরকারী বিনিয়োগ ২৪ শতাংশে উন্নীত করতে পারব। এতে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধির বাধা অতিক্রম হবে এবং আমাদের মেয়াদ শেষে প্রবৃদ্ধি আট শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। তিনি রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধির পথে একটি সমস্যাই সামনে আছে। তা হলো রাজনৈতিক সুস্থিতি সেরকম না থাকা। দেশে এখন উন্নয়নের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। ফলে কেউ রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্ঠা করলে তারা গণশক্র বলে চিহ্নিত হবে। অর্থমন্ত্রী সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলেন, বাজেট বিশাল হলেও তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এ বছর ৯৫.৬ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে। ফলে দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেটও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। তবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী বলে অর্থমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রথম দুই বছর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছিল। মাঝখানে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি। এ বছর ৩০ শতাংশ বেশি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা উচ্চাভিলাষী, তবে তা অর্জনের সক্ষমতা আছে। এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা নতুন করে ১৮ লাখ করদাতা শনাক্ত করেছি। এ বছর করদাতার সংখ্যা ২০ লাখে উন্নীত করতে সক্ষম হব। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, জ্বালানি ও পরিবহন খাতে বরাদ্দ বাড়াতে গিয়ে এ দুটি খাতে বরাদ্দ কমে গেছে। আগামী বছর থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হবে বলে তিনি জানান। বাজেট ঘাটতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টাকার অঙ্কে বাজেট ঘাটতি বড় মনে হতে পারে। তবে তা জিডিপির পাঁচ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। গত কয়েক বছরে এ ঘাটতি সাড়ে চার শতাংশের উপরে উঠেনি। এবারও পাঁচের কাছাকাছি-ই থাকবে বলে আশা করছি। অর্থবিলের শুল্ক কর হ্রাস বৃদ্ধির পর অর্থমন্ত্রী সরকারের আর্থিক প্রস্তাব কার্যকরণ এবং কতিপয় আইন সংশোধনে আনীত অর্থবিল-২০১৫ সংসদে উত্থাপন করেন। বিলের ওপর কয়েকজন সংসদ সদস্য সংশোধন আনেন এবং কেউ কেউ বিলটি জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রস্তাব করেন। তবে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেলেও অর্থমন্ত্রী কোন কোন সদস্যের আনীত সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করেন। সংশোধনী প্রস্তাবগুলো গ্রহণ শেষে কণ্ঠভোটে অর্থ বিল ২০১৫ পাস হয়। আজ মঙ্গলবার পাস হবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট। আগামী ১ জুলাই নতুন অর্থবছরের শুরুতে এ বাজেট কার্যকর হবে। গত ১ জুন বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার পর ৪ জুন সংসদে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার এই বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী। বাজেটের ওপর অনুষ্ঠিত সাধারণ আলোচনায় মোট ২১৯ জন সংসদ সদস্য ৫৭ ঘণ্টা আলোচনা করেন। অর্থ বিল পাস শেষে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত সংসদের বৈঠক মুলতবি করেন।
×