ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শর্ত ছাড়াই মুক্ত, নির্যাতন হয়নি ॥ সীমান্ত চুক্তি মেনে চলায় ঐকমত্য ॥ বিজিবি

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২৬ জুন ২০১৫

শর্ত ছাড়াই মুক্ত, নির্যাতন হয়নি ॥ সীমান্ত চুক্তি মেনে চলায় ঐকমত্য ॥ বিজিবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবশেষে আট দিন পর বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) নায়েক রাজ্জাককে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কোন প্রকার শর্ত ছাড়াই রাজ্জাককে ফেরত দিয়েছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি)। তাঁর সঙ্গে থাকা অস্ত্র, গোলাবারুদও ফেরত দিয়েছে। রাজ্জাককে ঢাকায় আনা হচ্ছে। তিনি সুস্থ ও স্বাভাবিক আছেন। মিয়ানমারে আটক থাকাকালে রাজ্জাকের উপর নির্যাতন করা হয়নি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া ছবিগুলো সম্পর্কে লিখিত প্রতিবাদ করেছে বিজিবি। ঘটনার দিন রাজ্জাকের নাকে কামড় দিয়েছিল বিজিপির এক সদস্য। কামড়ের আঘাতে নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল। সেই ছবিই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। রাজ্জাককে দেশে ফেরত আনা সম্ভব হওয়ায় তার পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও মায়ানমার সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে রাজ্জাকের পরিবার। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ এসব তথ্য জানান। তিনি পুরো ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তাতে তিনি জানান, নাফ নদী দিয়ে ইয়াবার চালান আসে। ইয়াবা পাচার ঠেকাতে গত ১৭ জুন ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে দু’টি ভাড়া করা নৌকায় করে কক্সবাজারের নাফ নদীর জাদিমোড়া এলাকায় টহল দিচ্ছিল বিজিবির ৬ সদস্য। প্রতিটি নৌকায় তিনজন করে ছিল। টহলকালে সাধারণত দুই নৌকার মাঝে ৮০ থেকে ১০০ গজ দূরত্ব বজায় রাখা হয়। কিন্তু ওই দিন নদীতে স্রোত থাকায় এবং টহলের এক পর্যায়ে দুই নৌকার মধ্যে ৫শ’ থেকে ৬শ’ গজ দূরত্ব হয়ে যায়। নায়েক রাজ্জাকের নেতৃত্বে টহল চলছিল। রাজ্জাকের নৌকাটি একটি মাছ ধরার নৌকাতে তল্লাশি চালাচ্ছিল। এ সময় মিয়ানমারের সীমান্ত থেকে ৭ থেকে ৮ জন সিভিল পোশাক পরা লোকজন বিজিবির টহল দলের কাছে আসে। বিজিবি তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করলে তারা ১০ থেকে ১২ রাউন্ড গুলি চালায়। বিজিবিও গুলি চালায়। বিজিপির গুলিতে বিজিবির সিপাহী বিপ্লবের ডান হাত গুলিবিদ্ধ হয়। তিনি নৌকাতেই পড়ে যান। এ সময় অদূরে থাকা বিজিবির অপর টহল নৌকাটি কাছে দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়। এ নৌকার সিপাহী বেলাল পানিতে নেমে গুলি চালাতে থাকে। এতে বিজিপির এক সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে পানিতে পড়ে যায়। এ সময় বিজিপির আরও ৮ থেকে ১০ জন সাদা পোশাকে সেখানে চলে আসে। বিজিপি সদস্যরা বিজিবির নৌকায় উঠে। এ সময় বিজিবি ও বিজিপি সদস্যদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। বিজিপির এক সদস্য নায়েক রাজ্জাকের নাকে কামড় দেয়। সে আহত হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যেই বিজিবির অন্য সদস্যরা অন্য নৌকায় চড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যায়। পরে বিজিপি সদস্যরা নৌকার দুই মাঝিসহ নায়েক রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যায়। দুই মাঝিকে ওইদিনই ফেরত দেয় বিজিপি। কিন্তু নায়েক রাজ্জাককে আটকে রাখে। বিপ্লব ও বেলালকে উদ্ধার করে বিজিবি সদস্যরা। বিপ্লবকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামারিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। তিনি এখন সুস্থ। এমন ঘটনার পর বিজিবির তরফ থেকে বিজিপির সঙ্গে যোগাযোগ চলতে থাকে। ওইদিনই ভোর সোয়া ছয়টার দিকে বিষয়টি বিজিপি-২ এর অধিনায়ককে জানানো হয়। এরপর দফায় দফায় যোগাযোগ হতে থাকে। ঘটনার দিন ও তার পরদিন পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু বিজিপি বরাবরই উপরের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন কিছুই জানাতে পারবে না বলে জানিয়ে আসছিল। এরপর নায়েক রাজ্জাকের হ্যান্ডকাফ পরিহিত ও নাক দিয়ে রক্ত পড়া অবস্থায় ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ছেড়ে দেয়ায় মারাত্মক আপত্তি করে বিজিবির তরফ থেকে। বাংলাদেশের পররাাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকেও কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়। মিয়ানমারের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো অব্যাহত থাকে। পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে মিয়ানমার বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত ও সামরিক উপদেষ্টা মিয়ানমার সরকার ও পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ জানান, প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা টানা বৈঠক হয়। মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়, বিজিবি সদস্যরা ইউনিফর্ম ব্যতীত দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর কড়া প্রতিবাদ জানান প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। আলোচনার এক পর্যায়ে বিজিপি তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে। এরপর বিজিপির তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়, বিজিবি সদস্যরা বাংলাদেশের জলসীমানা অতিক্রম করে মিয়ানমারের জলসীমানায় ঢুকে পড়েছিল। এরও কড়া প্রতিবাদ করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। পরে বিজিপি তাদের সেই অভিযোগ তুলে নেয়। পতাকা বৈঠক শেষে দুই দেশের প্রতিনিধি দলই ১৯৮০ সালে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত চুক্তি মেনে চলার বিষয়ে একমত পোষণ করে। এমনকি পারস্পরিক সহযোগিতা ও তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যমে অভিযান চালানোর বিষয়েও প্রতিনিধি দল একমত পোষণ করেছে। পাশাপাশি বিজিপির তরফ থেকে নায়েক রাজ্জাকের আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি তদন্ত করছে বলে জানানো হয়েছে। বিজিবি মহাপরিচালক জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় নায়েক রাজ্জাককে প্রতিনিধি দলের কাছে হস্তান্তর করা হয়। হস্তান্তরের সময় নায়েক রাজ্জাকের সঙ্গে থাকা অস্ত্র ও ২২ রাউন্ড গোলাবারুদও ফেরত দিয়েছে বিজিপি। তাৎক্ষণিকভাবে নায়েক রাজ্জাকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। নায়েক রাজ্জাক সুস্থ ও স্বাভাবিক আছেন। তাকে ঢাকায় আনা হচ্ছে। আটক থাকা অবস্থায় নায়েক রাজ্জাককে মোবাইল ফোনে তার সন্তান হওয়ার খবর বিজিবির তরফ থেকে বিজিপিকে জানানো হয়। বিজিপি সে খবর নায়েক রাজ্জাককে দেয়। এমনকি বিজিপি নায়েক রাজ্জাককে মোবাইল ফোনে তার পরিবারের সঙ্গে কথাও বলিয়ে দেয়। ইতোপূর্বে এমনটা ঘটেনি। নায়েক রাজ্জাককে ঠিকমতো খাবার, থাকার জায়গা, নামাজ আদায় করার সুযোগ ও রোজা রাখাসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করেছে বিজিপি। নায়েক রাজ্জাকও বলেন বিজিপির হাতে কোন প্রকার নির্যাতনের শিকার হননি। এদিকে রাজ্জাকের পরিবারের সর্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখা হয়েছে। সন্তান হওয়ার পর বিজিবির তরফ থেকে নায়েক রাজ্জাকের পরিবারকে নগদ ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। হস্তান্তরের পর প্রতিনিধি দল নায়েক রাজ্জাককে নিয়ে রওনা হয়েছেন। এদিকে নায়েক রাজ্জাককে হস্তান্তরের পর বিজিপির তরফ থেকে বিজিবির গুলিতে আহত বিজিপি সদস্যদে দেখে যেতে অনুরোধ করা হয়। এ সময় প্রতিনিধি দল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিজিপি সদস্যকে হাসপাতালে দেখতে যান। তাকে সান্ত¡না দেন। আহত বিজিপি সদস্য পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত। বিজিবির প্রতিনিধি দলটি স্পিডবোটে করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বিজিবি মহাপরিচালক আরও জানান, মিয়ানমার থেকে ওই পথে ইয়াবার চালান আসত। এজন্য গত বছর ওই জল সীমানায় একটি বিওপি স্থাপন করা হয়েছে। সেই চেকিং পয়েন্টে গত বছর নায়েক লুৎফর রহমান ১২ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করে। মিয়ানমারের ইয়াবা পাচারকারীদের কাছে লুৎফর রহমান এক আতঙ্ক। প্রায়ই লুৎফর রহমানকে মিয়ানমারের লোকজন খোঁজাখুঁজি করত বলেও জানান তিনি। কক্সবাজার থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, প্রতিনিধি দলটি রাজ্জাককে নিয়ে সন্ধ্যা ছয়টার পর টেকনাফ স্থলবন্দরের পুলিশ ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে পৌঁছায়। নাটোর থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, রাজ্জাকের মুক্তির খবরে নাটোরে তার গ্রামের বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। রাজ্জাকের পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। তাঁর স্ত্রী আসমা বেগম স্বামীর কোলে তাদের তৃতীয় সন্তানকে তুলে দেয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। প্রসঙ্গত, রাজ্জাক আটক হওয়ার চার দিন পর তাঁর তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয়। ছেলে বাড়ি ফিরলেই রাজ্জাকের ছেলের আকিকা করা হবে বলে জানিয়েছেন রাজ্জাকের মা বুলবুলি বেগম। রাজ্জাক বাড়ি ফিরলেই ওর ছেলের নামও রাখা হবে বলেও জানান তিনি।
×