ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যানজটে প্রাণ ওষ্ঠাগত

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৫ জুন ২০১৫

যানজটে প্রাণ ওষ্ঠাগত

রাজন ভট্টাচার্য ॥ মগবাজার থেকে সাতরাস্তা ক্রসিং পার হতে সকল যানকে সিঙ্গেল লেন ব্যবহার করে চলতে হচ্ছে। কারণ রাস্তা বন্ধ করে মৌচাক-মালিবাগ উড়াল সড়কের কাজ চলছে। অথচ এই রাস্তা দিয়ে মিনিটে দুই শতাধিক যানবাহন চলাচল করে। মৌচাক মার্কেটের সামনে চার লেন রাস্তার মধ্যে দুই লেন বন্ধ করে কাজ চলছে প্রায় মাসাবধি। এক লেন ব্যবহার করে দু’পাশের গাড়ি চলছে। মালিবাগ বাবুর্চি গলিতে এক লেন খোলা রেখে তিন লেন বন্ধ করে চলছে নির্মাণ কাজ। রাজারবাগ গ্রীন লাইন পরিবহনের কাউন্টারের সামনে একপাশের রাস্তায় একটি গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রেখে পুরোটাই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়াতেও একই চিত্র। প্রকল্পজুড়ে পাইলিংয়ের মাটি না সারানোয় বৃষ্টিতে কাদা হওয়ায় রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে। রাস্তার উপর রাখা হয়েছে নির্মাণ সামগ্রীসহ যন্ত্রপাতি। সোয়া আট কিলোমিটার এই প্রকল্পের পুরো রাস্তাই এখন গর্তে ভরা। কোথাও জমেছে পানি। বৃষ্টির পানিতে গাড়ি উল্টে দুর্ঘটনা নিয়মিতই হচ্ছে। ফুটপাথের বেহাল দশা বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে নগরীর ব্যস্ততম এই রাস্তাটি এখন ব্যবহার করার মতো নয়। এসব কারণে মৌচাক-সাতরাস্তা-শান্তিনগর-কাকরাইল চার্চ-মগবাজার-মালিবাগ-রামপুরা-রাজারবাগ-বেইলি রোড পর্যন্ত রাস্তায় দিনভর যানজট লেগেই থাকে। ঘণ্টার-পর ঘণ্টা যানজটের দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে চলতে হচ্ছে নগরবাসীকে। আশপাশের রাস্তাগুলোতেও আছে অসহনীয় যানজটের ভোগান্তি। রাজধানীজুড়েই এখন অসহনীয় যানজট। সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি যানজটের কারণে অচল হয়ে যায় সবকিছু। গাড়ি চলে না। অন্যান্য সময়ে রোজার মাসে যানজট নিয়ন্ত্রণে সেনা বাহিনী ও বিডিআর নামানো হলেও এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রশাসনিক কোন প্রস্তুতি নেই। যানজট মোকাবেলায় নেই সমন্বিত কোন পদক্ষেপ। ঢাকায় ১৩টি প্রবেশ মুখ ও বের হওয়ার রাস্তায়ও দিনভর যানজট আছেই। সিটি করপোরেশন, পুলিশ, ঢাকা যানবাহন কোঅর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ), রাজউক, ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যানজট নিরসনে কোন সমন্বয় নেই। স্ব-স্ব সংস্থা নিজেদের মতো করে কাজ করার চেষ্টা করছে। এদিকে যানজট নিরসন ও ফুটপাথসহ রাস্তা দখল রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না সিটি করপোরেশনের নব নির্বাচিত মেয়ররা। বাড়তি গাড়ি ও মানুষের চাপ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা ও নগড়জুড়ে রাস্তা-ফুটপাথ দখল করে মার্কেটসহ পার্কিং, যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানো, অনুমোদনহীন যানবাহনের দৌরাত্ম্য, ইচ্ছামতো গাড়ি ছাড়ার ব্যবস্থা, রাস্তায় আইন না মানা, যানজটের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়া ও কাঁচাবাজারের কারণে রাজধানীতে যানজটের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এছাড়াও সময়মতো ফ্লাইওভারের কাজ শেষ না হওয়াসহ ভাঙাচোরা রাস্তা ও খোঁজাখুঁড়ির কারণেও যানজট বেড়েছে। শপিং মলগুলোতে পার্কিং সুবিধার অভাব ও ঈদকে সামনে রেখে বাড়তি গাড়ির চাপ তো আছেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বিত উদ্যোগ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবেই যানজটের মাত্রা বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের ভোগান্তি। যা এই সময়ে আগের চেয়ে কয়েকগুণ। দ্রুত সময়ের মধ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে সমস্যা সমাধানের পরামর্শ তাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ নূরুল ইসলাম নাজেম জনকণ্ঠকে বলেন, সার্বিক দিক বিবেচনা করলে এটা রাজধানী শহর তা বোঝা যায় না। যেদিকেই তাকানো যায়, সেদিকেই পরিকল্পনার অভাব চোখে পড়ে। অর্থাৎ রাজধানী ঢাকাকে অপরিকল্পিতভাবে সাজানোর চেষ্টা চলছে, শুরু থেকেই। যে কারণে আজকের দিনগুলোতে যানজটসহ হাজারো সমস্যা মোকাবেলা করে এই শহরে বসবাস করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকার সমস্যা নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথা নেই। ট্রাফিক পুলিশ তাদের মতো কাজ করছে। বিআরটিএ, ডিটিসিএ, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোরে মধ্যে যানজট নিরসনে কোন সমন্বয় নেই। ঢাকা থেকে বের হতে ও প্রবেশ-মুখগুলোতে যানজট নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। শপিং মল থেকে শুরু করে বাড়িগুলোতে পার্কিং সুবিধা নেই। রাস্তা, ফুটপাথ দখল। উন্নয়ন কাজগুলো যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। নিজেদের ইচ্ছেমতো রাস্তা ব্যবহার করছেন সবাই। সঙ্গত কারণেই যানজট হবেই। এসব সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা যেমন প্রয়োজন তেমনি ব্যবস্থাপনা ঠিক করা জরুরী। বিশিষ্ট এই নগর পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, রাজধানীতে চলা ৯০ ভাগ যানবাহনের কোন ফিটনেস নেই। লাইট নষ্ট। অদক্ষ চালক। সব মিলিয়ে আমরাই যানজট সৃষ্টি করেছি। এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে বসেছে। যদি জরুরী ভিত্তিতে এসব সমস্যা সমাধানে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া না হয় তাহলে সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য আরও কষ্ট নিয়ে আসবে। সিটি করপোরেশনের আয়তন ৩৬০ বর্গকিলোমিটার দুই সিটিতে ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাথ রয়েছে। এরমধ্যে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটার ফুটপাথই এখন অবৈধ দখলে। আর ২ হাজার ২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭২ দশমিক ৪২ কিলোমিটার রয়েছে বেদখল। এদিকে দখল উচ্ছেদে কঠোর কর্মসূচী গ্রহণ করার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। রাজনৈতিক কারণে রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা রাজধানীর ফুটপাথ দখল করে রেখেছেন। উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে এসব সড়ক দখল মুক্ত করার পরে দেখা গেছে আবারও দখল হয়ে গেছে। আমি নিজে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছি এবং এক ঘণ্টা পরেই আবার ওই সড়ক দখল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, যানজট নিরসনে যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি এবং প্রকৌশলীদের পরামর্শে সড়কের জায়গা বাড়িয়ে চার লেন করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। কারণ যারা আইন প্রণয়ন করেন, তারাই আইন মানেন না। অনেক সংসদ সদস্য রয়েছেন যারা যানজট এড়াতে উল্টো পথে গাড়ি চালান। এই অবস্থা চলতে থাকলে ১৬ লেন করেও যানজট নিরসন করা সম্ভব হবে না। বুধবার সংসদ ভবন থেকে কাওরান বাজার আসতে সময় লেগেছে প্রায় দুই ঘণ্টা। প্রতিটি সিগন্যালে দীর্ঘ গাড়ির সাড়ি। যতদূর চোখ যায় গাড়ি আর গাড়ি। যাত্রীদের দীর্ঘ অপেক্ষা, সঙ্গে দুর্ভোগ। কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন, আগের চেয়ে গাড়ির চাপ অনেক বেড়েছে। রোজার মাসে অফিসের সময় পরিবর্তন হওয়া একটা বড় কারণ বলে উল্লেখ করেন তারা। এছাড়া আগের চেয়ে রাস্তায় গাড়ির চাপ কয়েকগুণ। বিশেষে করে প্রাইভেট কারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। একারণে যানজটের মাত্রাও সীমা ছাড়িয়েছে। রাজধানীর যানজট প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ঈদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আয়োজিত এক বৈঠকে বলেন, মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের কারণে যানজটের পাশাপাশি জনদুর্ভোগেরর মাত্রা বেশি বেড়েছে। তিনি বলেন, সবাই সহায়তা না করলে এই প্রকল্পের কারণে সামনের দিনগুলোতে আরও দুর্ভোগ বাড়বে। দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া না হলে এই রাস্তা ব্যবহারকারীদের সময়মতো ইফতার করাতে পারব কিনা জানি না। এই প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ না হওয়ায় দুর্ভোগের চরম সিমানায় পৌঁছে গেছে মানুষ। তিনি বলেন, এই রাস্তাটির জন্য মহাখালী থেকে শান্তিনগর-মালিবাগ-রামপুরা-রাজারবাগ-মগবাজার-ইস্কাটনসহ আশপাশের এলাকায় দিনভর যানজট থাকে। তাই ফ্লাইওভার প্রকল্পের যানজট ও জনদুর্ভোগ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর নির্দেশনা কামনা করেন তিনি। এছাড়া নগরীর সার্বিক যানজট নিরসনে পদক্ষেপ প্রসঙ্গে বলেন, ঢাকা থেকে বের হতে ও প্রবেশ করতে ১৩টি পয়েন্টে যানজটের সমস্যা হবে না। এসব পয়েন্টে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকা যানজটমুক্ত রাখতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নারীক্রেতাদের হয়রানি ঠেকাতে চাঁদনি চক মার্কেটে নারী পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বিকেল তিনটা থেকে পুলিশের সকল কর্মকর্তাকে রাস্তায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া রাস্তা ও ফুটপাথ হকারমুক্ত রাখতে অভিযান চলমান রাখার কথা জানান তিনি। রাজধানীর বাসাবো থেকে গুলিস্তান হয়ে পল্টন আসতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। যদিও রাস্তায় সমস্যা সামান্য। কিন্তু নিরসনের কেউ নেই। বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে থেকে সারি সারি অনুমোদনহীন মেক্সি, অটো ও সিএনজি রাখায় বাসগুলোকে আটকে থাকতে হয়। কমলাপুরে রাস্তায় বাজার। মুগদা হাসপাতালের পাশে আইডিয়াল স্কুলের সামনের রাস্তায় বাজার, মেক্সি ও অটোর উপদ্রব তো আছেই। মুগদা রাস্তার মাথায় একই চিত্র। এখানে নতুন করে যোগ হয়েছে শত-শত অটো। এর একটু সামনে এগিয়ে গেলে টিটিপাড়া মোড়ের আগেই রাস্তার উপর আইসিটি কন্টেনার ডিপোর সামনে সারি-সারি ট্রাক রাখা। তিন রাস্তার এই মোড়ে সব বাস পুলিশের সামনেই যাত্রী তুলছে। অন্যপাশে ময়লার কন্টেনারগুলো রাখা আছে রাস্তার ওপর। কমলাপুর স্টেশনের সামনের রাস্তায় যাত্রী ওঠানো-নামানো সবই চলে। রিক্সাসহ অন্যান্য পরিবহনের জটলা তো আছেই। পুলিশের চোখের সামনে এসব কারণে নিত্য ভোগান্তি হলেও নিরসনের ব্যবস্থা নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ারগামী তিশাসহ বেশ কয়েকটি আন্তঃজেলা রুটের পরিবহন চলে রাস্তা থেকেই। কমলাপুর বিআরটিসি ডিপোর সামনের রাস্তায় সারিবদ্ধ বাস রাখা হয়। অপরপ্রান্তে মতিঝিল মডেল স্কুলের গেটের সামনে পার্কিং থাকে বিভিন্ন ধরনের পরিবহন। আরামবাগের রাস্তা পেরুলেই নিউ ভিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রুটের গাড়ি রাখা হয় সারিবদ্ধভাবে। ফলে যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। এছাড়া রাস্তার দু’পাশে প্রাইভেট কারসহ অন্যান্য পরিবহন পার্কিং তো আছেই। শাপলা চত্বর ঘুরতে সময় লাগে ২০ থেকে ৩০ মিনিট। এর একমাত্র কারণ হলো, মোড় পার হয়ে সব বাসে যাত্রী তোলা হয়। যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকায় পেছনের গাড়ি চলাচল করতে পারে না। এই জট ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত গড়ায়। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টিকাটুলির রাস্তার দু’পাশে রিক্সাসহ মেক্সি ও বিভিন্ন পরিবহন রাখায় তিনভাগ রাস্তা দখলে থাকে। হকারদের উৎপাতে গোটা মতিঝিলের একটু ফুটপাথও খালি নেই। জনতা ব্যাংক, রাজউক এভিনিউ, গুলিস্তান মোড়ে সমস্যা হলো রাস্তার দু’পাশে সারি সারি গাড়ি, বাসগুলো দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা, ফুটপাথ ও রাস্তায় ব্যবসার কারণে দিনভর মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দৈনিক বাংলা থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে পার্কিং, ফুটপাথ বাণিজ্যের কারণে গাড়ি চলাচলে সমস্যা হয়। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাস্তায় বাস, ঘোড়ার গাড়ি, টমটম, ম্যাক্সি, রিক্সা, ভ্যান থেকে শুরু করে হাজারো রকমের পরিবহন চলছে দেদার। ফুটপাথ দখলের মহোৎসব চলে এই রাস্তাটিতে। রাস্তায়-রাস্তায় পণ্য ওঠানামা তো আছেই। ফল হলো যানজটের ভোগান্তি। মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগ পার হওয়ার পর শুরু হয় যাত্রী তোলা। বাসগুলো রাস্তার মাঝখানে থামিয়ে যাত্রী তোলায় রাস্তার তিন পাশে যানজট লাগে। একদিকে সায়েন্সল্যাবরেটরি, অন্যদিকে কাওরান বাজার আরেকপাশে নীলক্ষেত ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরোটাই অব্যবস্থাজনিত যানজট। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, কাওরান বাজারে নিয়মিত বাজার বসার কারণে রাজধানীতে যানজট হচ্ছে প্রতিদিন। এজন্য মহাখালী, যাত্রাবাড়ী ও আমিনবাজারে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা খরচ করে আলাদা তিনটি বাজার নির্মাণ হয়েছে। তাই কারওয়ান বাজার সরিয়ে নেয়ার কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, যে কনস্ট্রকশন কোম্পানি রাস্তায় নির্মাণ সামগ্রীসহ ময়লা রাখবে তাকে আগামী মাস থেকে ঢাকা শহরে কাজ করতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, সব ঠিক থাকলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ৫০ ভাগ জ্যাম কমে যাবে। তিনি বলেন, রাস্তায় রাস্তায় বাস থামিয়ে যাত্রী তোলায় যানজট হয়। তেজগাঁও এলাকায় ট্রাকস্ট্যান্ড বানিয়ে পুরো জায়গা দখল করা হয়েছে। তাদের কারণে মানুষ যানজটে পরে ঘণ্টা পর ঘণ্টা অপেক্ষা করবে, আমি মেয়র হিসেবে এটা আমি গ্রহণ করব না। আমি আশা করব অবৈধভাবে ট্রাক না রেখে টার্মিনাল করা হবে। আমিনবাজার ব্রিজের নিচে ইউটার্নটি দীর্ঘদিন বন্ধ। সঙ্গত কারণে রাস্তার উপরে গাড়ি ঘোরানো হয়। আমিনবাজার থেকে শ্যামলী পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে আন্তঃজেলার বিভিন্ন রুটের শত-শত বাস কাউন্টার রাস্তার ওপর। তেমনি রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয় বাস, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। আছে রাস্তার ওপর পেট্রোল পাম্প। ফুটপাথ ও রাস্তায় বাণিজ্য। সব মিলিয়ে যানজট লেগেই থাকে। বিশ্বরোড থেকে মালিবাগ রেলগেট মানেই যানজটের বিষফোঁড়া। এই সড়কটি এমনিতেই কিছুটা সরু। এর ওপর উত্তর সিটি করপোরেশনের কন্টেনার রাখা আছে একাধিক স্থানে। আছে ব্যবসা বাণিজ্যের পসরা। ফুটপাথ দখল। অযান্ত্রিক পরিবহন চলাচলের আধিক্য। ভাঙাচোরা রাস্তা। অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থা। যেখানে সেখানে বাসে যাত্রী তোলা। সব মিলিয়ে এই রাস্তাটি পাড়ি দিতে দিনের বেলায় সময় লাগে অন্তত তিন ঘণ্টা। ধানম-ি থেকে নিউ মার্কেট মানেই ভোগান্তির জায়গা। এই সড়কের দু’পাশে প্রায় অর্ধেক বন্ধ করে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম আর পার্কিং। অথচ দেখার কেউ নেই। ঢাকা দক্ষিণের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খান মোঃ রেজওয়ান যানজট প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, রমজান মাসে যানজট নিরসনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বাড়তি ফোর্স মোতায়েন। মার্কেট, বিপণিবিতান থেকে শুরু করে বিভিন্ন পয়েন্টে কমিউনিটি পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। বর্ষায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ারও কথা জানান তিনি। এর পরও যানজট কেন? এমন প্রশ্নে ট্রাফিক বিভাগের এই কর্মকর্তা জানান, নগরীর রাস্তা অনুযায়ী দুই লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারে। এরমধ্যে প্রতিদিন চলছে ১৪ লাখের বেশি পরিবহন। সেই সঙ্গে ঈদকে সামনে রেখে বাড়তি মানুষসহ পরিবহনের সমাগম তো রয়েছেই। তাই যানজট দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে আর বাড়তে পারে। বিগত দিন যানজট মোকাবেলায় সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হতো। সম্প্রতি তা দেখা যাচ্ছে না। এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। পয়ঃনিষ্কাশন নালা সংস্কারের জন্য প্রায় এক মাস ধরে বন্ধ আছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ফার্মগেট সংলগ্ন ইন্দিরা রোড থেকে আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়ে পান্থপথ, পূর্ব রাজাবাজার, পশ্চিম রাজাবাজার, কলাবাগানসহ আরও কয়েকটি গন্তব্যে যাওয়ার রাস্তা। এই সড়কটিতে পয়ঃনিষ্কাশন নালা স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। তবে স্থানীয়রা বলছেন, গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরানের তত্ত্বাবধানে সড়কটির সংস্কার কাজ শুরু হয়। অন্যান্য সময় এক সপ্তাহের মধ্যে এ ধরনের কাজ শেষ হলেও এবার এক মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও অর্ধেকেরও বেশি কাজ বাকি। ফলে এলাকায় যানজট ও ভোগান্তি দুটোই বেড়েছে। এদিকে সংস্কার কাজ শুরুর পর থেকেই ওই সড়ক হয়ে রিকশা, প্রাইভেটকারসহ অন্যান্য যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঝিগাতলা ও হাজারীবাগ সড়কে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। মোহাম্মদপুরের গজনবী রোডে খোঁড়াখুঁড়ি আর রাস্তার উপর ময়লা আবর্জনা ফেলায় রাস্তায় পরিবহন চলাচলে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এদিকে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের দায়ে বছরে মামলা হচ্ছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ। জরিমানা আদায় করা হচ্ছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এরমধ্যে প্রতিমাসে কমপক্ষে ৬০ হাজার মামলা হয়। এই হিসেবে বার্ষিক মামলার সংখ্যা সাত লাখ ২০ হাজার। আর্থিক জরিমানা আদায় হয় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা তবুও রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরছে না? আইন ভঙ্গের প্রবণতা বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, শুধুমাত্র ঢাকায় চালকসহ পথচারী ৯০ ভাগ মানুষ আইন ভঙ্গ করে চলেন। তাছাড়া ট্রাফিক আইনে মোটর ড্রাইভিং সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিধান জানে না বেশিরভাগ ট্রাফিক সার্জেন্ট। এ সংক্রান্ত কোন প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা নেই তাদের। পুলিশের প্রশিক্ষণের সূতিকাগার সারদাতেও এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। এমন বাস্তবতায় ট্রাফিক আইনে গুরুত্বপূর্ণ যে ১৬টি অপরাধ রয়েছে, প্রত্যেকটি অপরাধের জন্য পৃথক পৃথক শাস্তি থাকলেও তা উপেক্ষিত। আইন প্রয়োগে যেমন অজ্ঞ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তেমনি চালকরাও কিছুই জানেন না। সাধারণ আইন অর্থাৎ ১৩৭ ধারায় বেশিরভাগ মামলা করে থাকেন সার্জেন্টরা। পরিবহন চালকদের প্রশিক্ষক ও ট্রাফিক সার্জেন্ট মোঃ নুরুল মোমেন অসীম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ মামলা ও আর্থিক জরিমানা হলেও চালকদের আইন ভঙ্গের প্রবণতা কমছে না। এজন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো এক এক করে কঠোরভাবে বাস্তবায়নের দাবি জানান। তিনি বলেন, পুলিশ সার্জেন্টদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি প্রশিক্ষণ ইউনিট চালু করা যেতে পারে। কর্মকর্তারা দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে সার্জেন্টদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেবেন। এতে চালকরাও সচেতন হবে। কোন অপরাধে কি শাস্তি হয় তা জানতে পারলে চালকরা সচেতনভাবে গাড়ি চালাবেন।
×