ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

১৪ নমুনা পরীক্ষা রিপোর্ট ॥ কেলেঙ্কারিতে হাত রয়েছে এক কৃষক নেতার!

ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম খাওয়ার অনুপযোগী নয়

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২২ জুন ২০১৫

ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম খাওয়ার অনুপযোগী নয়

তপন বিশ্বাস ॥ ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম খাওয়ার অনুপযোগী নয়। গমের নমুনা পরীক্ষা প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। আমদানিকৃত গম নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে তার নমুনা পরীক্ষার জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন গবেষণাগারে পাঠানো হয়। রবিবার পর্যন্ত পাওয়া চৌদ্দটি নমুনা পরীক্ষার প্রতিটি প্রতিবেদনই খাওয়ার অনুপযোগী নয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এদিকে এই গম আমদানিকে কেলেঙ্কারিতে রূপ দিতে কৃষক লীগের এক সিনিয়র নেতার হাত রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, গমের নমুনা পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টির রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। এর প্রতিটিতে এই গম খাওয়ার উপযোগী বলে মন্তব্য করা হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, নমুনা পরীক্ষার সব রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তা দেশ ও জাতিকে জানিয়ে দেয়া হবে। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার আগে এ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে তিনি নারাজ। শনিবার জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে ‘শূন্যের ওপর’ কথা বলা হচ্ছে। কেউ গম পরীক্ষা করে কথা বলেননি। তিনি বলেন, ২০১১ সালে পাঁচ লাখ টন গম আমদানির জন্য ইউক্রেনের সঙ্গে একটা সমঝোতা স্মারক হয়। আমি দায়িত্ব পাওয়ার পরও ইউক্রেন থেকে আড়াই লাখ টন গম আনার জন্য দুই দেশের সরকারী পর্যায়ে আলোচনা হয়। পরে আমরা ই-মেইলের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা জবাব দেয়নি। এতে সময়ক্ষেপণ হয়ে যায়। গমের মজুদও তলানিতে চলে যায়। মাত্র ৬৮ হাজার টন মজুদ ছিল। এটা অত্যন্ত কম। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার বিরোধের জের ধরেই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়। ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গমের মান নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় সে গমের বেশকিছু নমুনা পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। তিনদিনের মধ্যে পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। তখন জাতির কাছে সত্যিকার তথ্য তুলে ধরতে পারব। প্রয়োজনে এ গম নষ্ট করাসহ যা করা দরকার তা করব। তিনি বলেন, আমরা আগে ব্রাজিল থেকে গম আনিনি। তবে এবার ব্রাজিল থেকে গম আনার দরপত্র ছিল সবচেয়ে কম। ক্রয় কমিটিতে তা পাস হয়। গম আমদানির পর আমরা নমুনা দেখলাম। গম ছিল লাল ও ছোট দানার। তবে পরীক্ষার প্রতিবেদন অনুযায়ী তা খাওয়ার অনুপযোগী নয়। তিনি বলেন, যেদিন আমাদের কাছে গমের নমুনা এল সেদিন কাকতালীয়ভাবে আমাদের একটা বৈঠক ছিল। এতে অর্থ ও কৃষিমন্ত্রী ছিলেন। তাদের সামনে নমুনা দেখালাম। তারা বললেন, নমুনা খারাপ। কিন্তু লাল গম এরকম হতেও পারে। পরে গম খালাসের অনুমতি দেয়া হয়। বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশ কৃষক লীগের এক সিনিয়র নেতা খাদ্য মন্ত্রণালয়ে ঠিকাদারি করতেন। তিনি নিয়মিত গম আমদানি করতেন। তখন কয়েক হাজার কোটি টাকার পচা গমের জাহাজ ডুবে যায়। অভিযোগ আছে, সাগরে এই পচা গমের জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়। তখন আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়ে সরকারকে অতিরিক্ত টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। কৃষক লীগের এই নেতা এবারও গম ক্রয়ের ঠিকাদারি নিতে জোর লবিং করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয়কে উকিল নোটিসও পাঠায়। এই নেতাই তার বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে পোকায় খাওয়া নষ্ট গমের নমুনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছেন বলে অনেকেই মনে করছেন। রবিবার খাদ্যমন্ত্রীর কক্ষে থাকা গমের নমুনায় দেখা গেছে, গমের রংটা একটু খারাপ। তবে তা পোকায় খাওয়া বা পচা কোন গম দেখা যায়নি। তা হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পোকায় খাওয়া এবং পচা গমের নমুনা গেল কিভাবে এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সংশ্লিষ্টরা অনেকে কৃষক লীগের এই সিনিয়র নেতার দিকে আঙুল তোলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৮ জুন মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর তাঁর সচিবালয়ের দফতরে খাদ্য সচিব মুশফেকা ইকফাৎকে ডেকে পলিথিনে ভরা পচা গমের নমুনা দেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পলিথিনের সেই গমগুলো ছিল পোকায় খাওয়া, কালো, ওজনে কম ও ক্ষুদ্র আকৃতির। ভাঙা গমের পরিমাণও ছিল অনেক বেশি। খাওয়ার অনুপযোগী এসব গম কেন আমদানি করা হয়েছে তা তদন্ত করে বের করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার পর খাদ্য সচিব সব জেলা প্রশাসককে (ডিসি) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে জেলার খাদ্যগুদাম থেকে গমের নমুনা সংগ্রহ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেন। অন্যদিকে গম আমদানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। খাদ্য অধিদফতরের গম আমদানিকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) সারওয়ার খানকে ওএসডি করা হয়। এর আগে গত ২২ এপ্রিল গম আমদানি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় খাদ্য অধিদফতর থেকে তাঁকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বহির্নোঙরে থাকার সময় সিএমএস, খাদ্য আমদানিকারকের ও খাদ্য অধিদফতরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি জাহাজ থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করে। গম দেখেই তাঁরা বুঝতে পারেন এ গমের আপেক্ষিক ওজন বা পুরুত্ব কম হবে। চট্টগ্রামের গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বহির্নোঙরে পরিদর্শনে যাওয়া সদস্যদের সব অনুমানই সত্য হয়। গমের আপেক্ষিক ওজন হওয়ার কথা ৭৫ কেজি পার হেক্টোলিটার। অর্থাৎ ১০০ লিটার সিলিন্ডারে গম ভর্তি করা হলে সেই গমের ওজন হবে ৭৫ কেজি। তবে ৭৫ কেজি ওজনের নিচে হলেও আমদানি করা গম গ্রহণ করা হয় রফতানিকারকের ক্ষতিপূরণ দেয়া সাপেক্ষে। তবে ওজন ৭২ কেজির নিচে হলে তা আর গ্রহণ করা হয় না। তবে আমদানি করা গমের প্রোটিন ঠিক ছিল। প্রোটিন ঠিক থাকলেও গম কালো হওয়ার কারণে তা কেউ গ্রহণ করবে না। এছাড়া গম থেকে আটার পরিমাণও কম হবে। এই গমের মান খারাপ জানার পরও খাদ্য অধিদফতর কেন গম খালাসের ঝুঁকিতে গেল জানতে চাইলে অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, কোন উপায় ছিল না। আমদানি করা এসব গম দিয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচী পরিচালনা করা হয়। সরকার সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের মধ্যে রেশন হিসেবে যে আটা সরবরাহ করে তা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা গম থেকে প্রস্তুত করা। এসব গম দিয়ে টিআর-কাবিখার প্রকল্পও চালানো হয়। এসব কর্মসূচী পরিচালনার জন্য মাসে এক লাখ টন গম প্রয়োজন হয়। গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের গমের মজুদ তলানিতে নেমে যায়। এ কারণে নীতিনির্ধারকরা বাধ্য হয়ে গম খালাসের পক্ষে অবস্থান নেন। একজন মিল মালিক বলেন, ১০০ টন গম থেকে সাধারণত ৭৫ টন আটা হয়। কিন্তু ব্রাজিল থেকে আনা ওই গম থেকে আটা হচ্ছে ৭০ টন। তাহলে বাকি পাঁচ টন আটা কোথায় পাব? এই গমে ভূষির পরিমাণ অনেক বেশি হচ্ছে। আমদানি-প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তা বলেন, পুরো বিষয়টি ঘটেছে অদক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য। কারণ ইউক্রেন থেকে সরকারীভাবে গম আনার কথা ছিল। কিন্তু বিষয়টি জটিল করে ফেলে সংশ্লিষ্টরা। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি সিন্ডিকেটের কারণে। সময়ক্ষেপণ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যখন ইউক্রেন থেকে সরকারীভাবে গম না পাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হলো, তখন আন্তর্জাতিক টেন্ডারে যাওয়া হয়। ৪০০ কোটি টাকা দামের দুই লাখ টন গম আমদানির কার্যাদেশ পায় ইমপেক্স ইন্টারন্যাশনাল এবং ওলাম ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ইমপেক্স দেড় লাখ এবং ওলাম ইন্টারন্যাশনাল পায় ৫০ হাজার টন গম সরবরাহের দায়িত্ব পায়। ইমপেক্স ইন্টারন্যাশনাল নেদারল্যান্ডসের একটি কোম্পানির উপমহাদেশীয় এজেন্ট। খাদ্য অধিদফতরের গম আমদানি-প্রক্রিয়ায় ইমপেক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গম সংগ্রহের জন্য গত নবেম্বরে প্রথম দফায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়। কার্যাদেশ পাওয়া একটি কোম্পানি কিছু গম ইউক্রেন থেকে সংগ্রহ করে। কিন্তু ইউক্রেন থেকে গম বোঝাই করে জাহাজ যখন তুরস্কে পৌঁছে তখন আইনী জটিলতায় পড়ে যায়। জাহাজটিকে আটক করে তুরস্ক সরকার। অগত্যা ব্রাজিলের দিকে হাত বাড়ায় ওই কোম্পানি। ব্রাজিলে গত মৌসুমে অতিবৃষ্টি হওয়ায় গম কালো হয়ে যায়। ব্রাজিল থেকে যে ধরনের গম এসেছে তা বাংলাদেশে আগে কখনও আসেনি।
×