ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর ২২৯ স্পটে মাদক সেবন করে ;###;সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী চক্র পর্দার আড়ালে থেকে এদের ব্যবহার করে

অপরাধ চক্রের খপ্পরে পড়ে ১৪ লাখ পথশিশু মাদকাসক্ত হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২০ জুন ২০১৫

অপরাধ চক্রের খপ্পরে পড়ে ১৪ লাখ পথশিশু মাদকাসক্ত হচ্ছে

শর্মী চক্রবর্তী ॥ অপরাধী হয়ে কেউ জন্ম নেয় না। জন্মের পর পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে মানবসন্তান অপরাধী হয়ে উঠে। ভালবাসাহীনতা, বিরূপ পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক অনাচার, শিশুদের প্রতি সহিংস আচরণ, অমানবিকতা প্রভৃতির শিশুর কোমল মন নানা কারণে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে আর এ সব কারণে শিশু বিষণœœতা ও হীনম্মন্যতায় ভোগে। তার কোমল মনে হতাশা আর ক্ষোভ থেকে জন্ম নেয় প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের স্পৃহা, যার পরিণতিতে শিশু জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে। সোনালী শৈশবে সে হয়ে উঠে অপরাধ জগতের বাসিন্দা। অনেক সচ্ছল পরিবারের বাবা-মা ভাবেন, অভাবী বা দরিদ্র পরিবারের সন্তানই কেবল অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, চাহিদা অনুযায়ী না পাওয়াসহ নানা কারণে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর পরিবারের শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই অপরাধী কর্মে লিপ্ত হয়ে যায়। তবে উচ্চবিত্তের সন্তানরাও অন্যায় অপরাধে জড়িয়ে যাবে নাÑ এমনটা ভাবাও ভুল। রাজধানীসহ সারাদেশে এমন লাখ লাখ শিশু রয়েছে পথেই যাদের জন্ম ও বসবাস। পথে পথে বেড়ে ওঠা এমন শিশুদের ‘টোকাই’, ‘পথকলি’, ‘ছিন্নমূল’ বা ‘পথশিশু’ বলা হয়ে থাকে। পথে পথে বেড়ে ওঠা এসব কোমলমতি শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে। দিনে দিনে বেড়ে চলছে এদের সংখ্যা। অপরাধ কী বোঝার আগেই তারা ভয়াবহ অপরাধী হয়ে বেড়ে উঠছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অবহেলার সুযোগ নিয়ে এসব শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দিকে ঠেলে দিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। পথশিশুদের একটি বড় অংশ শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ভাড়ায় কাউকে খুন করা, নাশকতামূলক কাজ করা, ছিনতাই, মাদক বিক্রি, চুরির মতো অপরাধের সঙ্গে অবলীলায় জড়িয়ে যাচ্ছে তারা। বিভিন্ন ধরনের মাদক সেবন থেকেই তারা জড়িত হয়ে পড়ছে নানা অপরাধের সঙ্গে। পথশিশুরা মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়া ছাড়াও তারা নিজেরাই ধীরে ধীরে মাদকের ছোবলে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক-মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সারাদেশে প্রায় ১৪ লাখ পথশিশু কোন না কোন মাদকে আসক্ত। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ সব ধরনের বাসস্ট্যান্ড, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিভিন্ন পার্কসহ রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের হরহামেশাই দেখা যায়। তবে ঢাকার বাইরেও এরা সংখ্যায় কম নয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট (বিআইডিএস) ও ইউনিসেফের ২০০৫ সালের গবেষণা অনুযায়ী দেশে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে রয়েছে ৭ লাখ পথশিশু। চলতি বছর শেষে দেশে এর সংখ্যা দাঁড়াবে ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৪ জনে। আর ২০২৪ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০ জনে। অন্য একটি হিসাব মতে, বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এখন প্রায় ৭৯ লাখ। আর এ শিশুদের প্রায় ৪৫ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত। এসব শিশু শ্রমিকের মধ্যে ৬৪ লাখ গ্রামাঞ্চলে এবং বাকি ১৫ লাখ শহরে বিভিন্ন পেশায় কাজ করে। পিতা-মাতা, আত্মীয় কিংবা স্বজনহারা শিশুরা জীবন-সংগ্রামে নামে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই কোন না কোনভাবে মাদক সেবন করে। এর মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট এবং ৮ শতাংশ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে থাকে। ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে, যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ঢাকা বিভাগে মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়েশিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন জানায়, মাদকাসক্ত ৮০ শতাংশ পথশিশু মাত্র সাত বছরের মধ্যে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণা জরিপের মাধ্যমে জানা গেছে, মাদকাসক্ত শিশুদের ড্রাগ গ্রহণ ও বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ৪৪ শতাংশ পথশিশু, পিকেটিংয়ে জড়িত ৩৫ শতাংশ, ছিনতাইয়ে ১২ শতাংশ, মানবপাচার সহায়তা কাজে ১১ শতাংশ, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের সহায়তাকারী হিসেবে ৫ শতাংশ ও অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ অপরাধে জড়িত ২১ শতাংশ। এ ছাড়া বোমাবাজিসহ অন্যান্য সহিংস কর্মকা-ে জড়িত ১৬ শতাংশ পথশিশু। একাধিক গবেষণায় জানা যায়, বড় অপরাধী বা সন্ত্রাসী চক্র পর্দার আড়ালে থেকে শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে। রাস্তায় বেড়ে ওঠা এবং বস্তিতে বসবাস করা শিশুদের মাদকপাচার, চুরি, ছিনতাই, পিকেটিং, রাজনৈতিক মিছিল, জোর করে ভিক্ষাবৃত্তি, অস্ত্র বহনসহ নানা কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হয় বলে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়। শিশু-কিশোররা ধরা পড়লেও সহজেই ছাড়া পেয়ে যায় বলে অপরাধমূলক কর্মকা-ে তাদের ব্যবহার করা হয় নিশ্চিন্তে। পথশিশুদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় এসব অপরাধ কর্মকা-ে এসব কাজে জড়িয়ে একপর্যায়ে এসব শিশু-কিশোর একসময় সমাজের শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. খন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, পথশিশুদের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার অভাব এবং দারিদ্র্য মূল ভূমিকা পালন করে। এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাবও সমানভাবে দায়ী। আমাদের দেশে এই পথশিশুরা নানা রকম অপরাধের সঙ্গে জড়িত। দিনে দিনে আরও অধিকসংখ্যক শিশু অপরাধ জগতে পা বাড়াচ্ছে। শহরে অপরাধের ধরনের জন্য পথশিশুরা খুবই আলোচিত। পথে-ঘাটে চুরি-ছিনতাই তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। পথশিশুদের দ্বারা ডাকাতি, অপহরণ, মাদকপাচার ইত্যাদি অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। কিছুদিন আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় ককটেল কিংবা পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের কাজেও পথশিশুদের ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। হাল আমলের চলন্ত বাস থেকে মোবাইল, ভ্যানিটি ব্যাগ, গহনা-অলঙ্কার ইত্যাদি ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়ার কাজেও এদের দেখা গেছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এদের পেছনে বিরাট কোন সংঘবদ্ধ চক্রের অস্তিত্ব থাকে। ফলে তারা এ ধরনের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়তে সাহস পায়। শুধু পথশিশুদের দোষ দিলে ভুল হবে। অবস্থাসম্পন্ন ভদ্র ঘরের সন্তানদেরও এ ধরনের অসৎ কাজে লিপ্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তাদের অপরাধ করার কারণটা একটু ভিন্ন। কেউ কেউ নিতান্তই আগ্রহ কিংবা কৌতূহল বশে অপরাধের সঙ্গে জড়িত হলেও এদের মোটা অংশ মাদকের টাকা যোগাড় করতেই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়। আর এ মাদকের সঙ্গে যে রিলেশনশিপ, এটা পথশিশু ও বড়লোকের ছেলেমেয়েদের সিংহভাগকেই অপরাধের দিকে ধাবিত করে। প্রতিদিন রাজধানীতে অসংখ্য ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে বেশি ছিনতাই হচ্ছে মোবাইল। চলতি পথে সাধারণ মানুষের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় একটি চক্র। অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব ছিনতাইয়ের কাজে যারা জড়িত তাদের বেশির ভাগের বয়স ১০ থেকে ১৬ বছর। অনেক সময় চক্রটি সংঘবদ্ধ হয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে সাধারণ মানুষের মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারিয়া সাফা রিক্সাযোগে কলাবাগান থেকে শাহবাগ যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিল স্কুলপড়ুয়া ছোট ভাই। তাদের রিক্সা যখন সায়েন্সল্যাব ওভারব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছায়, ঠিক তখনি ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন তারা। সাফা জানান, রিক্সায় করে শাহবাগ যাওয়ার সময় একটা জরুরী কল আসায় মোবাইলটা হাতেই ছিল। এমন সময় রিক্সার পেছন থেকে ১৪/১৫ বছর বয়সী এক ছেলে কিছু বোঝার আগেই মোবাইলটা রিক্সার পেছন থেকে টান দিয়ে নিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে পালিয়ে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমি অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করলেও আশপাশের কেউ এগিয়ে আসেননি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি, টহল এড়িয়ে এসব কিশোর ছিনতাইকারী নির্বিঘেœ এসব অপরাধকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। রিক্সা, বাসের জানালা, সিএনজি কিংবা প্রাইভেট গাড়ির জানালা দিয়ে যেসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে এগুলোর বেশিরভাগই ঘটাচ্ছে পথশিশু কিংবা টোকাইরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, সংসারের ঘানি টানতে কিংবা মাদকের টাকা যোগাড় করতে রোজগারের সহজ পথ হিসেবে টোকাইরা ছিনতাইকে সহজ পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। আবার অভিভাবকহীন পথশিশুরা অনেক সময় ছিনতাই সিন্ডিকেট তৈরি করে সংঘবদ্ধভাবে ছিনতাই করছেন। বর্তমানে মিছিল-মিটিং, বিভিন্ন রাজনৈতিক শোডাউনে কিংবা হরতালের পিকেটিংয়ে অহরহ পথশিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচী পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, লোক সমাগম বাড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে পথশিশুদের। টাকার বিনিময়ে কিংবা একবেলা পেটপুরে খাওয়ার বিনিময়ে এসব দলীয় কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করছে শিশুরা। শোডাউন ছাড়াও পিকেটিং, ভাংচুর কিংবা ককটেল নিক্ষেপের মতো বিপজ্জনক কাজেও ব্যবহার হচ্ছে টোকাইরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, মিছিলে অংশ নিতে একজন টোকাইকে একবেলা খাওয়াসহ ৫০ থেকে ১০০ টাকা দেয়া হয়। আবার অনেক সময় ঘণ্টাচুক্তিতেও শিশুদের মাঠে নামানো হয়। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত প্রধান নেতা তার অধীনের নেতাকে লোকসমাগম বাড়াতে কয়েকটা ট্রাক বা বাস ভরিয়ে লোক আনার নির্দেশ দেন। পরে অধীনের ওই নেতা পথশিশুর সিন্ডিকেটের প্রধানের সঙ্গে চুক্তি করেন। জানা যায়, বাস জ্বালানো বা ভাংচুর, ককটেল নিক্ষেপ এবং পেট্রোলবোমা নিক্ষেপেও ভাড়া খাটছে পথশিশুরা। তবে এ ধরনের কাজের জন্য তারা একটু বেশি টাকা নেয়। বাস জ্বালানো বা ভাংচুরের জন্য টোকাইরা নেন ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। ককটেল নিক্ষেপের ক্ষেত্রে পথশিশুরা পায় প্রতিটির জন্য ৫০০ টাকা। তবে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের জন্য পায় কমপক্ষে দুই হাজার টাকা। জালভোট দেয়ার কাজেও ব্যবহার হয় পথশিশুরা। বিশিষ্টজনরা মনে করেন, হরতালের পিকেটিং কিংবা রাজনৈতিক কর্মকা-ে শিশুদের ব্যবহার করা রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা ছাড়া কিছু নয়। পিকেটিংয়ের নামে অন্যের চলাচলের অধিকার লঙ্ঘন অন্যায় ও বেআইনী। এই বেআইনী কাজে পথশিশুদের নামানো অবশ্যই নিন্দনীয়। রাস্তাঘাটে কিংবা পার্কে আজকাল অহরহ শিশুদের ভিক্ষা করতে দেখা যায়। দেখা যায় রাজধানীর কাওরানবাজারে গভীর রাতে ফুল বিক্রি করতে একদল শিশুকে। এসব শিশু সারাদিনের কাজ শেষে ঘরমুখো মানুষের কাছে ফুল বিক্রি করে। ফুল কেউ না নিলেও অনেক সময় টাকা দাবি করে তারা। বিষয়টি অনেকটা ভিক্ষার মতোই। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের জোর করে এই কাজে নামানো হয়েছে। দিনশেষে নির্ধারিত পরিমাণে টাকা নিয়ে না গেলে তাদের মারধর করা হয়। কাওরান বাজারের পথশিশু ঝুমাকে পথের ধারেই কাঁদতে দেখা যায়। কান্নার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঝুমা বলে, ‘হারাদিনে ৪০ টেহা কামাইছি দেইখা মায়ে আমারে খুব মারছে।’ নিজের লম্বা চুল দেখিয়ে ঝুমা বলে, ‘মায়ে কইছে কাইলকা ১০০ টেহা কামাবার না পারলে আমার চুল কাইটা দিব।’ ঝুমার বয়স আর কতই বা হবে, বেশি হলে ৭ বছর। এ বয়সে তার স্কুলে যাওয়ার কথা, কিন্তু তাকে জোর করে ভিক্ষাবৃত্তিতে পাঠানো হচ্ছে। পা ভাঙ্গা, হাতা ভাঙ্গা অনেক সময় বীভৎস ক্ষত নিয়ে শুয়ে ভিক্ষা করছে অনেকে। এদের পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এদের জোর করে হাত-পা ভেঙ্গে দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামানো হয়েছে। এ ধরনের ক্ষত নিয়ে যেসব শিশু ভিক্ষা করছে তাদের আশপাশেই থাকেন তাদের অভিভাবক; যারা দিনের শুরুতে নির্দিষ্ট স্থানে তাদের বসিয়ে দিয়ে যায় আবার সময় হলে বাসায় নিয়ে যায়। ঢাকার বিভিন্ন বস্তির অলিগলিতে টোকাইয়ের কাজ করে এমন শিশুদের মাদক সেবনের দৃশ্য দেখলে যে কেউ শিউরে উঠবেন। সারাদিন কাগজ বা অন্যান্য ভাঙ্গারির মালামাল কুড়িয়ে তা সংশ্লিষ্ট দোকানে বিক্রি করে যে টাকা আয় করে, তার প্রায় পুরোটাই তারা ব্যয় করে মাদক সেবনে। অধিক মুনাফালোভী একশ্রেণীর ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী স্কুল পড়ুয়া শিশুদের টোকাই বানিয়ে ফেলছে কৌশলে। টাকার লোভ দেখিয়ে ওদের কাজে পাঠানো হচ্ছে। আবার একশ্রেণীর মাদক ব্যবসায়ী আছেন, যারা পথশিশুদের দিয়েই মাদক সরবরাহ, ব্যবসা কিংবা পাচার করছে। রাজধানীতে এসব চিত্র অহরহ চোখে পড়ে। ফলে মাদক এসব শিশুর হাতের মোয়ায় রূপ নিয়েছে। কিছুদিন মাদক ব্যবসা কিংবা সরবরাহের কাজ করতে করতে এসব পথশিশু কয়েক দিনের মধ্যেই মাদক গ্রহণ করতে শুরু করেÑ কথাগুলো জানায়, কাওরানবাজার রেলগেট এলাকার টোকাই আরমান। আর এভাবেই তারা আসক্ত হয়ে পড়ে মহামারী মাদকে। একসময় জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধের সঙ্গে। যাদের অধিকাংশের বয়স ১১ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে।
×