ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুখসানা কাজল

অভিমত ॥ বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১৭ জুন ২০১৫

অভিমত ॥ বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য

প্রেসক্লাবের মানববন্ধন থেকে ঘরে ফিরছিলেন ফারজানারা। ওরা ঢাকার একটি বেসরকারী মহিলা কলেজে সদ্য যোগ দেয়া শিক্ষক। দোয়েল চত্বরের কাছে এসে যে যার পথে আলাদা হয়ে যান। আলাদা হওয়ার আগে ওদের তিনজনের চেহারায় ভাসছিল হতাশার সঙ্গে তীব্র অপমান আর বেদনার রং। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালের অধীনে বিভিন্ন কলেজ থেকে ভাল নম্বর পেয়ে পাস করে এরা এসেছিলেন শিক্ষকতা পেশায়। তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে শিক্ষকদের মানুষ গড়ার কারিগরের সম্মান দেয়ার উদাত্ত আহ্বানে। আজ এই শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ, বিষণœ। সামান্য ডাল-ভাত আর রুটি আলু ভাজি খেয়ে দেশের আনাচে-কানাচে শিক্ষার আলো জ্বেলে চলেছেন যে বেসরকারী শিক্ষক সমাজ, আজ পে-স্কেলের দাবিতে এই জ্যৈষ্ঠের দুপুরে মানববন্ধনে দাঁড়াতে হলো। প্রতিবার তাই হয়। সরকার এই নন এলিট সন্তানদের জন্যে বাজেট বরাদ্দ করে খুদকুঁড়োর মতো। সরকারের একাংশ কেন যেন বেসরকারী শিক্ষকদের বেলায় কৃপণ। তারা কি একবারও হিসাব করে দেখেছেন সাকুল্যে বেসরকারী শিক্ষকরা কত বেতন পান? কেবল শিক্ষকতা ছাড়া সরকারী শিক্ষাবিষয়ক কোন কাজে কখনও কি বেসরকারী শিক্ষকদের কোন সুযোগ দেয়া হয়? বেসরকারী কোন শিক্ষক কি কখনও বিদেশে যেতে পারছেন কোন ট্রেনিং অথবা শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে? সুযোগ পাচ্ছেন কি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজের প্রতিনিধিত্ব করতে? অথচ সৃজনশীল শিক্ষা পাঠ্যক্রম চালু করতে হবে, ডাকো বেসরকারী শিক্ষকদের। ভোটার লিস্ট করতে হবে, দাও দায়িত্ব বেসরকারী শিক্ষকদের। নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে হবে, কাজ করবে বেসরকারী শিক্ষকরা। এগুলো তারা করেন সরকারী শিক্ষকদের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব এবং সমান দায়িত্ব ও যোগ্যতার সঙ্গে। সামান্য কিছু অবসর ভাতা পান এই শিক্ষকরা। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে নানা বৈষম্যের শিকার হয়ে শেষ বয়সে ওই এককালীন সামান্য কিছু টাকা পেতে শিক্ষকদের ছুটতে হয়। শিক্ষকদের কিসের সম্মান, কিসের মর্যাদা? জাতীয় পর্যায়ে ঘোষণা দিয়েও আজ পর্যন্ত আলাদা বেতন স্কেল কি হয়েছে? সবাই জানুক বেসরকারী শিক্ষকরা কি কি পান, কত পান বাড়িভাড়া বাবদ আর কত টাকাইবা পান মেডিক্যাল ভাতা। এই সামান্য টাকায় কি চিকিৎসা খরচ মেটাতে পারেন? পারেন আম, কাঁঠাল, লিচু খেতে বা সন্তানদের মুখে তুলে দিতে? একমাত্র মাসিক বেতন ছাড়া আর কোন উপায় নেই অর্থ-উপার্জনের। কিছু শিক্ষক যদিও টিউশনি, কোচিংয়ের মাধ্যমে অভাব মোচান। তাতে কি নিরাপত্তা পান শিক্ষক সমাজ? বেসরকারী এই শিক্ষকরা কি ক্লাস নিতে এসে কখনও কোন সুখবর পান যে, সরকার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের পে-স্কেল দিয়ে দিয়েছে? বরং বারবার রোদ্দুরে, বৃষ্টিতে, অতীত সরকারের সময় পুলিশের মার খেয়ে শিক্ষকদের রাস্তায়, প্রেসক্লাবে, শহীদ মিনারে তাদেরই হাতে গড়া সন্তানদের কাছ থেকে খোরাকি আদায় করতে যেতে হয় আন্দোলনে। তাহলে কেন ড. ফরাসউদ্দিন কমিটির বৈষম্যমূলক বিবেচনা? দেশের কয়েকটি মাত্র বেসরকারী স্কুল-কলেজ আছে, যারা তেলে-জলে শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছে। কিন্তু বাদবাকি বেশিরভাগ স্কুল-কলেজের কি অবস্থা তা কি এই কমিটি জানে না? তারা কি এমপিওভুক্ত কলেজগুলোর মাসিক বেতন দেখেনি? বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা রাস্তায় নেমেছেন বাধ্য হয়ে। তারা বুঝেছেন, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার পুরনো ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এমনিতেই লাগাতার হরতাল, অবরোধ, পেট্রোলবোমা, জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের নিদারুণ ক্ষতি হয়েছে। এরপর দেশের পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী পেটের দায়ে, সম্মানের দায়ে, প্রতিজ্ঞাভঙ্গের দায়ে, বৈষম্যের প্রতিবাদে যদি আন্দোলন গড়ে তোলেন, ক্ষতি কিন্তু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থারই হবে। এই পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর আর কি হবে? কিন্তু দেশের প্রতিটি শহীদ মিনার আঁকড়ে ধরে আবার বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা উঠে দাঁড়াবেন। তারা যে শিক্ষক। তাদের রক্ত বেসরকারী হতে পারে, কিন্তু তাদের আদর্শ, লক্ষ্য তো বেঠিক নয়। সমস্ত দেশের বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা আজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। সরকারের কাছে তারা বিনীত আহ্বান জানাচ্ছেন, বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য জাতীয় বেতন কমিশন কর্তৃক আরোপিত শর্ত রহিত করে সরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুরূপ একই দিনে জাতীয় স্কেল বাস্তবায়ন, ৪৫% বাড়িভাড়া, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, মেডিক্যাল ভাতা ও পেনশন প্রদান এবং কলেজ পর্যায়ে অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করে সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়ার দাবিসহ শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনয়নে ২১ দফা দাবি বাস্তবায়ন করার জন্য। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ পে-স্কেলে অন্তর্ভুক্তিসহ ২১ দফা বাস্তবায়ন না করা হলে শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অতীতের মতো তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হবেন, যা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীর জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। লেখক : বেসরকারী কলেজ শিক্ষিকা
×