ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ ভাষাসৈনিক গাজীউল হক

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৭ জুন ২০১৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ ভাষাসৈনিক গাজীউল হক

ভাষাসৈনিক এ্যাডভোকেট আ ন ম গাজীউল হক। ভাষাসৈনিক হিসেবে তো অবশ্যই; একজন নিবেদিত মানুষ হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন নিষ্ঠাবান যোদ্ধা। ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের যেমন ছিলেন সক্রিয় একজন কর্মী, তেমনি দেশ ও মানুষের প্রতি পরম মমতায় তিনি দিয়ে গেছেন অকাতরে, দেশপ্রেমের অমোঘ স্বাক্ষর রেখে গেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। আর শুধু ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনই নয়, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেনসহ বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংস্পর্শেও এসেছিলেন সহযোদ্ধা হয়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সরকার যে ১৪৪ ধারা জারি করেছিলেন আর সেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের যে কয়জন ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম একজন গাজীউল হক। গাজীউল হক যে ভাষাসৈনিক ছিলেন সে কথাটিই কেবল প্রচারিত তথ্য, কিন্তু ভাষাসৈনিক হিসাবে তাঁর ভূমিকাটি বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনে ঠিক কী ছিল তা তাঁর সমসাময়িক রাজনৈতিক কর্মীদের কারও কারও জানা থাকলেও উত্তর প্রজন্মের এমনকি সচেতন মানুষদেরও অনেকেরই তেমন জানা নেই। এর জন্য আমাদের সমাজের সামগ্রিক ইতিহাস-চেতনার অভাবই দায়ী। তাঁর সাহসিকতার পরিচয় কেবল ভাষা আন্দোলনের সময়ই দেখা যায়নি। পরবর্তী সকল অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় সংগ্রামে গাজীউল হক অংশ নিয়েছেন। ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪-র সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠক হিসাবে ও পরে জাতীয় পর্যায়ের লেখক এবং সংগঠকের ভূমিকায় তাঁকে পাওয়া গেছে। তাঁকে পাওয়া গেছে ১৯৮০-র দশকজুড়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলন ছিল গাজীউল হকের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। সেটা ছিল এমন এক সময় যখন নেতৃত্বের ভূমিকা পালনের ক্ষেত্র ছিল প্রস্তুত। কিন্তু কে হবেন ঐ যুদ্ধক্ষেত্রের নায়ক? এ প্রশ্নে আমরা যদি ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে ফিরে যাই তাহলে দেখতে পাব যে গাজীউল হকের ভূমিকা সেখানে উজ্জ্বল! সেদিন রাতে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ যে বৈঠকে বসেছিল তাতে গাজীউল হক উপস্থিত না হয়ে অপেক্ষা করছিলেন ফজলুল হক হলে। ঐ বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত হয় তা জেনে ঠিক করবেন তাঁর কর্মপন্থা। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো যে, সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। তাঁদের সিদ্ধান্ত এই কারণে যে, তাহলে গোটা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ওপর জেল-জুলুম নেমে আসবে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের ঐ সভার অধিকাংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতেই (১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ১১, বিপক্ষে ৪) এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ফজলুল হক হলে অবস্থানরত গাজীউল হক রাত সাড়ে বারোটার দিকে এই খবর পান। সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে আওয়ামী মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগ এবং সমস্ত রাজনৈতিক দল ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল। পরিষদের প্রতিনিধি তোয়াহার মতও ছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে। তিনি সরাসরি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ভোট দিতে না পারলেও ভোট দেয়া থেকে বিরত ছিলেন। এখান থেকে শুরু হয় গাজীউল হকের ঐতিহাসিক ভূমিকার সূচনা। এর পর বাহান্নোর ঘটনার অন্যতম নায়কে পরিণত হন তিনি। ভাষাসৈনিক আ ন ম গাজীউল হকের রাজনৈতিক-শিক্ষা-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিবেদিত কর্মকা-ের মধ্যে অনেক অজানা তথ্য আজও সবার অজান্তে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৬৯ এবং ৭১-এ স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত থেকে সাংগঠনিকভাবে ভিত্তি তৈরি করার অগ্রসৈনিক। ১৯৭৬ সালের একুশে জুন, সামরিক আদালতে বিচার হচ্ছে কর্নেল তাহেরসহ অনেক বিপ্লবীর, কর্নেল তাহেরের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন আমাদের ভাষাসৈনিক এ্যাডভোকেট গাজীউল হক। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণআদালত। সে আদালতে আজকের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়েছিল, আর সেই গণআদালতের রায়টি পড়ে শোনান ভাষাসৈনিক গাজীউল হক। দেশের প্রত্যেকটি আন্দোলনে সবার আগে থাকতেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আজীবন লড়াকু এই মানুষটি। ২০০৯ সালের ১৭ জুন আমরা তাঁকে হারাই। তিনি চলে গেলেও রেখে গেছেন তাঁর কাজ। রেখে গেছেন গান, কবিতার সঙ্গে সঙ্গে একটি অনন্য উপহার; আর তা হলো আদর্শিক সংগ্রামের উদাহরণ। আমরা রাজনীতিসচেতন নতুন প্রজন্ম এগিয়ে যাব ভাষাসৈনিক গাজীউল হকসহ সকল ভাষাসৈনিক-মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় বীরকে বুকে লালন করে। যাঁরা তাঁদের জীবনের কথা নয়; ভেবেছেন আমাদের কথা; দেশ ও মানুষের কথা। আমাদেরকেও ভাবতে হবে তাঁদের কথা; স্মরণ করতে হবে তাঁদের রাজনৈতিক-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অবদানের কথা। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। [email protected]
×