ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভূমিদস্যুদের থাবায় গাজীপুরের কৃষি জমি ॥ নীরব আগ্রাসন

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৪ জুন ২০১৫

ভূমিদস্যুদের থাবায় গাজীপুরের কৃষি জমি ॥ নীরব আগ্রাসন

রাজন ভট্টাচার্য ॥ শিল্পায়নের নামে ভূমিদস্যুদের থাবায় ধ্বংস হচ্ছে গাজীপুরের কৃষি জমি। বলতে গেলে এ জেলার নীরব ভূমি আগ্রাসন চলছে। নিয়ম নীতির উপেক্ষা না করেই রুপান্তর হচ্ছে মাটির। ভূমিদস্যুদের কাছে অসহায় এলাকাবাসী। জোরপূর্বক এমনকি হামলা-মামলা দিয়ে কেড়ে নেয়া হচ্ছে জমি-জমা। প্রশাসনও প্রভাবশালীদের পক্ষে। আইনের আশ্রয় নিয়েও নিজের সহায় সম্বলটুকু রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দা। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, দখলের থাবা থেকে বাদ যাচ্ছে না কবরস্থান, মসজিদ থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমিও। জেলায় সবচেয়ে বেশি ভূমি দখলের প্রতিযোগিতা চলছে শ্রীপুর উপজেলায়। এখানে কয়েকটি গ্রামের মানুষের মুখে কোন হাসি নেই। দখলবাজদের অত্যাচারে বছরের পর বছর যেন তারা হাসতেই ভুলে গেছেন। অসহায় মানুষদের পাশে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন দাঁড়ালেও প্রতিকার মিলছে না। এ উপজেলায় প্রায় ৫০ হাজার একর কৃষি জমির চিত্র বদলে গেছে অল্প সময়েই। জেলায় ১২ বছরে কৃষি জমি কমেছে ১০ হাজার হেক্টরের বেশি। এই যখন বাস্তবতা; তখন স্থানীয় প্রশাসন বলছে, জমি দখল মহামারি আকার ধারণ করেনি। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জৈনাবাজার থেকে গাজীপুর ইউনিয়নের শ্রীপুর উপজেলার শৈলাট গ্রামে যাওয়ার পথে প্রায় ১০ কিলোমিটার পাকা রাস্তার উভয় পাশের কৃষি জমির স্মৃতিচিহ্ন দিন দিন মুছে যাচ্ছে। এখানকার প্রায় সব কৃষি জমিই দ্রুত অকৃষি খাতে যাচ্ছে। জমিতে নির্মাণ হচ্ছে শিল্প, বাণিজ্যিকসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। কৃষি জমিকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের বিধিনিষেধেরও তোয়াক্কা করছেন না কেউ। দখলের কারণে শ্রীপুরের শৈলাট, গাজীপুর ও নয়াপাড়া এ তিন গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক পরিবার এখন দিশেহারা। জমি দিতে রাজি না হওয়ায় ৩শ’ পরিবারের বিরুদ্ধে একুশটির বেশি মামলা দিয়েছে দখলকারীরা। প্রতিবাদ করলে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হয়। গাজীপুর জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বর্তমানে এখানে সাড়ে পাঁচ হাজারেরও অধিক শিল্প-কারখানা রয়েছে। এর অধিকাংশই তৈরি পোশাক কারখানা। কিছু ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, কেমিক্যাল, চামড়া কারখানা ছাড়া জেলার শিল্প বর্জ্য দূষণের মূল উৎস ডাইং ও অন্য পোশাক কারখানাগুলো। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কেবল দূষণ ও নির্বিচারে কৃষি জমিতে শিল্প ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ফলে ১২ বছরের ব্যবধানে গাজীপুরের কৃষি জমি কমেছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর। মাওনা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তথ্য ॥ মাওনা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোঃ আক্কাস আলী জানান, মাওনা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের আওতায় শৈলাট, গাজীপুর ও নয়াপাড়া গ্রামের মোট জমির পরিমাণ ৫৩ হাজার ১০৭ একর। এরমধ্যে কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় ২৯ হাজার ৯০৭ একর। বাড়ি/ আবাসভূমির পরিমাণ প্রায় ৫শ’ একর এবং চালা/উঁচু জমির পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার ৭শ’ একর। এসব জমির মধ্যে কৃষি ও চালা উভয়ই শ্রেণীর জমিতে শিল্প কারখানা স্থাপিত হচ্ছে। কৃষি জমি রূপান্তরের চিত্র ॥ গাজীপুর গ্রামে ধানের জমিতে সিরামিক লিমিটেডের নামে চলছে ভূমি আগ্রাসন। ২নং গাজীপুর ইউনিয়নের ধনুয়া মোজার আরএস খতিয়ান অনুযায়ী-১২১, ৩৪১, ২০১, ৬১৩, ২৯৪ দাগের কৃষি জমির এখন স্মৃতি চিহ্ন বলে কিছু নেই। এছাড়া আর এস দাগ নং-৩১২, ৩২০, ৫৫৪, ৫৮০, ৫৮৪, ৫৮৫, ৫৮৬ এর প্রায় ২০০ বিঘা কৃষি জমিতে শিল্পায়ন হয়েছে। দুই নং গাজীপুর ইউনিয়নে নয়াপাড়া গাজীপুর মৌজায় প্রায় দেড় শ’ বিঘা কৃষি জমিতে ঝুলছে আমান গ্রুপের সাইনবোর্ড। এ এলাকায় রিচমন্ড অটো ব্রিকস লিমিটেডের নামে কৃষি জমি ভরাট চলছে দীর্ঘ দিন। ২নং গাজীপুর ইউনিয়নের গাজীপুর মৌজায় টিমেক্স জুট মিলস লিমিটেডের নামে প্রায় ১৫ বিঘা কৃষি জমি ভরাটের কাজ চলছে। একটি ওষুধ কোম্পানি একই ইউনিয়নে ৩শ’ একরের বেশি কৃষি জমিতে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। ধনুয়া মৌজায় কৃষি জমিকে টানানো হয়েছে শত শত সাইনবোর্ড। সম্প্রতি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বেলা-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শৈলাট, গাজীপুর ও নয়াপাড়া এলাকায় ভূমি আগ্রাসন শুরু হয় মূলত ২০০৯-’১০ সাল থেকে। এ তিন মৌজায় মোট জমির পরিমাণ ৫২ হাজার ৬০৭ একর। এরমধ্যে কৃষি জমির পরিমাণ ২৯ হাজার একর। ২২ হাজার একর জমি ব্যবহার হচ্ছে বসতভিটায়। সংস্থাটির প্রতিবেদন বলা হয়, এই চারটি প্রতিষ্ঠান এলাকার ৮শ’ বিঘা কৃষি জমি দখল করে অনুমোদন ছাড়াই শিল্পপার্ক স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এছাড়া আরও ১৮৫ একর জমি জাল দলিল ও জাল নামজারি জমাভাগ করে নেয়ার অভিযোগ চার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। স্থানীয় আরও পাঁচ পরিবারের প্রায় ১২ একর জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয়ারও অভিযোগ আছে। এলাকার ১৪৭টি পরিবারের ৩১০ বিঘার বেশি জমি জোড়ালোভাবে দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন। এরমধ্যে কিছু জমি ইতোমধ্যে জমি ভরাট করেছে। যার মধ্যে মসজিদ, খেলার মাঠ, করবস্থান থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও জমি রয়েছে। দুই প্রতিষ্ঠানের নামেই ৩শ’ একর জমি ॥ স্থানীয় ভূমি অফিসের লোকদের হাত করে স্থানীয় বাসিন্দাদের জমির মালিকানা বদল করা হয়েছে। অথচ যারা জমির প্রকৃত মালিক তাঁরা খবরই রাখেন না। বিশেষ কোন প্রয়োজনে জমির খোঁজ নিতে গিয়েই সন্ধান মিলছে নিজের জমি বেহাত হওয়ার। ভুয়া মিউটেশনের মাধ্যমে মালিকানা বদলে বসেছে অন্য কারও নামে। অথচ গাজীপুর জেলায় আইনের নির্ধারিত সিলিং অনুযায়ী একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে ৬০ বিঘার বেশি জমি কেনা যাবে না। নামজারি ও জমাভাগের নথি নং-৩০৫৮/১০-১১ তারিখ ২৯ মে ২০১১ অনুযায়ী শৈলাট মৌজার দুই একর পৌনে চার শতক সাইল জমির মালিকানা পরিবর্তন করা হয়। এছাড়াও নামজারি ও জমাভাগ নথি নং-৩০০৩/১০-১১ ২০১২ সালের ২৪ মের নথিতে দেখা গেছে, শ্রীপুর মৌজার ৫৮ শতক জমি খারিজ করা হয়েছে। ২০১২ সালের ৪ জানুয়ারি নথি নং-১৮০৪/১০-১১ অনুযায়ী শ্রীপুর মৌজার ২০০ একরের বেশি জমি খারিজ করার রেকর্ড পাওয়া গেছে। ভূমি অফিস থেকে সংগৃহীত প্রায় ৭০টি নথিতে বিশাল জমির মালিক হিসেবে রতনের নাম উল্লেখ রয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট রতন জনকণ্ঠের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এক শ্রেণীর দালাল চক্র আমার বিরুদ্ধে জমি দখলের অপপ্রচার চালাচ্ছে। অনুমোদন নিয়ে শিল্পায়নের জন্য কৃষি জমি কেনার দাবি করে তিনি বলেন, হয়রানি করার উদ্দেশ্যে দালালরা আমার বিরুদ্ধে থানায় জিডি অথবা মামলা করছে। এমনকি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সহযোগিতা নিয়ে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে। স্থানীয় কিছু মানুষ অকারণে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে পুলিশ প্রশাসনে চিঠি দিচ্ছে। তিনি বলেন, এলাকায় কেউ জায়গা জমি কিনলে দখলে নেয়া যায় না। নিজের জমি দখলে নিতে দালাল চক্রকে টাকা দিতে হয়। মাসোহারা গুনতে হয় নিয়মিত। তারা এক জমি বার বার মানুষের কাছে বিক্রি করে। গাজীপুর এলাকায় এমন দালাল চক্রের অভাব নেই। তিনি বলেন, যারা আমাদের ওপর দিনের পর দিন অত্যাচার করে তাদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। তাছাড়া এক শ্রেণীর মানুষ ওই এলাকার শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে কৃষি জমি ধ্বংস করা, জমি দখলসহ নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। অনেকেই তা বিশ্বাস করেন। প্রকৃত অর্থে বাস্তবতা কিছুই নেই। স্থানীয় লোকদের হুমকিসহ পুলিশ ও সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমি কাউকে হুমকি দেইনি। নানা অভিযোগ নিয়ে কেউ কেউ প্রশাসনের কাছে আশ্রয় নেয়ার পর তদন্ত শেষে সকল অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। আমার বিরুদ্ধে জিডি করার পর দু’পক্ষকে থানায় ডাকানো হয়। আমি সেখানে হাজির থাকলেও বাদী পক্ষ হাজির হয়নি। জমি নিয়ে গবেষণার চিত্র ॥ বিভিন্ন বেসরকারী ও মানবাধিক সংগঠনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের তিনটি গ্রামে একই ব্যক্তি ও তাঁর সহযোগীরা নিরীহ কৃষিজীবী ও গ্রামবাসীর জমি হাতিয়ে নিচ্ছে। মিথ্যা দলিলপত্র তৈরি করে ইতোমধ্যে ৫০০ একর জমির নামজারি করে নিয়েছে। দখল করে নিয়েছে ৩০ বিঘার বেশি জমি। শিল্পপার্ক স্থাপনের নামে আরও এক হাজার ২০০ একর জমি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে। দখলে বাধা দেয়ায় ভাড়াটে গু-া দিয়ে হামলা, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি এমনকি প্রাণনাশেরও হুমকি দেয়া হচ্ছে। এ জমিগুলোর বেশিরভাগই কৃষি খাতের। রয়েছে বসতভিটা, কবরস্থান, মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমিও। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ শৈলাট এলাকার নিরীহ গ্রামবাসীর প্রায় ৮০০ বিঘা জমি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি নিজস্ব ক্যাম্পাসের জমি ও পুকুর ভরাট করে নিচ্ছে আলী হায়দার রতন। আলাউদ্দিন আলী ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে একজন। স্থানীয় গ্রামবাসী প্রতিবাদ করায় তাদের হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই এলাকার প্রায় এক হাজার ২০০ একর জমি একই ব্যক্তির মালিকানাধীন চারটি কোম্পানি অবৈধ প্রক্রিয়ায় দখলের পাঁয়তারা করছে। গাজীপুর ইউনিয়নের তিন গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, জবান আলী মাস্টারের জমি ভুয়া খতিয়ান তৈরি করে দখলে নেয় শিল্পপতি রতন। খতিয়ান সূত্রে ১১ বিঘা জমির মালিক ডা: আবু সাঈদ। ২০০৯ সালে রতন ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করে জমিটি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। তখন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের হস্তক্ষেপে জমিটি ফিরিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আবারও ভুয়া ওয়ারিশ তৈরি করে জমিটি হাতিয়ে নেয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা যা বলছেন ॥ গাজীপুর ইউনিয়নে মোট জমির পরিমাণ ১১ হাজার ৪২০ একর। শৈলাট গ্রামের বাসিন্দা নূরুল ইসলাম সরকার জানান, একটি বেসরকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সরকার দলীয় লোকজনসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় তিন গ্রামে শিল্পায়নের নামে একের পর এক কৃষি জমি বেদখল হচ্ছে। তিনি জানান, জমি না দেয়ায় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কেনা জমিতে মাটি ফেলায় আশপাশের কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে মামলা ও পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হয়। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হামলা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তিন গ্রামের বাসিন্দাদের ভয় দেখিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। টোটাল কেয়ার ও প্লাটিনাম নামের দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা লুৎফর রহমান অভিযোগ করে বলেন, আলী হায়দার রতন নামের এক শিল্পমালিক ৩৫০ একর কৃষি জমি দখলের চেষ্টা করছে। সাধারণ মানুষের ভূমি রক্ষায় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ দাখিল করার পর আমাকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের কৃষি জমি দখলে সহযোগিতা করারও অভিযোগ করেন তিনি। অব্যাহত হত্যার হুমকির মুখে চলতি বছরের ১৯ জুলাই জয়দেবপুর থানায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করেন তিনি (নম্বর-১৩৭২)। শৈলাট গ্রামের বাসিন্দা আবদুস সালামের দায়ের করা জমি জালিয়াতির মামলায় বলা হয়, শৈলাট মৌজার খতিয়ান ১৩০, আরএস খতিয়ান ২২৯ এর দুই বিঘা জমি তিনি বিক্রি করেননি। স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে আলী হায়দার রতন এই জমি খারিজ করে নিজের নামে করে নেয়। এর প্রেক্ষিতে আবদুস সালাম শ্রীপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর ভুয়া জমি নাম জারির অভিযোগে রতনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ২০০৯ সালে স্থানীয় বাসিন্দা মহব্বত আলী মাস্টার টোটাল কেয়ারের কাছে সাত বিঘা জমি বিক্রি করেন। এরপর ২০১০ সালে একই প্লটের দুই বিঘা জমি জোর করে দখল করে নেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রতন। জমি দখলের প্রতিবাদ করায় মহব্বত আলীর ছেলে মোঃ লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের সাত এপ্রিল শ্রীপুর থানায় চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেন তিনি। বেহাত হলো যাদের জমি ॥ বেসরকারী ও মানবাধিকার বিভিন্ন সংগঠনের জরিপে দেখা গেছেÑ গাজীপুর গ্রামের পুলিশের সাবেক ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মোঃ তোফাজ্জল হোসেনের চার বিঘা কৃষি জমি, একই ইউনিয়নের বানেছা বেগমের বসতবাড়ি ও কৃষি জমি মিলিয়ে প্রায় তিন বিঘা, মোবারক হোসেনের এক বিঘা কৃষি জমি, মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল মজিদের দুই বিঘা কৃষি জমি, মতি মিয়ার আট বিঘা কৃষি জমি, শৈলাট গ্রামের মোঃ শাহজাহানের তিন বিঘা কৃষি জমি, একই গ্রামের আব্দুর শুকুর মাস্টারের ১১ বিঘা কৃষি জমি, জবান আলী মাস্টারের ৪ বিঘা কৃষি জমি, মোসাম্মত মিতু গংয়ের চার বিঘা কৃষি জমি, মোঃ মিজানুর রহমান মিজার এক বিঘা কৃষি জমি, মোঃ মজিবুর রহমান গংয়ের বসতবাড়ি ও সাইল জমি মিলিয়ে ১৬ বিঘা, মোসাম্মাত ফরিদা খাতুনের আট বিঘা কৃষি জমি, মোঃ মোফাজ্জল হোসেন গংদের চালাসহ ২ বিঘা জমি, মোঃ জমির উদ্দিনের ১৭ শতাংশের বেশি চালা, জালাল উদ্দিন গংদের বসতবাড়ি ও কৃষি জমি মিলিয়ে চার বিঘা, মোঃ মুক্তার আলীর এক বিঘা কৃষি জমি, ছাবদুল আলী গংদের বসতবাড়ি ও কৃষি জমি মিলিয়ে দুই বিঘা, হেলাল গংদের বসতবাড়ি ও কৃষি জমি মিলিয়ে তিন বিঘা, আফসার উদ্দিন গংদের বসতবাড়ি, পুকুর, কৃষি জমি মিলিয়ে ১৬ বিঘা, হারুন মিয়াদের ১৫ বিঘা কৃষি জমি, ফজলুল হক গংদের দুই বিঘা কৃষি জমি, আবুল কাশেম গংদের ১০ বিঘারও বেশি কৃষি জমি, নূরুল ইসলাম গংদের বসতবাড়ি ও কৃষি জমি মিলিয়ে আট বিঘা, বেলাল উদ্দিনের বসতবাড়ি, পুকুরসহ কৃষি জমি মিলিয়ে তিন বিঘা, হেলাল উদ্দিনের বসতবাড়ি, পুকুরসহ কৃষি জমি মিলিয়ে প্রায় তিন বিঘা ও জুলহাস গংদের কৃষি জমি দুই বিঘা নানা কায়দায় হাতিয়ে নিয়েছে ভূমিদস্যুরা। এছাড়াও শৈলাট গ্রামের আবদুল বারেকের এক বিঘা কৃষি জমিসহ একই গ্রামের আবুল কালাম গংদের দুই বিঘা কৃষি জমি, ডাঃ মোঃ আবদুল আজিজের বসতবাড়ি ও কৃষি জমি মিলিয়ে দেড় বিঘা, একই গ্রামের আবদুল আজিজের দেড় বিঘা জমি, আবদুল মজিদের পুকুর, বসতভিটা ও কৃষি জমি মিলিয়ে তিন বিঘারও বেশি, মোঃ ইব্রাহিম গংদের চার বিঘা, আশরাফ খানের এক বিঘা, জয়নাল আবেদীনের ১৭ শতাংশেরও বেশি, শওকত আলীর দুই বিঘা, হাইজলের দুই বিঘা, হাসমত আলী খাঁর ৫ বিঘা, আম্বিয়া খাতুনের আট শতাংশের বেশি, তাজুল ইসলাম গংদের তিন বিঘারও বেশি, মিল্টন গংদের দুই বিঘাসহ এলাকার অসংখ্য মানুষের কৃষি জমি থেকে শুরু করে বসতবাড়ি, পুকুর, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ কবরস্থানের জমি দখলে চলে গেছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান জনকণ্ঠ’কে বলেন, জায়গা জমি দখল সংক্রান্ত মামলা ও জিডি মাঝে মাঝে হয়। দেখা যায় অনেক অভিযোগেই আবার দু’চারদিন পর মিটে যায়। কখনও কখনও আদালত পর্যন্ত মামলা গড়ায়। তবে আমাদের কাছে অভিযোগ আসলে তা তদন্ত করে দেখা হয়। অনেক অভিযোগই সত্য হয় না। নিজেদের মধ্যে বিরোধের কারণেও অনেকে থানায় জমি দখল সংক্রান্ত অভিযোগ দিয়ে থাকনে। এছাড়া স্থানীয় লোকজন বিক্রি করা জমি বেদখল দেয়া ও বার বার বিক্রি করার কারণে শ্রীপুরে জমি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। তাঁর বক্তব্য, স্থানীয় দালাল চক্র একটি জমি বিক্রি করার পর নিজেরাই অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখে। এতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, জমি দখল সংক্রান্ত সমস্যা এই এলাকায় মহামারি আকার ধারণ করেনি।
×