ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কানেক্টিভিটির চুক্তিতে খুলছে অপার সম্ভাবনার দুয়ার

ট্রানজিটের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে প্রস্তুত চট্টগ্রাম বন্দর

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১২ জুন ২০১৫

ট্রানজিটের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে প্রস্তুত চট্টগ্রাম বন্দর

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে সড়ক, রেল ও নৌরুটে যোগাযোগ স্থাপনে দুদেশের মধ্যে চুক্তি এবং একইসঙ্গে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির সমঝোতা হওয়ায় দুয়ার খুলেছে এক অপার সম্ভাবনার। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট এখন আর শুধু আলোচনার বিষয় নয়। আমদানি-রফতানির জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৭ অঙ্গরাজ্য। এতে ব্যস্ততা এবং আয় আরও বৃদ্ধি পাবে দেশের আমদানি রফতানি বাণিজ্যের সিংহদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরের। মন্ত্রিসভার বৈঠকে গত সোমবার চারদেশীয় সড়ক যোগাযোগ অনুমোদিত হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে ভারত, নেপাল ও ভুটান যাওয়ার পথ উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। শুধু যাত্রীবাহী বাস ও ব্যক্তিগত গাড়িই নয়, চলাচল করবে পণ্যবাহী যানবাহনও। ফলে ট্রানজিট এখন আর অপ্রকাশিত কোন বিষয় নয়। ‘সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন চুক্তি’ সম্পাদিত হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতের কলকাতা বন্দরে জাহাজ চলাচল শুরুর বিষয়টি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এতে করে কলকাতা বন্দরের পণ্য বোঝাই কন্টেনারগুলোকে ভবিষ্যতে আর কেলাং আর সিঙ্গাপুর বন্দর ঘুরতে হবে না। এতে করে তাদের পণ্য পরিবহন সহজ এবং খরচও অনেক কমে যাবে। দুদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় এমভি রোদেলা নামের একটি কন্টেনার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কলকাতা বন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে যাবার অপেক্ষায় রয়েছে। জাহাজটি বহন করবে কিছু খালি ও পণ্যভর্তি কন্টেনার। বন্দরের এক কর্মকর্তা জানান, কলকাতা বন্দরে খালি কন্টেনারের চাহিদা রয়েছে। চালুর পর রুটটি পরিচিত ও আমদানি-রফতানিকারকদের এ সম্পর্কে ভালভাবে জ্ঞাত হতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে অল্প সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম-কলকাতা রুট ব্যস্ত হয়ে উঠবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বন্দর কর্তৃপক্ষের এ কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, ভারতের সাতটি অঙ্গরাজ্যকে সার্ভিস দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে কর্তৃপক্ষ। কারণ, দেশের আমদানি-রফতানি সামাল দিতে চট্টগ্রাম বন্দরকে তার সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে হয় না। বরং সক্ষমতার প্রায় ৪০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকে। তবে সড়ক ও রেলপথে পণ্য পরিবহন করতে চাইলে এই দুক্ষেত্রে আরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এদিকে ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার ক্ষেত্রে সমঝোতা হওয়ায় সন্তুষ্ট বার্থ অপারেটর, টার্মিনাল অপারেটর এবং বন্দর সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। কারণ এতে কর্মব্যস্ততা বাড়লে বৃদ্ধি পাবে তাদের আয়। একইসঙ্গে কর্মসংস্থানও বাড়বে। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (প্রশাসন) মোঃ জাফর আলম জনকণ্ঠকে জানান, উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রটোকল অনুযায়ী সরকার সিদ্ধান্ত নিলে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিবেশী ভারতকে সার্ভিস দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। এক্ষেত্রে বন্দরের সক্ষমতায় কোন ঘাটতি নেই। বন্দরের কর্মকর্তা ও বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ভারত মূলত চট্টগ্রাম বন্দর সুবিধা চাইছে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় সাতটি অঙ্গরাজ্যের জন্য। নিজস্ব বন্দর সুবিধা না থাকায় এ রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবাহিত হয় কলকাতা বন্দর থেকে। এতে করে স্থল পথে হাজার কিলোমিটার অতিরিক্ত পাড়ি দিতে হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা পেলে ঐ রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনে খরচ অনেক কমে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ভারতে কোন ধরনের পণ্য যেতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) জানান, প্রধানত নির্মাণ সামগ্রী, শিল্পের কাঁচামাল ও খাদ্যপণ্য যাবে চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্য দিয়ে। ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধায় এসব পণ্যের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহৃত হলে বন্দর পাবে লোডিং-আনলোডিং চার্জ, ডিসচার্জ ফি এবং স্টোরেজ চার্জ। এতে করে বন্দরের আয়ও বৃদ্ধি পাবে। বার্থে কাজ বৃদ্ধি পেলে তা সৃষ্টি করবে বাড়তি কর্মসংস্থান। ভারতকে সেবা দিতে আলাদা কোন জেটি রাখার কোন পরিকল্পনা এখনও নেই। সবকিছু নির্ভর করছে ভারতে কি পরিমাণ পণ্য পরিবাহিত হবে তার ওপর। উল্লেখ্য, ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ প্রদানের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে একটি আলোচনার বিষয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৮ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে এ আলোচনা বেশ জোরালো এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। কিন্তু দুদেশের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও নানা জটিলতায় তা বাস্তবায়ন হচ্ছিল না। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতাসীন হলে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নতুন মাত্রা পায়। ভারতের নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতাসীন হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরবে এমন জল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের ব্যাপারে আরও আন্তরিক আগ্রহ প্রদর্শন করেন। ফলে ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ প্রদানের বিষয়টি বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যায়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিবহন বিভাগ সূত্র জানায়, ইতোমধ্যেই মিয়ানমার থেকে আসা ভারতীয় পণ্যবাহী ৯২টি কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে, যা আরেকটি জাহাজযোগে চেন্নাই ও কোচিন বন্দরে যাবে। তবে এই ৯২টি কন্টেনার যাওয়ার বিষয়টি চুক্তির আওতাধীন নয়। কিন্তু এমভি রোদেলা নামের জাহাজটি যাচ্ছে ‘সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহন চুক্তির আওতায়। এই চুক্তি দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন দ্বার উন্মোচিত করতে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের হারবার এ্যান্ড মেরিন বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, ভারতের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব এ কারণেই যে, কলকাতা বন্দরে বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে না। হলদিয়ার পর বড় জাহাজগুলো কলকাতায় যেতে সক্ষম নয় গভীরতা কম থাকায়। ফলে ভারত চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধা পেলে তাতে সময় এবং অর্থ দুটোই সাশ্রয় হবে। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, এর আগে ২০০২ সালের ৭ অক্টোবর স্থল পথে একটি চালান চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নেপাল পাঠানো হয়েছিল। এরপর ২০১২ সালের ২৫ এপ্রিল ২টি কন্টেনার যায় নেপালে। চীন থেকে আমদানি করা ঐ দুই কন্টেনারে ছিল ৪০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক পণ্য। এরপর আর ট্রান্সশিপমেন্ট হয়নি। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ ভারতকে দেয়া হলে অতিরিক্ত কি পরিমাণ পণ্য বন্দরকে হ্যান্ডলিং করতে হবে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বন্দরের পরিচালক (প্রশাসন) জানান, এটি নির্ভর করছে সাত অঙ্গরাজ্যের পণ্য আমদানি-রফতানির পরিমাণের ওপর। তবে এ বিষয়ে তিনি পরিষ্কার ধারণা প্রদান না করলেও ট্রানজিট বিষয়ে গঠিত জাতীয় কোর কমিটি খসড়া প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতকে বাংলাদেশের বন্দর সুবিধা দিলে বছরে অতিরিক্ত প্রায় ২০ লাখ টন হ্যান্ডলিং করতে হবে। এর অর্ধেক করবে চট্টগ্রাম বন্দর। আর বাকি অর্ধেক হ্যান্ডলিং করবে মংলা বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরকে বছরে প্রায় এক লাখ টিইইউএস কন্টেনার অতিরিক্ত হ্যান্ডলিং করতে হবে। এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি ও চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, চট্টগ্রাম হবে রিজিওনাল হাব। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া হলে বন্দরের ওপর যে অতিরিক্ত চাপ পড়বে তা সামাল দেয়া কঠিন হবে বলে আমরা মনে করি না। কারণ চট্টগ্রাম বন্দর ইতোমধ্যেই অত্যন্ত দক্ষ একটি বন্দর হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। তাছাড়া বন্দরকে সফল হতেই হবে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এর বিকল্প নেই। সীমিত পরিসরে হলেও ভারতকে বন্দর ব্যবহারের সুযোগ তথা ট্রানজিট কাযক্রম শুরু হয়ে গেলে পর্যায়ক্রমে সকল অবকাঠামো ঠিক হয়ে যাবে।
×